চিত্তপ্রসাদে সাজছে দেওয়াল, ছবিতে মেহনতি মানুষের লড়াই

কোথাও চোটে গেছে দেওয়ালের একাংশ। কোথাও আবার ফাটল ধরেছে মাটির দেওয়ালে। কিন্তু তাতে কী? তার ওপরেই পরিপূর্ণতা পেয়েছে শিল্প, রঙের সংমিশ্রণ। যা দেখলেই এক ঝটকায় মনে পড়ে যাবে আজ প্রায় পাঁচ শতক আগের আঁকা ইতালির ফ্রেস্কোগুলি। তবে মাইথোলজি নয়, বরং উঠে এসেছে সাধারণ মানুষের কথা। উঠে এসেছে তাঁদের প্রতিবাদের ভাষা, যন্ত্রণা, অধিকার বুঝে নেওয়ার দাবি। সম্প্রতি বাঁকুড়ায় দেওয়াল সেজে উঠছে এমনই সব ছবিতে।

বাংলার দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছে নির্বাচন। আর সর্বশক্তি দিয়েই সেই যুদ্ধে নেমেছে বাংলার সমস্ত রাজনৈতিক দলই। তবে সেখানে সাধারণ মানুষের কথা উঠে আসছে না একবারও। বরং ভোটের ঠিক আগের মুহূর্তে দাঁড়িয়ে চলছে কাদা ছোড়াছুঁড়ির এক নোংরা খেলা। সেই জায়গায় দাঁড়িয়েই এক ‘ব্যতিক্রমী’ প্রচার চালাচ্ছে বামপন্থী দল সিপিআই(এম-এল) লিবারেশন। শিল্পের মাধ্যমে তুলে আনছেন মেহনতি মানুষদের না পাওয়াগুলোকেই। আর এই অভিনব উদ্যোগের পিছনে রয়েছেন দুই তরুণ শিল্পী— অনুপম রায় এবং জিৎ নট্ট।

“বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলির এত অ্যাজেন্ডা যে দেওয়াল ছোট হয়ে যাচ্ছে! মেনস্ট্রিম প্রোপাগ্যান্ডা, মিডিয়া সবকিছুই তাদের হাতে। আর সোশ্যাল মিডিয়াতেও প্রচারের মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে নোংরা মিম। পপুলারিজমটাকে যে মাত্রায় নিয়ে গেছে, সেটাকে দাঁড়িয়ে কাউন্টার করার চিন্তা প্রথম থেকেই ছিল”, বলছিলেন শিল্পী অনুপম রায়। 

আরও পড়ুন
চিনেভাষায় 'খেলা হবে', ভোটের দেওয়াল জুড়ে 'চিনে কলকাতা'

প্রথমে বাঁকুড়ার ওন্দা এবং রানিবাঁধ বিধানসভায় কিছুদিন আগেই এই ধরণের শৈল্পিক দেওয়াল লিখন করেছেন তাঁরা। বর্তমানে কাজ চলছে মুর্শিদাবাদেও। তবে এখানেই কি শেষ? উত্তর দিলেন শিল্পী জিৎ নট্ট, “শিলিগুড়িতেও হবে। একেবারে নকশালবাড়ি পর্যন্ত। নদীয়াতেও অন্য একটি টিম গেছে। যে ১২টি বিধানসভায় প্রার্থী দাঁড়িয়েছে আমাদের সেখানে তো হচ্ছেই, পাশাপাশি কলকাতা এবং অন্যান্য জায়গায় যেখানে প্রার্থী দাঁড়ায়নি সেখানেও দেওয়ালে দেওয়ালে ছবি আঁকা হচ্ছে ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে।”

আরও পড়ুন
বাংলা হরফ আর ছবিতে বিশাল দেওয়ালচিত্র, ঐতিহ্য-সংস্কৃতি বাঁচানোর লড়াই মিশিগানে

বাংলায় দেওয়াল লিখনের এক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। তা নকশালবাড়ি আন্দোলনের সময়ই হোক কিংবা তেভাগার সময়। সেসময় দেওয়ালে দেওয়ালে ফুটে উঠত মানুষের দাবি। অভিনব কার্টুন কিংবা দু’লাইন কবিতাও। দেওয়ালচিত্রে মেহনতি মানুষের কথা তুলে ধরতেন চিত্তপ্রসাদ কিংবা জয়নুল আবেদিন। কিন্তু সময়ের হাত ধরেই যেন হারিয়ে যেতে বসেছে সেই ঐতিহ্য, শিল্প, এবং প্রতিবাদের ভাষা। সবকিছু ফুরিয়ে যাওয়া সেই ভাষাই আরও একবার প্রাণ ফিরে পাচ্ছে এই তরুণ-তুর্কিদের উদ্যমে।

উত্তর ২৪ পরগনার বাসিন্দা অনুপম শিল্পকলা নিয়ে পড়াশোনা করেছেন আম্বেদকর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। অন্যদিকে জিৎ নট্টের পড়াশোনা শান্তিনিকেতনে। ছাত্রাবস্থা থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়া দু’জনেরই। তবে বিন্দুমাত্র তার প্রভাব পড়েনি সৃজনে। বরং দুই ক্ষেত্রকে একসূত্রে বাঁধছেন তাঁরা।

এসব ছবিতে কোথাও দেখা দেখা যাচ্ছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষের সমবেত প্রতিবাদ, পদযাত্রা। আবার কোথাও ফুটে উঠছে প্রাপ্যটুকু থেকে বঞ্চিত কৃষকের চিত্র। না, তাঁরা কেউ-ই কাল্পনিক চরিত্র নন। একেবারে বাস্তবের মাটি থেকেই তুলে আনা হয়েছে তাঁদের। “আমরা একটি বাড়ির দেওয়ালে রং করার সময়, সেই কৃষক পরিবারেরই এক সদস্যের ছবি ফুটিয়ে তুলি দেওয়ালে”, জানালেন অনুপম।

তবে আশ্চর্য বিষয় হল, আকর্ষণীয় এই দেওয়ালচিত্রগুলির আঁকা হয়েছে সাদা চুনের ওপরে শুধুমাত্র লাল আর কালো রং দিয়ে। কোথাও কোথাও নীল রঙের ব্যবহার হলেও তা সামান্য। আসলে সাম্যের স্বপ্ন দেখা এবং দেখতে শেখানো মানুষগুলোর কাছে অর্থ কই? সামান্যতম জোগাড় দিয়েই তাই চলছে কাজ। “কখনও রং শেষ হয়ে যাওয়ায় মাঠের খড়িমাটি তুলে এনেও দেওয়ালে রং করা হয়েছে”, বলছিলেন জিৎ নট্ট।

তবে এই অভিনব কর্মকাণ্ডের কাণ্ডারী হয়েও সমস্ত কৃতিত্ব নিতে অস্বীকার করলেন অনুপম এবং জিৎ নট্ট। কিন্তু কেন? “সকলে বলছে জিৎ নট্ট কিংবা অনুপম রায়ের কাজ। আসলে এই দেওয়াল লিখন একটা কালেক্টিভ কাজ। এর সঙ্গে বহু মানুষ জড়িত রয়েছেন। গ্রামেরই অনেকে হাত মিলিয়েছেন আমাদের সঙ্গে। কখনো আমরা আউটলাইন করে দিয়েছি, রং ভরেছেন তাঁরা। কখনো অন্যভাবে সাহায্য করেছেন।” বাঁকুড়া জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মী ফারহান জানালেন, “বহু আগে থেকেই বিষ্ণুপুরের জেলা কার্যালয়ে দরিদ্র শিশুদের বিনামূল্যে পড়াশোনা, ছবি আঁকা শেখার ব্যবস্থা করেছি আমরা। তারাও সামনে থেকে এই কাজ দেখেছে। তারাও রং ভরেছে দেওয়ালে।” 

এক অর্থে সাধারণ মানুষের দাবির কথা তুলে ধরেছেন সাধারণ মানুষই। এই কর্মকাণ্ডের পিছনে যে অক্লান্ত পরিশ্রম রয়েছে, তা নিয়ে আর নতুন করে বলার নেই কিছুই। বিগত দুই-তিন সপ্তাহ ধরেই চলছে এই দেওয়াল লিখনের কর্মসূচি। চলবে নির্বাচনের ঠিক আগে পর্যন্ত। এর আগে যাদবপুর, প্রেসিডেন্সি-সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রাফিটি কিংবা ছবির মাধ্যমে প্রতিবাদ হলেও সাধারণ মানুষের সামনে ততটাও আসেনি সেসব ছবি। বলতে গেলে সাম্প্রতিক সময়ে কোনো নির্বাচনে প্রকাশ্যে এই ধরণের প্রচার এই প্রথম। যা ফিরিয়ে দিচ্ছে শিল্পের মাধ্যমে গণ-আন্দোলনের স্মৃতিকে। পাশাপাশি সামগ্রিক শিল্পকেও যে এই ‘ফ্রেসকো’-গুলি সমৃদ্ধ করবে তা আগামীদিনে, তাতে সন্দেহ নেই বিন্দুমাত্র…

Powered by Froala Editor

More From Author See More