‘সোনার কেল্লা’ নয়, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ই ছিল সৌমিত্রের প্রিয় ফেলু-সিনেমা

ষাটের দশকে ‘সন্দেশ’ পত্রিকা রীতিমতো রমরমিয়ে চলছে। সুকুমার রায়ের বহুধাবিস্তৃত রাস্তায় এখন সারথি হয়ে চলেছেন তাঁর পুত্র, সত্যজিৎ রায়। চলচ্চিত্র পরিচালনার কথা নাই বা আসল; তার বাইরে নিজের আঁকা আর লেখায় ভরিয়ে দিতে লাগলেন সন্দেশ। ছোটোরাও খুশি! এরই মধ্যে তাঁর হাত ধরে আরও একজনের আগমন ঘটল পত্রিকার পাতায়। ২৫-২৬ বছরের এক যুবক, লম্বা তীক্ষ্ণ চেহারা, চোখ দুটোয় খেলে যাচ্ছে বুদ্ধির আভাস। বাঙালি এই প্রথম চাক্ষুষ করল প্রদোষ চন্দ্র মিত্র, ওরফে ফেলুদা’কে। ১৯৬৬-৬৭ সালে সন্দেশের পাতায় উঠে এল ফেলুদার প্রথম বড়ো অভিযান ‘বাদশাহী আংটি’। শুধু শিশুরাই নয়, বড়োরাও সমান তালে মেতে উঠল এই অভিযানে। সত্যজিতের পাশে দাঁড়িয়ে ‘ফেলু’র ভেতর ডুব দিয়েছিলেন আরও একজন। ইনিও বেশ লম্বা, তীক্ষ্ণ মার্জিত শিক্ষিত চেহারা। ইনি, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়…

ততদিনে ‘অশনি সংকেত’ পেরিয়ে এসেছেন তিনি। তখনও ভোলেননি ‘মানিকদার’ সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের কথা। কলেজ জীবনে একটু আধটু থিয়েটার করছেন, কবিতা লিখছেন, কফি হাউসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মাতছেন। ‘পথের পাঁচালী’ দেখে মুগ্ধ হয়ে তর্ক জুড়েছেন বন্ধুদের সঙ্গে। এমন সময় এক বন্ধুর মারফৎ খবর এল, ‘অপরাজিত’-এর অপু’র জন্য নতুন ছেলে খুঁজছেন সত্যজিৎ। শুনে তাঁর বাড়ি চলে গেলেন সৌমিত্র। ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই ভেসে এল সেই চিরপরিচিত ব্যারিটোন গলা - ‘এহে, আপনি যে বড্ড লম্বা হয়ে গেলেন!’ তবে ভোলেননি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে। তারপরই সুযোগ এল ‘অপুর সংসার’-এ। ব্যস, গাড়ি এগিয়ে চলল গড়গড়িয়ে… 

মানিকদার কাজের ভেতর নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছিলেন প্রবলভাবে। তাই যখন বইয়ের পাতায় প্রকাশ পেল ফেলুদার ‘বাদশাহী আংটি’, তখন নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না। ফেলু-কে যদি বড়ো পর্দায় নিয়ে আসা যায়! নিজের ভেতরেই ভেতরেই রিহার্সাল করতেন সৌমিত্র স্বয়ং। ফেলু ঠিক কী, কোথায় সে বাকিদের থেকে আলাদা, এই সবকিছু তাঁর মাথায় ঘুরত। সত্যজিৎ নিজে তখনও তাঁর প্রিয় গোয়েন্দাকে সিনেমার পর্দায় নামানোর কথা ভাবেননি। কিন্তু সৌমিত্রের বারবার মনে হত, মানিকদা যেন গল্পের ভেতরেই চিত্রনাট্যের কাজ এগিয়ে রেখেছেন। প্রতিটা জায়গা, তার ডিটেইলস, চরিত্রের বর্ণনা— অবিকল সিনেমার মতো। তখনও অবশ্য জটায়ু আসেননি… 

সেই আদ্যিকাল থেকে আজ অবধি বাঙালি পাঠকদের মনে একটা প্রশ্ন গভীরভাবে গেঁথে আছে। ফেলুদা আদতে কে? কাকে দেখে এই গোয়েন্দা চরিত্রটিকে সৃষ্টি করলেন? এ কি স্বয়ং সত্যজিতের প্রতিচ্ছবি, নাকি কলমে-কাগজে সৌমিত্রই ফেলুদা হয়ে উঠে এসেছেন? এর মাঝেই পর্দায় নেমে এলেন ফেলুদা। বাঙালি কি এর আগে এমন কাছের দাদা-কে গোয়েন্দা হিসেবে পেয়েছে? তোপসে যেন আমাদেরই ছেলেবেলা! সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের চোখেও বারবার এই জিনিসটাই ধরা পড়ছিল। তাই যখন ‘সোনার কেল্লা’র শুটিংয়ের প্রস্তুতি শুরু হল, তখন যাকে বলে ‘স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মুহূর্ত’! রাজস্থানের প্রখর গরমে জাতিস্মর মুকুলের হাত ধরে অ্যাডভেঞ্চার, টানটান উত্তেজনার ভিড়ে উঠে আসা কিছু স্মরণীয় মুহূর্ত— এক লহমায় ছোটো হয়ে যেতে ইচ্ছে করে অনেকের! 

আরও পড়ুন
ভারতের ‘প্রথম’ আন্তর্জাতিক অভিনেতা, অবহেলা-অপমানেও ডুব দিয়েছেন শিল্পেই

এরই মাঝে সুযোগ পেয়ে সৌমিত্র প্রশ্নটা করেই ফেললেন সাহস করে। ফেলুদার ইলাস্ট্রেশন দেখে তো মনে হচ্ছে মানিকদার মতো। তাহলে কি…? সত্যজিৎ অবশ্য অবাকই হয়েছিলেন সেটা শুনে। কারণ তাঁকে অনেকে বলে গেছে, এই ইলাস্ট্রেশন নাকি অবিকল সৌমিত্রের মতো! ‘পাহাড়ে ফেলুদা’ সমগ্রটির প্রচ্ছদেও ফেলুদার আদলে তাঁর ছাপ। কিন্তু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সেই কথা মানতে নারাজ। তাঁর মতে, ব্যক্তি সত্যজিৎ যেরকম প্রখর, তীক্ষ্ণ, হাজার বিষয় নিয়ে পড়াশোনা তাঁর; ফেলুও সেরকমই। একদিকে আন্তর্জাতিক, অন্যদিকে মনেপ্রাণে বাঙালি। এই ছবি সত্যজিতের না হয়ে যাবে কোথায়! 

তবে যে যাই বলুক না কেন, বাঙালিদের কাছে এক ও অদ্বিতীয় ফেলুদা হলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি যে সত্যজিতের ফেলুদা! ‘সোনার কেল্লা’ আর ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছাড়া আর কোথাও ফেলু হিসেবে অবতীর্ণ হননি তিনি। কিন্তু ওই দুটি ছবিতেই নিজের গোয়েন্দার আসন চিরস্থায়ী করে রেখেছেন। মুকুলের ‘দুষ্টু লোক’ থেকে ধুরন্ধর মগনলাল মেঘরাজের সঙ্গে ছায়াযুদ্ধ— সৌমিত্র সব জায়গায় অদ্বিতীয়। যেখানেই নাটকীয়তা এসেছে, সেখানেই ফেলুরূপী সৌমিত্র উজ্জ্বল হয়েছেন। কিন্তু তাঁর নিজের প্রিয় ‘ফেলুদা’র ছবি কোনটি? এই ব্যাপারে ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-কেই এগিয়ে রেখেছেন কিংবদন্তি অভিনেতা। মনে পড়ে মগনলালের ঘরের সেই যুগান্তকারী দৃশ্য? ‘এক মিনিট’-এ শরবত খেয়ে তক্তায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন লালমোহন গাঙ্গুলি, আর উল্টোদিক থেকে একের পর এক ধারালো ছুরি ছুঁড়ে যাচ্ছেন বৃদ্ধ অর্জুন। মগনলালের ভাষায়, সার্কাসের খেলা চলছে। সেই সময় ফেলুদা’কে লক্ষ্য করেছেন? ভেতরে যেন একটা করে আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরণ হচ্ছে। ‘হয় এর বদলা নেব, নয়তো গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে দেব’। ফেলুদা তখন আরও, আরও বেশি উজ্জ্বল। আরও বেশি তীক্ষ্ণ… 

আরও পড়ুন
সত্যজিৎ রায়কে ‘গুরু’ শিশির ভাদুড়ীর গল্প শোনাতেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

আর ঠিক সেই জায়গায় গিয়েই নিজেকে উজাড় করে দেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। কাশীর ঘাটে মগনলালের দিকে একটার পর একটা গুলি চালানোর সময় ফেলুদা’র ওই চাহনি কি একান্তই তাঁর? আর সেইসঙ্গে ওঁর বলা কথাগুলো? সৌমিত্রও তো সেই দৃশ্যে মিশে যান প্রবলভাবে। লালমোহনবাবুর প্রতি কতটা স্নেহ ও সম্মান থাকলে ফেলু’র মতো একজন ‘থিঙ্কিং ম্যান’ গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবতে পারে! ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ এই সমস্ত রং নিয়েই উঠে এসেছে। উঠে এসেছে ফেলু’র সেই তীক্ষ্ণ চোখ, লম্বা চেহারা; উঠে এসেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি ছাড়া আর কে-ই বা সত্যজিতের ফেলুদা হতে পারতেন!       

তথ্যসূত্র- মানিকদার সঙ্গে/ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, আজকাল

আরও পড়ুন
থেমে গেল সমস্ত লড়াই, প্রয়াত কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More