শব্দ বানাবার ছড়া বা ধ্বনির অনুবাদে ভাবের লেনাদেনা

মানিকলমকারি - ৩৫
আগের পর্বে

‘যখন ছোট ছিলাম’ বইতে স্মৃতিকথার সঙ্গে গড়পারের বাড়ির পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা লিখেছেন সত্যজিৎ রায়। তেমনই তাঁর লেখা বেশ কিছু গল্পেও বাড়ি হয়ে উঠেছে মূল বিষয়বস্তু। ‘অনাথবাবুর ভয়’ গল্প দিয়ে সেই যাত্রা শুরু। এরপর ‘চিলেকোঠা’ ও ‘লোডশেডিং’ গল্পে সেই বাড়ির বর্ণনাই মুখ্য। পরিবর্তমান কলকাতার ফ্ল্যাটের গঠন না বুঝলে বোঝা যাবে না ‘লোডশেডিং’ গল্পের আতঙ্কের দিকটিই। ‘প্যালুড্রিন’ বড়ির বিজ্ঞাপন আঁকতে গিয়েও বারবার বাড়ির দৃশ্য এঁকেছেন সত্যজিৎ। আর সন্দেশের পাতায় সেই মজার ছবির ধাঁধা তো সকলেরই চেনা। খেলার নাম ‘ব-এর বাড়াবাড়ি’। একটা বাড়ির উঠোনের দৃশ্য আঁকা সেই খেলায়। আর তাই মিলে যায় সত্যজিৎ-বিজয়ার পাটনার বাড়ির সঙ্গে।

অনুবাদ মানে শব্দের অনুবাদ, বাক্যের অনুবাদ, ভাবের অনুবাদ। কিন্তু সত্যজিতের লুইস ক্যারল অনুবাদ যেন এই সবের থেকেও বেশি হল ধ্বনির অনুবাদ। ধ্বনি মানে সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্র যাকে ধ্বনি বা সাজেশন বলে, তার কথা বলছি না, বলছি ধ্বনি মানে সাউন্ডের অনুবাদ। শব্দের একটা অনুভূতিকে ভাষার ভেতর গ্রহণ করে নেবো, কিন্তু তার চেয়েও বেশি যে কথাটা সত্যি তা হল, সেই শব্দ যে ধ্বনিগুলো থেকে তৈরি হল, যদি সেই সেই ধ্বনিগুলোকেই আরেক ভাষার নিজস্ব ধ্বনি দিয়ে বলে নেওয়া যায়! এটা সত্যজিতের অনুবাদের একটা আশ্চর্য নিজস্ব পদ্ধতি। কবিতার ভাব আসবে, কবিতার মানে আসবে, কিন্তু এক আজব তরিকার জাদুবলে মূল ভাষার ধ্বনিটাকেও যদি আত্মসাৎ করা যায়। তাহলে তো সোনায় সোহাগা। তাঁর অনুবাদের অনেকগুলো পথ-পদ্ধতি আছে, এটা তার ভেতর একটা। 

কবিতার নাম 'Jabberwocky'। আগে দেখা যাক কবিতাটির বিষয় আশয়। তারপর দেখা যাবে, তা থেকে শব্দ বানাবার ইশকুলটা কেমন। মোট সাতটা স্তবকে বাঁধা এই ছড়ার গল্পটা এরকম, জবরখাকি নামে এক ভয়ংকর প্রাণীকে তলোয়ার দিয়ে মেরে ফিরল এক বালক। তার যাওয়ার সময় তার বাড়িতে সকলে তাকে নিষেধ করল আর জবরখাকিকে মেরে কাঁধে তার মুণ্ডু নিয়ে দেশে ফেরার পর, সেই বীর বাছাধনকে জড়িয়ে ধরল তার বাপ। ব্যস। গপপো বলতে এইটুকুই। কিন্তু এই গপপো বলার ভাষাখানা কী অদ্ভুতুড়ে। চেনা ইংরাজিতে যায় না সেটা বোঝা, কিন্তু যদি শব্দের সঙ্গে সাউন্ড জুড়ে বোঝার চেষ্টা করেন, তাহলে এক্কেবারে সোজা আর সহজ! মানে সাহেবি 'Jabberwocky'-র মূল মানে টীকাতে ছিল, "the fruit of much excited discussion" । কিন্তু সে দূরে থাকার মতো কথা। এর অনুবাদ বাংলাতে সত্যজিৎ করলেন, জবরখাকি!! আর কবিতার ভাষা ? সেখানে যা ছিল: "'Twas brillig, and the slithy toves/ Did gyre and gimble in the wabe:/ All mimsy were the borogoves,/And the mome raths outgrabe." সেটাই বাংলাতে হল, ধ্বনির অনুবাদ। 'brillig' হল 'বিল্লিগি', 'slithy toves' হল 'শিঁথলে টোবে', "gyre and gimble" হল "গালুমগিরি", "mimsy" হল "মিমসে", "borogoves" হল গিয়ে "বোরোগোবে" আর "mome raths" হল কিনা "মোমতারা" আর "outgrabe" হল "গেবগেবিয়ে মারা"! এইবার এই নতুন নতুন বাংলা শব্দের সমাহার করে যে বাক্য তৈরি হল, সেটা কেমন? সেটা হল,

বিল্লিগি আর শিঁথলে যত টোবে
গালুমগিরি করছে ভেউ-এর ধারে
আর যত সব মিমসে বোরোগোবে
মোমতারাদের গেবগেবিয়ে মারে।

ছবি কিন্তু স্পষ্ট। এক ভয়ংকর জানোয়ারের সাংঘাতিক সব কীর্তিকাহিনি। ভেউয়ের ধারে যত বিল্লিগি আর শিঁথলেরা গালুমগিরি করে বেড়াত, আর মোমতারাদের-ও গেবগেবিয়ে মারছে সে এক জানোয়ার। এই মোমতারা-রা কেমন? তারা হল মিমসে বোরোগোবে। সিনট্যাক্স বা বাক্যবন্ধ তৈরি হল, কিন্তু আলাদা করে কোনো শব্দের মানে তোমার অভিধানে নেই। শুধু ধ্বনির সাহচর্যে বাক্য তৈরি হয় তাহলে। আমরা যে এতদিন জানতাম, শব্দের নির্দিষ্ট অর্থ না থাকলে বাক্য তৈরি করা যায় না, সে কথার কী হবে তাহলে!

আরও পড়ুন
গল্পের ঘরবাড়ি

ঠিক এইভাবেই “Beware the Jabberwock, my son!" হল, "যাসনি বাছা জবরখাকির কাছে"। আর না যাওয়ার কারণ মূলে ছিল: "The jaws that bite, the claws that catch!" আর এর বাংলা করতে গিয়ে চমৎকার একটা রামায়ণী প্রসঙ্গ বাংলা শব্দ থেকে বুনে দিলেন কথাশিল্পী সত্যজিৎ। করলেন, "রামখিঁচুনি রাবণ-কামড় তার"। রাম আর রাবণ শব্দ দুটো বিশেষ্য হলেও তাকে বিশেষণ বানিয়ে কী খেলাই না খেললেন! এরপরেই আবার নতুন শব্দ বানাবার খেলা। ইংরাজি "Jubjub bird" হল "জুবজু" আর আরো অদ্ভুত ইংরাজি "The frumious Bandersnatch” বাংলাতে হল "বাঁদরছ্যাঁচা মুখ"। ক্যারলের কবিতার টীকা করে বলা হয়েছিল: frumious হল গিয়ে "combination of "fuming" and "furious"। মানে সোজা কথায় violently angry! এই প্রচণ্ড রাগ বাংলাতে হল ভারমুখো। 

জবরখাকির অলংকরণ।

 

আরও পড়ুন
অসমাপ্ত ফেলুদার রহস্য

আর তাকে বধ করার জন্য ক্যারল হাতে দিলেন ভর্পাল শোর্ড। আরেকটা তাঁর বানানো শব্দ। অভিধানে নয়, ধ্বনিতেই যার মানে। বাংলাতে তা হল "ভুরপি তলোয়ার"। আরো মজার বাংলা হল "manxome"-এর। এটি হল কিনা "মাংসুমি দুশমন"। ভয়ংকর মাংসপ্রিয় মাংশাসীর এক নয়া শব্দ পেলাম আমরা মাংসুমি!! আর মূল কবিতার "So rested he by the Tumtum tree" বাংলাতে হল: "থামল গিয়ে টামটা গাছের বনে"। সেই ধ্বনি অনুবাদ করে ভাবের লেনাদেনা। 

এমন কত সব আজব শব্দমালা। "ঘুলচি বনে চুল্লি চোখের ভাঁটা" আর "হিলফিলিয়ে মস্ত করে হাঁ-টা"। সেইভাবে আবার তরবারি চালানোর স্নিকার- স্ন্যাক অনুবাদে হল, "সন সন সন চলল তরবারি।/ সানিক সিনিক। জবরখাকি শেষ"। স্নিকার স্ন্যাককে সানিক সিনিক বসালেই যে ফিনফিনে তলোয়ার বাতাসে চলার শব্দ শোনা যায়, সে কে আর শুনিয়েছিলেন? 

আরও পড়ুন
শঙ্কু আর গুপি-বাঘার গল্প

এবার কান পেতে শোনার মতো আরেকটি শব্দ। মূলে ছিল জবরখাকিকে বধ করে তার মাথা কেটে কীভাবে নিয়ে গেল বীরপুরুষ? ক্যারল বসিয়েছিলেন, He went galumphing back। 

টীকাতে শুনতে পেলাম, galumphing -এর মানে হল: combination of "gallop" and "triumphant"; to march on exultantly with irregular bounding movements। বাংলাতে একে কীভাবে অনুবাদ করা যাবে? গাল ফুলিয়ে হাঁটা আছে, আবার দম্ভ ভরে হাঁটাও আছে। কিন্তু দম্ভ ভরে গাল ফুলিয়ে হাঁটাকে যে গালুম্ফিয়ে বলা যায়, সেটা অভিনব। নতুন নতুন ক্রিয়াপদের জন্ম হচ্ছে ছড়ার দুনিয়াতে। 

আরও পড়ুন
কলমকারিতে শব্দ শোনা

মূল কবিতায় বাবা বীর বাছাকে বলেছিল, "O frabjous day! Callooh! Callay!” কে ভাবতে পারে ওই "Callooh! Callay” সত্যজিতের হাতে হল "আয় বাছাধন, আয় রে আমার কেলো"! 

সত্যজিতের লেখার পত্রিকাপাঠ আর চূড়ান্ত পাঠ নিয়ে আমরা সেভাবে ভাবি না। ভাবলে দেখতাম, ছড়া লিখে কেমন থাকে আবার পরিমার্জনা করেছেন তিনি। যেমন এই কবিতাতেই।

এই ছড়ার সন্দেশ-এর পাঠ ছিল এই রকম:

বিল্লিগি আর শিঁথলে যত টোবে
গালুমগিরি করছে ভেউ-এর পরে
মিমসে মেরে যাচ্ছে বোরোগোবে
মোমতারা সব গড়বড়িয়ে মরে।

১৯৬১-র পাঠটি সত্যজিৎ পরিবর্তন করলেন ১৯৮৬ সালে। তখন বেরোবে সত্যজিতের একমাত্র ছড়ার বই "'তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম"। সেই গ্রন্থপাঠে দেখা গেল এটি বদলে হল: 

বিল্লিগি আর শিঁথলে যত টোবে
গালুমগিরি করছে ভেউ-এর ধারে
আর যত সব মিমসে বোরোগোবে
মোমতারাদের গেবগেবিয়ে মারে।

লক্ষ করার মতো, ভেউয়ের পরে গালুমগিরি করা মানে, আগে গালুমগিরি করত ভেউ, এখন তারপরে গালুমগিরি করে বিল্লিগিরা। পরের পাঠে ভেউয়ের ধারে বলতে মনে হয়, ঢেউ যেন কোনো একটা জায়গা, তার ধারে, সেই অঞ্চলে গালুমগিরি করে বিল্লিগিরা। 

আরেকটা ব্যাপার। আগের পাঠে মোমতারা সব গড়বড়িয়ে মরে বলাতে তাদের মরাটা স্বাভাবিক ছিল। পরে যেই সেটা গেবগেবিয়ে মারে বলা হল, অমনি ভয়ংকর হয়ে উঠল জবরখাকি। গড়বড়িয়ে মরাতে ওই চেনা গড়বড় শব্দ থাকায় একটু যে চেনা শব্দের ছিটেফোঁটা ছিল, সেটা একেবারে ঝুপ্পুস হয়ে গেল গেবগেবিয়ে ক্রিয়াপদে। 

এইবার সামনের কদিন মানিকলমকারিতে একটু ছড়াকার অনুবাদক মানিকবাবুর কথা শোনা যাক।

Powered by Froala Editor