ভারতের ‘প্রথম’ আন্তর্জাতিক অভিনেতা, অবহেলা-অপমানেও ডুব দিয়েছেন শিল্পেই

কুরোসওয়ার নায়ক যেমন ছিলেন তোশিরো মিফুনে, বার্গম্যানের ম্যাক্স ভন সিডো তেমনই ‘সত্যজিতের নায়ক’ বললে প্রথমেই মাথায় আসবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের (Soumitra Chattopadhyay) নাম। আসলে কিছু অভিনেতারা পরিচালকদের জন্যই হয়তো পৃথিবীতে আসেন। জলসাঘরের সেটে শিশির ভাদুড়ির ছাত্র কৃষ্ণনগরের সৌমিত্রকে, মানিকদা পরিচয় করিয়ে দিলেন ছবি বিশ্বাসের সঙ্গে। তাঁর ‘অপু’ হিসেবে। সেই থেকে শুরু হয় ছায়াছবি জীবন। 

‘অপুর সংসার’ বিশ্বজয় করে ফেরে। সত্যজিতের ক্যামেরায় সৌমিত্র বদলে যান বহুরূপীর মতো। অরণ্যের দিনরাত্রির আধুনিক অসীম, নিমেষেই হয়ে ওঠে অশনি সংকেতের পাড়াগেঁয়ে মাস্টার গঙ্গাচরণ চক্রবর্তী। কিংবা স্মার্ট সুশ্রী প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর ফেলু মিত্তির, উদয়ন পণ্ডিতের রূপে অচলয়াতন ভাঙার নায়ক রূপে ধরা দেন পর্দায়। 

তবে শুধুমাত্র সত্যজিতের ছবিই নয়, তপন সিংহ, মৃণাল সেন কিংবা তরুণ মজুমদারের একাধিক সিনেমার নায়ক তিনিই। আবার মঞ্চের সৌমিত্রের মধ্যে সিনেমার সৌমিত্রকে হারিয়ে ফেলা হয়তো ঠিক হবে না। ‘টিকটিকি’ কিংবা ‘ফেরা’র মত নাটকে তাঁর অভিনয়ের কথা আজও বাঙালির মুখে মুখে ফেরে। যাত্রাও করেছেন একটা সময়। বিভিন্ন মূলধারা’র ছবিও তিনি একাই ‘টেনেছেন’।
অবসর শব্দটি হয়তো তার অভিধানে বিরল…
সৌমিত্রের দীর্ঘ জীবন বহু ভাঙা গড়ার সাক্ষী। সত্যজিতের ছবির সুবাদে তাঁর কথা ছড়িয়ে পড়েছিল ভারতের বাইরে...

পেয়েছেন ফ্রান্সের সবথেকে বড় দু'টি সম্মাননা, ‘অর্দ্রে দে আর্টস দে লেত্রে’ এবং ‘লিজিয়ঁ দ্য'ওনেরে’। ইতালির সিনেমাপ্রেমীরা তাঁকে ভূষিত করেছে লাইফটাইম এচিভমেন্ট পুরস্কারে। বিদেশের বহু পত্রপত্রিকায় তাঁর সম্পর্কে প্রশংসা প্রকাশিত হয়েছে। নাসিরুদ্দিন শাহের মত অভিনেতাও গুরু বলে মেনেছেন সৌমিত্রকে। বলা যেতে পারে তিনিই ভারতের প্রথম আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেতা। অথচ ভারতীয় চলচ্চিত্র মহলে তিনি একসময়ে খানিক ব্রাত্যই ছিলেন। ৮ বার বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট পুরস্কার পাওয়া সত্ত্বেও দেশ তাঁকে সময়ে স্বীকৃতি জানাতে পারেনি। তিনি বুঝেছিলেন,  বলিউডের জাঁকজমকে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে আঞ্চলিক ছবি। কখনো কখনো অভ্যন্তরীণ রাজনীতির শিকার হয়েছেন সৌমিত্র। মেলেনি যোগ্য সম্মান। এই নিয়ে তাঁর খেদ প্রকাশ পেয়েছে বহু সাক্ষাৎকারে।

আরও পড়ুন
সত্যজিৎ রায়কে ‘গুরু’ শিশির ভাদুড়ীর গল্প শোনাতেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

২০০১ সালে ‘দেখা’ ছবিটির জন্য ‘স্পেশাল জুরি আওয়ার্ড’ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। যেমন ১৯৭০ সালে ফিরিয়েছিলেন পদ্মশ্রী। বামপন্থী আদর্শে বেড়ে ওঠা মানুষটি আপোস করেননি কখনো। 

তাঁর মতো কিংবদন্তির জীবনে সেরা অভিনেতা হিসেবে প্রথম জাতীয় পুরস্কার এল জীবনসায়াহ্নে পৌঁছে। ২০০৮ সালে ‘পদক্ষেপ’ ছবিটির জন্য পেয়েছিলেন সেই সম্মান। ‘দাদাসাহেব ফালকে’ এল তার ক'বছর পরে। ততদিনে এই ‘পুরস্কার-স্বীকৃতির’ রাজনীতি সম্পর্কে তিনি উদাসীন হয়ে পড়েছেন। ব্যক্তিগত দুঃখ যন্ত্রণার, পাওয়া না পাওয়ার উর্দ্ধে মঞ্চকেই আঁকড়ে ধরেছেন বারবার…

আরও পড়ুন
থেমে গেল সমস্ত লড়াই, প্রয়াত কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

মৃত্যুকে হারাতে চেয়েছিলেন সৌমিত্র। জীবনের রঙ্গমঞ্চের শেষ কার্টেন কলকে ভয় পেতেন... সেই কথাই বারংবার ফিরে এসেছে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় চিরতারুণ্যের প্রতীক। জরা-মৃত্যু তাঁকে গ্রাস করতে পারে না।

আরও পড়ুন
গুপীর চরিত্রে অভিনয় করতে চেয়েছিলেন সৌমিত্র, রাজি হননি সত্যজিৎ

সূত্র:
১. ‘অকপট সৌমিত্র’ (সুমন দে'র সঙ্গে বিশেষ সাক্ষাৎকার) এবিপি আনন্দ
২. উইকিপিডিয়া

Powered by Froala Editor