দার্জিলিংয়ের গপ্পোগাছা (দুই)

সময়ভ্রমণ - ৩২
আগের পর্বে

জলাপাহাড়ের থেকেও পুরনো সেনানিবাস কাটাপাহাড়। সেখান থেকেই শুরু হয় ব্রিটিশ লেখক ডাউনিংএর 'ওয়ান ম্যান্স ফ্ল্যাগ' গল্পটা। এখানে নায়ক এক ব্রিটিশ গুপ্তচর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির সাহায্য নিয়ে কীভাবে বিপ্লবী প্রচেষ্টা চলছে, তারই খবরাখবর রাখতেন তিনি। অবশ্য ভারত প্রবাসী জার্মানদের সঙ্গে ইংরেজদের এমনিতে সুসম্পর্কই ছিল। বাঙালি-পাহাড়ি বিভাজন করতে চেয়েছিল ব্রিটিশরা। তবে তা সবদিক থেকে সফল হয়নি। দার্জিলিং-কে ঘিরে গড়ে উঠল বাঙালি মহল্লা। সেখানে দুর্গাপুজোর মতো অনুষ্ঠানে এক হয়ে গেলেন পাহাড়ের মানুষও। এমনকি দার্জিলিং-এর শান্ত পরিবেশেও বিপ্লবী উদ্যোগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। ভবানী প্রসাদ ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা হত্যা করতে গেলেন খোদ লাটসাহেবকে।

অবজার্ভেটরি পাহাড়কে বেড় দিয়ে যে রাস্তাটা গোল হয়ে ঘুরছে, মহাকাল মন্দিরে ওঠার সিঁড়িপথ বাঁয়ে রেখে সে পথে খানিক এগুলেই দেখা যাবে, রাস্তার অনেক অনেক নিচে ঘরবাড়ি, গ্রাম, চা বাগান। আরো নিচে, যেখানে চোখ যায় না, রঙনু/রঙ্গু নদী সেঞ্চল পাহাড় থেকে বেরিয়ে গভীর উপত্যকায় গিরিখাত তৈরি করে বয়ে যাচ্ছে। আর একটু গেলেই গাছপালার ফাঁক দিয়ে দেখা যাবে গোলমতো একটা ফাঁকা জায়গা, সেখানে ছোট বড় পুরোনো ঘরবাড়ি, তাদের লাল রঙের চাল, হলদেটে দেয়াল। ওই হচ্ছে লেবঙ। চকবাজার থেকে যে গাড়ির রাস্তাটা ঘুরে ঘুরে লেবঙ যায়, তার নাম লেবঙ কার্ট রোড। গাড়ির রাস্তা হবার আগে, ম্যালের ঠিক নিচে, স্টেপ অ্যাসাইড বাড়িটা যে রাস্তায়, সে পথ ধরে খাড়া উৎরাই আর একটা পথে লেবঙ পথের ভুটিয়া বস্তিতে পৌঁছোনো যায়। 

ভুটিয়া বস্তির পর থেকে লেবঙ পর্যন্ত প্রায় পুরো এলাকাটাই সেনার দখলে। লেবঙ মাঠের মধ্যে ঢোকা যায় না, দরজায় সশস্ত্র প্রহরী, কাঁটাতার, কার্বাইন। মাঠের ত্রিসীমানায় কোনো ফলক-টলক কিচ্ছু নেই, যা দেখে লোকে জানতে পারবে ওখানে এককালে রীতিমতো ঘোড়দৌড় হত, আমোদপ্রমোদ হত, দার্জিলিং থেকে তামাম সাহেবসুবোরা নেমে আসতেন। কাঁটাতার ঘেরা সেনাছাউনিতে ইতিহাস এবং গল্পের প্রবেশ নিষেধ, ফলে বাংলার লাট, গভর্নর স্যর জন অ্যান্ডার্সনকে ওখানে যে গুলি করেছিলেন ভবানী ভটচাজের দল, যার জেরে ভবানীর ফাঁসি হয়েছিল ও অন্যদের অনেকের যাবজ্জীবন, সে সব কথা আজকের লেবঙ দেখে বুঝবার জো নেই। বরং লেবঙ জায়গাটাকে কাছ থেকে না দেখে ওপর থেকে দেখাই ভালো - সবুজ-নীল পাহাড়ের সারি ছড়িয়ে পড়ছে যতদূর চোখ যায়, মেঘ আসছে যাচ্ছে, হঠাৎ দেখা গেলো পাহাড়ি ঢাল থমকে দাঁড়াচ্ছে একফালি সমতল মাঠে, লাল চালের বাংলোবাড়ির ওপর এসে পড়েছে ঝকঝকে রোদ। ছবির মতো, ছবি, মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়।

লেবঙ কথাটা এসেছে লেপচা 'আলিবং' থেকে। লেপচা অর্থাৎ রঙ ভাষায়, 'আলি' মানে জিভ আর 'অ্যাবঙ' মানে মুখ। দুইয়ে মিলে আলিবং, সেই থেকে লেবঙ। দার্জিলিং থেকে দুটো শাখা পাহাড় বা স্পার দুদিকে গেছে, একদিকে তাকভর, অন্যদিকে লেবঙ। ও'ম্যালির গ্যাজেটিয়ারে লেবঙ নামের মানে করা হয়েছে জিভের মতো আকারের পাহাড়। সাহেবরা কেন স্থানীয়দের ভাষা শেখে না, সেই ভাবনায় তাড়িত হয়ে ভুটিয়া শব্দ ও ব্যাকরণের একটি বই লিখেছিলেন গ্রাহাম স্যান্ডবার্গ। ১৮৯৫ সালে,  কলকাতার ৪৬ নম্বর বেচু চ্যাটার্জি স্ট্রিটের হেয়ার প্রেস থেকে সেটি ছেপেছিলেন যদুনাথ শীল। স্যান্ডবার্গ সম্ভবত ধর্মযাজক ছিলেন। তিব্বতি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে শ্রদ্ধাশীল ও উৎসাহী স্যান্ডবার্গ তার বইটির শেষে বেশ কিছু লেপচা শব্দের উল্লেখ করেছেন। সেখানে দেখা যাচ্ছে আলিবঙ(লেবঙ) শব্দের মানে, জিভওলা একটা মুখ। 

লেবঙ ছাউনি অবশ্য বেশ পুরোনো। জলাপাহাড় কাটাপাহাড় অঞ্চলে একে ঠান্ডা বেশি, তায় দার্জিলিংয়ের গাছপালা সব কেটে সাফ করে দেওয়া হয়েছিল বলে হাওয়া বইত জোরে। সে তুলনায় লেবঙ অনেকটা নিচে, ঠান্ডা কম। সাতপাঁচ বিবেচনা করে সাহেবরা ১৮৮২ নাগাদ লেবঙ এলাকায় আর একটা সেনাছাউনি বসায়। সেই ছাউনিরই একটা টুকরো অংশে ঘোড়দৌড় শুরু হয় ১৯২৪এ। মাঠ, অর্থাৎ কিনা রেসকোর্সের জিম্মা ছিল দার্জিলিংয়ের জিমখানা ক্লাবের কাছে। সে ক্লাবটায় এখন বড় বড় হোটেলবাড়ি হয়েছে, তবে পুরোনো বাড়িটাও আছে।

আরও পড়ুন
দার্জিলিংয়ের গপ্পোগাছা

লেবঙ রেসকোর্সটা ছিল মরসুমি। বাইরে থেকে লোকজন এলে চালু হত। খোঁজ নিয়ে দেখলাম ১৯৮৪ অবধি লেবঙে ঘোড়দৌড় হত। সে যাক। অ্যান্ডার্সন পর্বে ফিরি। অ্যান্ডার্সন সায়েব ছিলেন স্কটিশ। পড়াশুনো এডিনবরা ও লিবজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর বয়স যখন মাত্রই বাইশ, তিনি রাজকর্মচারী হওয়া মনস্থির করে ফেলেন, এবং সেই থেকে একনিষ্ঠ ভাবে সায়েবরাষ্ট্ৰকে সেবা দিতে থাকেন। উপহারস্বরূপ, ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ওয়েভারলির প্রথম ভাইকাউন(ভিসকাউন্ট) বানায়। তুখোড়, মেধাবী এবং সায়েবশাসনের অকাট্য নৈতিকতায় আমৃত্যু বিশ্বাসী অ্যান্ডার্সন ১৯৩২ থেকে ১৯৩৭ অবধি বাংলার লাট, অর্থাৎ গভর্নর ছিলেন। যে সময় তিনি বাংলায় পা রাখছেন, এবং সে সুবাদে দার্জিলিংয়ে,ঔপনিবেশিকতা বিরোধী লড়াইয়ের তাতে বাংলা ফুটছে। ১৯৩০-এ চট্টগ্রাম বিদ্রোহ, সে বছরই বিনয়, বাদল আর দীনেশের রাইটার্স আক্রমণ। ১৯৩২-এই, অ্যান্ডার্সনের পূর্বসূরী স্ট্যানলি জ্যাকসনকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে গুলি করছেন বীণা দাস। ওদিকে, ভগৎ সিংয়ের ফাঁসি হচ্ছে ১৯৩১-এ। ওই সময় বাংলার সর্বময় শাসক হয়ে আসছেন যিনি, বোঝাই যায়, তাঁর প্রধান কাজ কি। অ্যান্ডার্সনের আমলে পুলিশি ধরপাকড় ইত্যাদি বেড়ে যায় বহুগুণ। অ্যান্ডার্সনের নিজের কথায়, সন্ত্রাসবাদকে তিনি আমূলে এবং সজোরে উৎপাটিত করতে চাইছিলেন। সন্ত্রাসবাদ না নির্মূল হলে সাধারণ শান্তিপ্রিয় মানুষ বেঁচে থাকতে পারবেন না, অ্যান্ডার্সনের বক্তব্য। ৩২-এ যখন বাংলায় আসেন, আমমানুষ হয় নিস্পৃহ নয় সন্ত্রাসবাদীদের প্রচ্ছন্ন সমর্থক, ৩৭-এ তিনি যখন বাংলা ছাড়ছেন, লোকে ধন্য ধন্য করছে, সন্ত্রাসবাদীরা বিলকুল ঠান্ডা হয়ে গেছে। 

সন্ত্রাস কমানোর অ্যান্ডার্সনীয় কায়দায় তৎকালীন বিপ্লবীরা যে যারপরনাই উৎপীড়িত হচ্ছিলেন, সন্দেহ নেই। কলকাতার খাঁখাঁ গরম ও বিপ্লবী আক্রোশ থেকে বাঁচতে অ্যান্ডার্সন দার্জিলিংয়ের ঠান্ডায় থিতু হলেন, ভবানীর নেতৃত্বে ছ-জনের বিপ্লবী দল তাঁর পিছন পিছন এল। য়্যান্ডার্সন বাংলার পুলিশ কর্মচারীদের নিরাপত্তা বাড়িয়েছিলেন, সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ বিষয়ে তিনি সবাইকে সদাসতর্ক থাকতে বলতেন। সেই অ্যান্ডার্সনও বুঝতে পারেননি, সন্ত্রাস পাহাড় চড়তেও জানে, ঠান্ডাগরম ভেদ করে না। ফলে তিনি যখন ঘোড়ার দৌড় দেখতে(এবং সম্ভবত বাজি ধরতেও ব্যস্ত), আক্রমণ হল অতর্কিতে। একটা রেস শেষ হয়েছে, ঘোড়াদের আস্তাবলে ফেরানো হচ্ছে, অ্যান্ডার্সন যেখানে বসে ছিলেন তার ঠিক পাশের গ্যালারি থেকে তাঁকে গুলি করা হল। ব্যাপারটা এতই অভাবনীয় ও অবিশ্বাস্য যে শুধু দার্জিলিং, কলকাতা কিম্বা ভারত নয়, বলতে গেলে গোটা বিশ্বে হইহই পড়ে গেলো। পড়ার কথাও। দার্জিলিং সেকালে এক নম্বর হিল স্টেশন, কৌলিন্যে ও আমোদে সিমলার সমতুল, সায়েবদের নিজস্ব জীবাণুমুক্ত পরিসর। সেখানে স্বয়ং লাটসাহেবের ওপর হামলা মানে সায়েবশাসনের মূলে কুঠারাঘাত। ঘটনা ঘটছে ১৯৩৪-এর ৮ই মে। কলকাতা থেকে তারবার্তা পৌঁছে যাচ্ছে সাগর মহাসাগর পেরিয়ে নিউ ইয়র্কে। ৯ই মে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ খবর বেরুচ্ছে(হেডলাইনসুদ্ধ তুলে দেওয়া হল):

আরও পড়ুন
দার্জিলিং-এর বহু গল্প

বাংলার লাট আততায়ীদের হাত হইতে বাঁচিলেন

দার্জিলিংয়ের নিকটবর্তী রেসের মাঠে স্যর জন য়্যান্ডার্সনকে কাছ হইতে গুলি করিলো চার বাঙালি 

আরও পড়ুন
দার্জিলিংপত্তনের পর

জীবনের ওপর তৃতীয় আক্রমণ

তাঁহার রেলগাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটে ও গতবৎসর বিশ্ববিদ্যালয়ে বোমা ফাটে

আরও পড়ুন
দার্জিলিংপত্তন: লয়েডের চিঠি ও লয়েডবিদায়

কলিকাতা, ৮ই মে। আজ স্যর জন য়্যান্ডার্সন, বাংলার লাটসাহেব, অল্পের জন্য মৃত্যুর হাত হইতে রক্ষা পাইলেন। চারিজন বাঙালি তাহাকে লক্ষ্য করিয়া গুলি ছোঁড়ে….

লাটসাহেব একটি খোপের মধ্যে তাঁহার কন্যা মিস মেরি য়্যান্ডার্সনকে লইয়া দাঁড়াইয়া ছিলেন। গভর্নরের কাপ সংক্রান্ত অনুষ্ঠান শেষ হইবা মাত্র বাঙালিরা রিভলভার লইয়া খোপের সম্মুখে চলিয়া আসে, এবং খুব নিকট হইতে(পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ) পরপর কয়েকটি গুলি ছোঁড়ে। লাটসাহেবের খোপে কেহ আহত হন নাই….

গুলির আওয়াজ ধ্বনিত হইবামাত্র….দার্জিলিংয়ের পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট মি. ই. ই. ইংলিশ নিজের রিভলভার বাহির করিয়া...একজন আততায়ীকে গুলি করিয়া মারেন। গ্রীন নামক জনৈক ইঞ্জিনিয়ার আর একজনকে ধরিয়া ফেলেন। 

মোট ছয় জন বাঙালিকে গ্রেপ্তার করা হয়। চার জনের নিকটে রিভলবার ছিলো। নিকটস্থ ব্যারাক হইতে ফৌজকে ডাকিয়া আনা হয়।

অ্যান্ডার্সন সে যাত্রায় বেঁচে যান। আগেও বলা হয়েছে, এই ব্যর্থ হত্যাপ্রচেষ্টার ফল দার্জিলিংনিবাসী বাঙালিদের ক্ষেত্রে মারাত্মক হয়। দার্জিলিংয়ে কয়েক পুরুষ ধরে আছেন এমন বাঙালিদের বেশ কয়েকজনের মুখেই শুনেছি, ১৯৩৪-এ দার্জিলিংয়ের যাবতীয় বাঙালি বাড়িতে সকালবিকেল পুলিশি খানাতল্লাসি চলত। অল্পবয়সী ছেলেদের থানায় ডেকে নিয়ে গিয়ে মারধর করা হত, আটকে রাখাও হত। পুলিশি অত্যাচারে উত্যক্ত ও সন্ত্রস্ত হয়ে অনেকে দার্জিলিং ছেড়ে পালিয়ে যান, আর ফিরে আসেন না। দার্জিলিংপত্তনের পর থেকে বাঙালিরা সায়েবদের প্রতি যে আনুগত্য দেখিয়েছেন, সেই ট্র্যাডিশনে ছেদ পড়ে। বাঙালি মাত্রেই সায়েবশত্রু, এমন প্রচার হতে থাকে পাহাড় জুড়ে।

যাঁরা সেদিন জন অ্যান্ডার্সনকে মারতে লেবঙে গিয়েছিলেন, তাঁদের কি হল শেষ পর্যন্ত? লেবঙ গুলিকান্ড কলকাতা হাই কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সি জে ডার্বিশায়ারের রায়ের কথা বলেছি। সায়েবরা নিজেদের কাজকে ঠিক প্রমাণ করতে নানান মিথ্যে বলত, সুতরাং যে তদন্তরিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে এই রায়, সেখানে বিস্তর বাজে কথা থাকা সম্ভব। সেই সম্ভাবনা মনে রেখেও রায়টা খতিয়ে দেখা দরকার। অত্যাচারী সায়েবশাসক মারতে বাঙালি বিপ্লবীরা এলেন, সায়েবরা তাঁদের মারলো ধরল ফাঁসি দিল যাবজ্জীবন দিল, সমস্ত গল্পটা এত সরল নাও হতে পারে, একটা বড় গল্পের মধ্যে বহু অন্যান্য মোচড় ইত্যাদি থেকে যেতেই পারে। 

রায়টা থেকে ঘটনার যে বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে, নিউ ইয়র্ক টাইমসের বয়ানের সঙ্গে তার ফারাক আছে। থাকার কথাও। একে এই সব ঘটনা চিরকালই রগরগে করে পরিবেশন করা রেওয়াজ, তদুপরি সে সময়ে খবর দেওয়ানেওয়া খুব সহজ ছিল না। রায় থেকে বোঝা যাচ্ছে, লাটসায়েবের খোপ অর্থাৎ বক্সের সামনে এসেছিলেন একজন, আর একজন ছ ফুট দূরের একটা গ্যালারি থেকে গুলি ছুঁড়েছিলেন। দুজনকেই পুলিশ গুলি করে, পরে জনৈক ট্যান্ডি গ্রিন ও বারওয়ারির(?) রাজা 'বীরের মতো'(বলা ছিল 'গ্যাল্যান্টলি') লাফিয়ে পড়ে তাঁদের ধরে ফেলেন। এই দুজনের একজন ভবানীপ্রসাদ, দ্বিতীয়জন রবীন্দ্রনাথ ওরফে সমরজিৎ ব্যানার্জী। তাঁদের 'স্বীকারোক্তি' ইত্যাদি থেকে দলের অন্যান্যদের সন্ধান পাওয়া যায়। বোঝা যায়, ষড়যন্ত্রের শিকড় গভীরে। ভবানী ও রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও দলে ছিলেন মনোরঞ্জন ব্যানার্জী ওরফে নরেশ চৌধুরী, উজ্জ্বলা মজুমদার, মধুসূদন ওরফে অমিয় ব্যানার্জী ওরফে সুনীল সেন, সুকুমার ঘোষ ওরফে লান্টু এবং সুশীল কুমার চক্রবর্তী ওরফে অজিত কুমার ধর। এঁদের বিচারের জন্য বিশেষ আদালত গঠন করা হয়। সেই আদালত ভবানী ও রবীন্দ্রনাথকে 'হত্যার চেষ্টা'র জন্য দোষী সাব্যস্ত করে, তাঁদের প্রাণদণ্ডের বিধান দেয়। মনোরঞ্জনকেও হত্যা ও অস্ত্র রাখার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়। উনিশ বছরের উজ্জ্বলাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়, ও মধুসূদন ও সুকুমারকে চোদ্দ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। সুশীল চক্রবর্তীকে বারো বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়, কিন্তু বাকিরা হাই কোর্টে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলেও সুশীল করেননি। অ্যান্ডার্সনের জীবনীকার বলছেন, সায়েব এতই উদার ছিলেন যে তাঁকে মারতে এসেছিল যাঁরা তাঁদের প্রতি তিনি বিশেষ সহানুভূতিশীল ছিলেন, একজন নাকি তাঁকে জেলের ভিতর থেকে নিয়মিত কৃতজ্ঞতাসূচক চিঠি পাঠাত। অ্যান্ডার্সন তার সাজা কমিয়ে দেওয়ার সুপারিশ করেন, সে আগেই ছাড়া পায়। মে মাসের গোড়ায় লেবঙকাণ্ড ঘটছে, অগস্টের মধ্যে সবাই ধরা পড়ছেন। বোঝাই যাচ্ছে, দলের মধ্যে কেউ বিশেষভাবে মুখ খুলেছিলেন। তিনি সুশীল চক্রবর্তী কিনা সে বিষয়ে এখন নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়। 

হাইকোর্টের রায় থেকে গোটা ষড়যন্ত্রের নিম্নলিখিত বয়ান সামনে আসে:

১৯৩২-এ ঢাকা নিবাসী জনৈক সুরেশ মজুমদারের কন্যার নাম ছিল উজ্জ্বলা, তার বয়স তখন ১৭। তাঁর ছেলের নাম গোপাল, বয়স পনেরো। সুরেশের প্রথম স্ত্রী, উজ্জ্বলা ও গোপালের মা মারা যাবার পর সুরেশ দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর বয়স উজ্জ্বলার চেয়ে মাত্র দু বছর বেশি। ব্যবসাবাণিজ্যের কারণে সুরেশকে বাইরে বাইরে কাটাতে হত, ছেলেমেয়েদের তিনি সময় দিতে পারতেন না। উজ্জ্বলা ও গোপাল দুজনেই ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবার জন্য তৈরি হচ্ছিল। ১৯৩২-এ সুরেশ উজ্জ্বলাকে পড়ানোর জন্য গৃহশিক্ষক খুঁজছেন, সুকুমার ওরফে লান্টু তাঁর কাছে গেল। সংস্কৃত ভালো জানে না বলে লান্টুকে সুরেশের পছন্দ হল না। লান্টু তখন মধুসূদন ব্যানার্জিকে (মধুসূদন নিজের নাম বলেছিলো অমিয়) সুরেশের কাছে নিয়ে আসে। সুরেশ তাকে উজ্জ্বলার শিক্ষক নিযুক্ত করেন। মধুসূদনের সূত্রে তার ভাই মনোরঞ্জনও(সে নরেশ নামে পরিচিত ছিলো)ওই বাড়িতে ঢোকে। মধুসূদন প্রায় ছ মাস উজ্জ্বলাকে পড়ায়, তারপর কাজে গাফিলতির অভিযোগে সুরেশ তাকে আসতে বারণ করেন। 'পরিতাপের ও দুর্ভাগ্যের কথা'(রায়ে এভাবেই বলা ছিলো), মধুসূদনের যাতায়াত বন্ধ হয় না। শুধু মধুসূদন নয়, মনোরঞ্জন ও সুকুমারও যাওয়া আসা করতে থাকে। এই অন্তরঙ্গতার ফল দাঁড়ায় মারাত্মক। সে কাহিনি পরেরবার।

Powered by Froala Editor