দেওয়াল জুড়ে সবুজের ছোঁয়া, কলকাতার এই বাড়িই যেন ছোট্ট বায়োস্ফিয়ার

আর পাঁচটা বাড়ির থেকে নিজের বাড়ি আলাদা করতে ইদানিং চল বেড়েছে ইন্টেরিয়ারের। এমনকি বাইরের দেওয়ালেও সবুজ রং এবং গাছের আদলে কারুকাজ অনেক সময়ই প্রাকৃতিক করে তোলে বাড়ির দৃষ্টিনান্দনিকতাকে। বরাহনগরের নেতাজি কলোনির এই বাড়িকে দূর থেকে দেখলে তেমনই মনে হবে। তবে কাছে গেলেই বোঝা যাবে প্রাণের সজীবতা। বাড়ির দেওয়াল জুড়েই বেড়ে উঠেছে এক ধরণের লতানে গাছ। কংক্রিটকে মুড়ে ফেলেছে সবুজের আস্তরণ।

বরাহনগরের এই বাড়ি কলকাতার প্রখ্যাত স্যান্ড আর্টিস্ট কৌশিকের। তবে এই বাড়ির দেওয়াল সজীব হয়ে উঠেছে তার এবং তার পরিবারের পরিচর্যায়। শুরুটা হয়েছিল বছর চারেক আগে৷ ইন্টারনেট থেকেই কৌশিকবাবু জেনেছিলেন আইভি নামের একটি বিশেষ প্রজাতির লতানে গাছের কথা। ইংল্যান্ডের রাজপ্রাসাদেও এই গাছ ব্যবহারের চল ছিল। নেপালের বেশ কিছু হোটেলেও ব্রিটিশ আইভি-র ব্যবহার নিজে দেখে এসেছিলেন কৌশিকবাবু৷ ২০১৬ সালে উড়িষ্যার কটক থেকে খোঁজ করে নিয়ে আসেন এই গাছের চারা।

তবে প্রতিবন্ধকতা ছিলই। কারণ বাড়ির দেওয়ালে এই গাছ বেড়ে উঠলেও গাছের মূল রোপণ করতে হয় মাটিতে। কিন্তু শহরের বুকের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা সেই বাড়ির তিনদিকের জায়গাই কংক্রিটে বাঁধানো। একদিকের দেয়ালের পাশে যেটুকু ফাঁকা জায়গা সেইটুকুতেই বসানো গেল গাছ। তবে ধীরে ধীরে বাকি দেওয়ালেও নিজেই জায়গা করে নিল আইভি। “এখন তিনদিকের দেওয়ালেই ছড়িয়েছে এই গাছ। একটা দেওয়ালই শুধু বাকি...”, জানালেন কৌশিকবাবু।

কিন্তু বাড়ির দেওয়ালে গাছ গজিয়ে উঠলে দেওয়াল ফাটিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা তো থেকেই যায়। কিন্তু তারপরেও কীভাবে দিব্যি এই সহাবস্থান? কৌশিকবাবু সামনে আনলেন এর একদম উল্টোচিত্র। “এই গাছের শিকড় মূলত আলোয় থাকে। দেয়ালের মধ্যে গর্ত, খাঁজ বা অন্ধকার দেখলে প্রবেশ করে না। শুধু দেওয়ালের ওপরে একটা আলাদা লেয়ার তৈরি করে। বরং দেওয়ালে জল জমতে দেয় না। শুষে নেয়। এই বাড়ি তৈরি হয় আশির দশকে। ফলে পুরনো হওয়ায় ড্যাম্পিং-এর সমস্যা তো ছিলই। আইভি লাগানোর পর, এই গাছ সেই স্যাঁতস্যাঁতে ভাবটাকেই কাটিয়ে তুলেছে প্রচুর জল শোষণ করে। এমনকি গ্রীষ্মকালে ছাদে এর জন্য বাড়তি জলও ঢালতে হয়।”

আরও পড়ুন
ইরফানের সমাধি ঘিরে বেড়ে উঠছে সবুজ, দেখে এলেন সহ-অভিনেতা

এখানেই শেষ নয়, আইভি গাছের হাজার হাজার পাতা থাকায় প্রচুর পরিমাণ অক্সিজেন ছাড়ে এই গাছ। শোষণ করে কার্বনকে। ফলে দূষণ নিয়ন্ত্রণে এর থেকে ভালো সমাধান আর কীই বা হতে পারে? “আর বাড়িকে যথেষ্ট ঠান্ডা রাখে আইভি। তাপদাহের থেকেও সুরক্ষা প্রদান করে এটি। আর দেওয়ালকেও রক্ষা করে।”

আরও পড়ুন
পৃথিবীর বৃহত্তম আস্তাকুঁড় এখন সবুজে মোড়া পার্ক

পরিবেশদূষণ, বৃক্ষচ্ছেদন নিয়ে এইভাবেই সাধারণ মানুষকে বার্তা দিয়ে যাচ্ছেন স্যান্ড আর্টিস্ট কৌশিক। নীরবেই। তাঁর এই উদ্যোগে উদ্বুদ্ধ হয়ে বহু মানুষ চারা রোপণ করছেন এই গাছের। অনেকেই খোঁজ নিয়ে যাচ্ছে তাঁর কাছ থেকেই। কলকাতার বুকে ছড়িয়ে পড়ছে এই গাছ। “রাষ্ট্রপতি ভবনের একটি ডিপার্টমেন্ট আছে যারা গাছ নিয়ে কাজ করে। ওখান থেকেও চিঠি পাঠিয়েছিল ছবি চেয়ে”, জানালেন স্যান্ড আর্টিস্ট কৌশিক।

আরও পড়ুন
বাড়ির বাগানে ২০০ উদ্ভিদের পরিচর্যা, লকডাউনে সবুজ পৃথিবীর পাঠ দিচ্ছেন হায়দ্রাবাদের শিক্ষক

বেশ কিছুদিন আগেই এক সমীক্ষায় আন্তর্জাতিক এক সংস্থা জানিয়েছিল গাছের উপস্থিতি রীতিমতো প্রভাব ফেলে মানুষের মননে। এমনকি শিশুদের মস্তিস্কের বিকাশকেও ত্বরান্বিত করে গাছের উপস্থিতি। অনেকটা এমন কথাই যেন প্রতিফলিত হল কৌশিকবাবুর মুখেও। স্বীকার করলেন, “এই গাছ লাগানোর পরে একটা অন্যরকম পজিটিভিটি পেয়েছি আমি। কাজই হোক, কিংবা ফিনান্স ২০১৬ সালের পর থেকে অনেকটাই পালটে গেছে আমার জীবনে। গাছ লাগানোর একটা থেরাপিই বলতে পারেন এটাকে...”

তবে গাছের দ্রুত বৃদ্ধির কারণে মাঝেমাঝেই ছাঁটাই করতে হয় পাতা। অন্যদিকে এই গাছের জন্য পোকাও হয়। তার জন্য স্প্রে করার দরকার পড়ে মাঝে মধ্যেই। সেই কাজই কৌশিকবাবুর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন ওঁর স্ত্রী, পুত্র। আর সেইসঙ্গে এই পোকামাকড় খেতেই প্রতিদিন তাঁর বাড়িতে হাজির হয় অনেক অনেক পাখি। তারাও যেন হাত লাগিয়েছে কৌশিকবাবুর সঙ্গেই এই সজীবতাকে বাঁচিয়ে রাখার কর্মযজ্ঞে। আর সব মিলিয়েই এই কংক্রিটের জঙ্গলের মাঝে স্যান্ড আর্টিস্ট কৌশিকের বাড়ি হয়ে উঠেছে একটা ছোট্ট বায়োস্ফিয়ার...

Powered by Froala Editor