ছাই হয়ে গেছে অরণ্য, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই ইন্দোনেশিয়ার প্রাচীন জনগোষ্ঠীর

তাঁদের বাসস্থান বলতে ছিল জঙ্গল। অন্ন-সংস্থানের জায়গা বলতেও তাই। মাছ ধরা, শিকার আর বনের ফলমূল-শাক-সব্জি দিয়েই চলে যেত জীবন। যেকোনো রোগের ওষুধেরও জোগান দিতেন অরণ্যদেবতাই। তাঁদের বলতে ইন্দোনেশিয়ার পাপুয়া দ্বীপপুঞ্জের মান্ডোবো উপজাতি। বছর ছয়েক আগে এই সবুজের আস্তরণের মধ্যেই কেটে যেত তাঁদের দিন। স্বাচ্ছন্দ্যে মোড়া জীবন। তবে আজ সেই জায়গায় বিরাজ করছে ধূধূ শূন্যতা। ছাই হয়ে গেছে পুরো বনভূমিই। স্থায়ী উপার্জন নেই, নেই অরণ্যদেবের আশ্বাসও। প্রায় অস্তিত্বের সঙ্গেই লড়াই করে যাচ্ছেন ইন্দোনেশিয়ার এই আদি ভূমিপুত্রেরা।

২০১৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার পাম তেল কোম্পানি কোরিন্ডো যোগাযোগ করে মান্ডোবো জনগোষ্ঠীর সঙ্গে। আবেদন জানায়, পাপুয়াতেই তারা গড়ে তুলতে চায় পাম তেল তৈরির কারখানা। তার জন্য প্রতি হেক্টর পিছু তারা দেবে ১ লক্ষ রুপিয়া। সেই সঙ্গে পরিষ্কার পানীয় জলের বন্দোবস্ত, পাকা রাস্তা এবং বিদ্যুৎ পরিষেবার প্রতিশ্রুতি। যাঁদের সঙ্গে অর্থের সেইভাবে কোনো যোগাযোগ ছিল না ১ লক্ষ রুপিয়াতে রাজিও হয়ে যান তাঁরা। দিনবদলের স্বপ্ন দেখতে কে না ভালোবাসে? তবে ১ লক্ষ অঙ্কের এই অর্থমূল্যের ঠিক পরিমাণ কতটা, তা শুনলেই আঁতকে উঠবেন। ৮ ডলার। হ্যাঁ, মাত্র ৮ ডলারেই পুরো অঞ্চল অধিগ্রহণ করেছিল কোরিন্ডো কোম্পানি। 

পাম তেল সরবরাহকারী দেশগুলির মধ্যে পৃথিবীতে এখন প্রথম স্থানে রয়েছে ইন্দোনেশিয়াই। আর তার মধ্যে অন্যতম প্রদেশ হল পাপুয়া। গত বছর ১৯ বিলিয়ন ডলারের পাম তেল রপ্তানি করেছে ইন্দোনেশিয়া। তবে কয়েক বছর আগেও পাপুয়ার চেহারা ছিল একেবারেই অন্যরকম। মূলত প্রকৃতিনির্ভর মানুষের বসবাস হওয়ার ছিল না সরকারের কোনো আর্থিক আয়ও। ফলে কোরিন্ডো কোম্পানি কারখানা তৈরি করতে চাওয়ায় বাধা দেয়নি তাঁরাও।

তবে যত দিন কেটেছে ততই যেন প্রকট হয়েছে দানব। পাপুয়াতে শুধু পাম গাছেরই যে জঙ্গল ছিল এমনটা নয়। বরং পাম গাছ ছিল সামান্যই। আর সে কারণেই প্রাচীন বনভূমিকে কেটে নতুন পাম গাছ বসাতে উদ্যোগী হয় কোরিন্ডো। গত ৫ বছরের মধ্যেই সাফ হয়ে গেছে ৬০ হাজার হেক্টর বনভূমি। এখনও অপমৃত্যু হয়ে চলেছে গাছেদের। 

কিন্তু কীভাবে হচ্ছে এই বননিধন? কোম্পানির দাবি তাঁরা উন্নতমানের যন্ত্রের সাহায্যেই বন কেটে পাম গাছ বসাচ্ছেন। তবে আসল ঘটনা পুরো ভিন্ন। অন্তত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্টে যেটুকু উঠে আসে। জুম চাষের পদ্ধতিতেই সাফ হচ্ছে অরণ্য। প্রথম গাছ কেটে তাতে পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে মাইলের পর মাইল জমি। সেই বিধ্বংসী আগুন থেকে বহুবার ছড়িয়েছে দাবানলও। হিট-সিগনেচার ধরা পড়েছে নাসার স্যাটালাইটেও। ২০১৫-র আগের তথ্যের সঙ্গে সাম্প্রতিক তথ্য মিলিয়ে তার আকাশ-পাতাল তারতম্যকেও দেখিয়েছে বিশ্বের অন্যতম এই মহাকাশ সংস্থা। তবে কোরিন্ডোর মত সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাঁদের দাবি, গ্রামবাসীরাই শিকার করে খায় জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা বড় ইঁদুর। বিভিন্ন জায়গায় এই ইঁদুর ঝলসে খাওয়ার দরুনই ছড়িয়েছে আগুন। আর প্রাকৃতিক কারণ তো আছেই। 

তবে গবেষকরা দেখাচ্ছেন প্রাকৃতিক কারণে বা দুর্ঘটনার জেরে আগুন লাগলে, তা বিভিন্নদিকে ছড়িয়ে পড়ত। কিন্তু পাপুয়ার অগ্নিকাণ্ড ছড়িয়েছে একটি মাত্র নির্দিষ্ট দিকেই। অর্থাৎ, স্পষ্টতই তা ইচ্ছাকৃত এবং মনুষ্যসৃষ্ট। আর এই বিপুল কাঠ পোড়ানোর জন্য প্রতিদিনই ইন্দোনেশিয়ার মাথায় একটু একটু করে জমছে ঘন ধোঁয়ার আস্তরণ। যুক্তরাষ্ট্রের একটি রিপোর্ট জানাচ্ছে শুধু পাপুয়ার কার্বন নির্গমনের মাত্রাই সারা আমেরিকার কার্বন নির্গমনের থেকে বেশি। এই দূষণের কারণে প্রাণও যাচ্ছে জঙ্গলের ভূমিপুত্রদের। সারা ইন্দোনেশিয়ায় গত পাঁচ বছরে ৯০ হাজার মৃত্যুর সঙ্গেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যোগ রয়েছে অগ্নিকাণ্ডের, জানাচ্ছে গবেষণা।

আরও পড়ুন
২০১২-১৬ সালে ১.০৯ শতাংশ বনভূমি কমেছে দেশে, জানাল এনএসও-র রিপোর্ট

ধীরে ধীরে জঙ্গল মুছে যাওয়ায় এখন বিপাকে পড়েছেন জনগোষ্ঠীর মানুষেরা। হয়নি স্থানীয় উন্নতিও। রাস্তা, বিদ্যুৎ, পানীয় জল— কিছুই আসেনি। শুধু বিদ্যুতের জন্য বন্দোবস্ত করা হয়েছে জেনারেটরের। আসলে তার পিছনেও আছে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য। তার জন্য জ্বালানীরও খরচ সেওল বা জার্কাতার মতো ইন্দোনেশিয়ার বড়ো বড়ো শহরের দামেরও চারগুণ। অর্থহীনের পক্ষে সত্যিই কি সম্ভব তা? কিন্তু এভাবেই চলছে ‘শোষণ’। ইন্দোনেশিয়ার বন সংরক্ষণ দপ্তর ও এফএসসি বোর্ড এই অভিযোগের প্রমাণ দেওয়ায়, ক্ষতিপূরণ দিতে রাজিও হয় সংস্থাটি। হেক্টর পিছু আদিবাসীদের দেওয়া হয় আরও ৮ ডলার করে অর্থমূল্য। প্রকৃত অর্থে বাধ্য করা হয় তাঁদের এই অর্থ নিতে। 

তবে প্রশাসনও দৃঢ় কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না কোরিন্ডোর বিরুদ্ধে। কারণ তেল রপ্তানি থেকে বড়ো অর্থকর ঢোকে রাজকোষে। সবমিলিয়ে টাকা দিয়েই সরকারের মুখ বন্ধ করে রেখেছে এই কোম্পানি। শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। কোম্পানির কেনা ৬০ হাজার হেক্টর জমির পরিধি ছাড়িয়েও এখন চলছে জমি অধিগ্রহণ। তার পরিমাণ ঠিক কতটা বেড়েছে তার হিসাব নেই স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কাছে। তবে সরকারি রিপোর্ট বলছে সারা পাপুয়াতে এখন বেঁচে আছে মাত্র ১৯ হাজার হেক্টর বনভূমি। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আর সামান্য মাথা গোঁজার ঠাঁই, এই দুইয়ের জন্যই এখন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। বনভূমির সঙ্গে নইলে এই পৃথিবী থেকে অবলুপ্ত হয়ে যেতে হবে প্রাচীন এই জনজাতিকেই...

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
পঞ্চেশ্বর বাঁধ প্রকল্পের কোপে পিথৌরাগড় বনভূমি, কাটা পড়তে পারে ৩ লক্ষ গাছ

More From Author See More

Latest News See More