সোনার কেল্লার সংলাপ

মানিকলমকারি - ৫১
আগের পর্বে

সত্যজিতের ছন্দের মকশো শুরু হয়েছিল ‘লিয়রিক লিমেরিক’ লেখার সময় থেকেই। আর সেই অনুশীলনকেই অসাধারণ দক্ষতায় কাযে লাগালেন ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে। প্রচলিত ছন্দের নিয়ম না মানলেও দর্শকদের বুঝতে অসুবিধা হয় না প্রতিটা সংলাপের ছন্দবদ্ধ গতি। এমনকি তার তাল, লয় সবই নিখুঁত পরিমাপে সাজানো। সিনেমার সংলাপে এই ছন্দ মেলানোর কাজটা শুরু হয়েছিল কিন্তু ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ থেকেই। ভুতের রাজার বরে গুপির গানের গলা খুলে গিয়েছিল, কিন্তু তার গীতিকার সত্তাটা ছিল আগে থেকেই। এমনকি বাঘার সংলাপেও ছন্দের ব্যবহার চোখে পড়ে। তবে গুপির সংলাপ ধীর লয়ের, আর বাঘার সংলাপ দ্রুত লয়ের। শুধু পর্দাতেই নয়, হীরক রাজার সংলাপের ছন্দ কখন সংক্রমিত হয়ে যায় দর্শকদের মস্তিষ্কেও। অনুচ্চারিত একটি শব্দকেই সিনেমার সংলাপ হিসাবে আজও মনে রেখেছেন দর্শকরা।

সোনার কেল্লা ছবির সংলাপ বলতেই যে সংলাপগুলো সক্কল বাঙালির মাথায় হামলে পড়ে সেটা হল, জটায়ুর প্রথম ডায়লগ ‘তং মত করো, তং মত করো--- জায়দা হো গয়া’ কিংবা ফেলুদার বলা ‘ভবানন্দের চ্যালা এবার সাঙ্গ আপনার ভবের খেলা’ কিংবা সিধু জ্যাঠার সেই অসামান্য উচ্চারণ, ‘আমি অনেক কিছু করলেই অনেকেরই পসার থাকত না ফেলু, তাই আমি কিছুই করিনি’ এমনকি তোপসের বাবার বলা ‘ফেলুর মতো মাস্টার আছে কি সেই স্কুলে’। এইরকম সব সংলাপ বাঙালির মাথায় একেবারে বসে গেছে। যে কটাই বলব, মনে হবে, আরো কিছু বুঝি বাকি রয়ে গেল। কিন্তু সেইসব দুর্দান্ত সংলাপ নয়, আজ কথা ওই ছবির এমনি-এমনি বলা সব আটপৌরে কথাবার্তা নিয়ে।    

১৯৬৩ সালে সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্রের সংলাপ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছিলেন, ‘‘চিত্রনাট্য রচনার সময় সবচেয়ে বড়ো কথা বোধহয় এই যে, চিত্রনাট্যকার তাঁর নিজস্ব সত্তাকে সম্পূর্ণ বিলীন করে, তাঁর চরিত্রের অন্তরে প্রবেশ করে সেই চরিত্রের সত্তাটিকে সংলাপের দ্বারা ফুটিয়ে তুলবেন। আরেকটি জরুরি কথা মনে রাখা দরকার যে, চলচ্চিত্রে সময়ের দাম বড়ো বেশি। যত অল্প কথায় যত বেশি কথা বলা যায়, ততই ভালো, আর কথার পরিবর্তে যদি ইঙ্গিত ব্যবহার করা যায়, তবে তো কথাই নেই।’’ খুব খুঁটিয়ে দেখলে, কথা দুটি স্ববিরোধী। সংলাপ রচয়িতা নিজের সত্তাকে ‘সম্পূর্ণ’ ভাবে বিলীনই যদি করে দেবেন, তাহলে ওই সংলাপ রচনার সময়ে পরিমিতিবোধটা কে রক্ষা করবে? সেই পরিমিতিবোধের সীমা তো টানতে হবে সংলাপলেখককেই। একই সঙ্গে চরিত্রানুগতও হবে আবার তা কাজেরও হবে।

ছবির শুরুতে দেখি জাতিস্মর মুকুল রাতে ঘুম থেকে উঠে ছবি আঁকছে। তার ছবি আঁকার ক্রমটি কী রকম? লক্ষ করে দেখবেন, ও কিন্তু তার বাবাকে নিজের আঁকা ছবি দেখাবার সময় পিছন থেকে সামনে উল্টেছে তার আঁকার খাতা। সেই হিসেবে প্রথমে বলে ময়ূর, উট, তার বাড়ির সামনে সে দাঁড়িয়ে আছে, তার দেখা যুদ্ধের ছবি আর শেষে সোনার কেল্লা। এখানেই ছবির নাম দেখানো শুরু। তার মানে ও প্রথমেই এঁকেছে সোনার কেল্লার ছবি। তারপরে এঁকেছে যুদ্ধের ছবি, তারপরে বাড়ির সামনে দাঁড়াবার ছবি আর একেবারে শেষে উট আর ময়ূর। সেটাই তো স্বাভাবিক। সারাক্ষণ যে ছ বছরের শিশুর মনের মধ্যে সোনার কেল্লার কথা ঘুরছে সে তো প্রথমে সোনার কেল্লার ছবিই আঁকবে। শুধু ছবি আঁকার পাতাগুলো উল্টোদিকে ঘুরিয়ে বলায় ঘটনাটা বাস্তবও হল আবার নাটকীয়ও হল।

আরও পড়ুন
ছন্দের জাদুকর সত্যজিৎ

এরপরেই সেই সাংবাদিক আর চিত্রসাংবাদিকের দৃশ্য। সাংবাদিকের প্রশ্নগুলো আপাতত বেশ সোজা আর স্বাভাবিক প্রশ্ন। কিন্তু ওইটুকুর মধ্যেই যদি লক্ষ করা যায়, তাহলে ছোট্টো দৃশ্যে সাংবাদিকের মন আর তার জিজ্ঞাসার ধরন যেমন স্পষ্ট হবে, তেমনই স্পষ্ট হবে গল্পের গতিপথও। সাংবাদিকের অকারণ একটা কৌতূহল আর নিজের কল্পনাপ্রসূত একটা খবর-বানানো থেকেই কি না মুকুলের জীবনে এত বিপদের ঘনঘটা। মনে করে দেখবেন, ওই সাংবাদিকের কাছে কিন্তু মুকুল তার বাড়িতে কোনো লুকোনো গুপ্তধনের কথা আদৌ বলেইনি। তাদের কথোপকথনে শুনতে পাই, মাস দুই-তিন আগে থেকে মুকুল তার পূর্বজন্মের কথা বলতে শুরু করেছে আর বিশেষ বিশেষ সময়ে এক-একটা কথা মনে পড়ে তার। মজা হল, এই সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলাটা সেই বিশেষ একটি সময়। কারণ, সাংবাদিকের হাতের আংটিতে পাথর বসানো দেখে তার মনে পড়ে তাদের বাড়িতেও ছিল এই রকম পাথর। সে শুধু বলে, সে পাথর দেখেছে। তাদের বড়ো বাড়ি ছিল না, তাদের ছোটো বাড়ি ছিল, সেখানকার রাজা অন্য কেউ ছিল--- সবই কিন্তু একেবারে ঠিক-ঠিকই বলেছে মুকুল। তার এই মনে-পড়া থেকে সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল, সেইসব পাথর কোথায় রাখা ছিল? সেগুলো কি মাটির নীচে পোঁতা ছিল? ঠিক এখান থেকে আর কিছু মনে পড়ে না মুকুলের। এইবার মনে পড়বে নিশ্চয়ই, কোন কথার উত্তরে মুকুল সাংবাদিককে বলে যে, সে পাথর দেখেছে। তাকে ঠিক তার আগে ওই সাংবাদিক ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করেন, তোমার বাবা কি রাজা ছিলেন? মুকুল তখন জানায়, না তার বাবা রাজা ছিল না আর সে তার বাড়িতে পাথর দেখেছে। ঠিকই মনে পড়ছিল তার, সে তো ডাক্তার হেমাঙ্গ হাজরাকে জানাবে, তার বাবা ছিলেন সামান্য জেম-কাটার--- রত্নকার। তাই তাদের বাড়িতে দামি পাথর ছিল বটে, তবে তা কেটে গয়নাতে বসানোর জন্য। রাজস্থানের ওই পাথরের গহনার কারিগরের গল্প আমরা শুনতে চাই না--- আমাদের কাছে রাজস্থান মানে, রাজকাহিনি। ঔপনিবেশিক উচ্চম্মন্যতায় তৈরি হওয়া ভারতবোধ আমাদের ভেতরে যেকোনো একটা প্রদেশ বিষয়ে, যেকোনো একটি জাতিগোষ্ঠী সম্পর্কে যে একমাত্রিক ছবিটাকেই কতভাবে তৈরি করে, সাংবাদিকের এই মনে-হওয়া তার-ই একটা মোক্ষম নিদর্শন। জটায়ুর আর জটায়ুর প্রতিপক্ষের লেখা গল্পে করাল কুম্ভীর শুনে আমরা হাসি, সেটা যেমন ঠিক, তেমনটাই ঠিক, রত্নের কথা শুনলেই তা মাটিতে পোঁতা ছিল--- এই বিশ্বাসের প্রতি আস্থাও। গল্পখোর মানুষের কাছে, সেটাই আসলে গল্পের উপাদান। মুকুল যেমন পূর্বজন্মে বড়ো হয়নি, তেমনই আমাদের গল্পখোর মনটাও বড়ো হয় না--- সে ওই সাংবাদিকের মতোই গালগল্পে আস্থা রাখতে ভালোবাসে। তাই মুকুলের ছোট্টো কথাটার উপরে রং চড়িয়ে পরের দিন সংবাদপত্রে লেখা হয়, ‘এইসব মূল্যবান রত্ন মুকুলের বাড়িতেই কোনো গোপন স্থানে রক্ষিত ছিল’। তাহলে, এক কথা থেকে আপন মনের মাধুরী মিশায়ে সাংবাদিকদের গল্প-খাড়া করার গল্পও তো এই সোনার কেল্লা!       

আরও পড়ুন
ছন্দোশিল্পী সত্যজিৎ


আরও পড়ুন
হারানো এক কলমকারি- ২

এই ছবিতেই সংলাপগত কারিকুরির আরেকটি চমৎকার বিষয় হল টেলিপ্যাথি। এই শব্দটা নিয়ে এমন চমৎকার একটা খেলা আছে গোটা ছবিজুড়ে যে, তা আমাদের কখন যে বুঝভুম্বুল করে দেয়, সেটা আমরাই বুঝতে পারি না। সেটাও তো সংলাপেরই মজাদার ওয়ার্ডগেম। ভেবে দেখুন, ছবিটা যখন দেখতে শুরু করি আমরা, তখনও কিন্তু টেলিপ্যাথি যে ঠিক কী, তা তোপসের মতোই আমাদেরও আদৌ জানা নেই। ফেলুদা তাই তোপসেকেও বলে আর সেইসূত্রে আমাদেরও বলে দেয় ওই প্যারাসাইকোলজি সম্পর্কে আর এই টেলিপ্যাথি সম্পর্কে। ফেলুদার বলাটাকেই তোপসের মুখে আরেকবার ফিরিয়ে আনেন সত্যজিৎ। তোপসে বলে, সে নিশ্চিত যে ফেলুদা জাতিস্মর মুকুলের কেসটা হাতে নেবেই। কী করে এমন নিশ্চিত হল তোপসে, ফেলুর প্রশ্নের উত্তরে তোপসে বলে, টেলিপ্যাথি। এই দ্বিতীয়বার। এরপরে, নকল হাজরার সঙ্গে কথার সূত্রে টেলিপ্যাথির কথা আরেকবার শুনি আমরা। বেশ ক-বার নানা প্রসঙ্গে শুনতে শুনতে আমাদের কানে বেশে সড়গড় হয়ে গেল একটা নতুন শব্দ ‘টেলিপ্যাথি’। এরপরে, তাই রাজস্থানের পুলিশফাঁড়িতে যখন পুলিশের বড়োবাবুকে আসল ডাক্তার হাজরা জিগেস করেন, তিনি টেলিপ্যাথি কী জানেন কি না, আর তার উত্তরে বড়োবাবু বলেন, ‘নো স্যর, টেলিফোন ইয়েস, টেলিগ্রাফ ইয়েস, টেলিস্কোপ ইয়েস, টেলিপ্রিন্টার ইয়েস বাট নো টেলিপ্যাথি।’ দর্শক আসনে বসে আমরা সেই বড়োবাবুর না-জানা নিয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ি আমরা টেলিপ্যাথি বিষয়টা জানি ভেবে! মনে রাখি না, এই ছবিটা দেখার মুহূর্তেও সেটা আমার জানা ছিল না! একেই বলে সংলাপ! দর্শককে মজিয়ে নিয়ে, তাকে তার ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়ে, তাকে কনফিডেন্সে এনে সেই শব্দ দিয়েই মজা তৈরি করা। এ এক অনন্য সাধারণ শিক্ষণীয় টেকনিক বটে।

আরও পড়ুন
হারানো এক কলমকারি- ১

একটি শব্দ নিয়ে আরো একটা ছোট্টো মজা গাঁথা রয়েছে ফেলুদা অ্যান্ড কোম্পানির গাড়ি চড়ে রাজস্থানের দুর্ধর্ষ্ দুশমনকে ধাওয়া করার দৃশ্যে। দ্বিতীয়বার ফেলুদাদের গাড়ির টায়ার পাঁচার হয়ে যাওয়ার আগে, মন্দার বোস বলেছিল, তাদের পথে বসাবার কথা। বাংলায় প্রচলিত ‘পথে বসানো’ শব্দবন্ধটা যে আক্ষরিকভাবেই সত্যি করে তুলবে সে, সেটা সে জানতো আর তার কীর্তিকলাপ দেখে আমরা জানলাম। এর ঠিক পরেই, রাস্তায় অত কাচ ছড়িয়ে থাকতে দেখে লালমোহনবাবু কিঞ্চিৎ উষ্ণ হয়ে বলেন, ‘কীর্তিটা কার কিছু বুঝতে পারলেন? সারা পৃথিবীর যত রকমের কাচ এখানে এনে জড়ো করেছে।’ লালমোহনবাবুর এই কথাতে ফেলুদা যে কথা বলে, তা হঠাৎ শুনলে বোঝা যায় না ফেলুদার সেই কথা বলার তাৎপর্য। এমনকি ছবিতে কোথাও এতটুকু ব্যাখ্যাও করা নেই তা। আর সেই ব্যাখ্যা না-করাতেই সংলাপের মজা ছবির দর্শকের কাছে বহুগুণ হয়ে যায়। ফেলুদা শুধু বলে, ‘তাহলেই বুঝুন কীর্তিটা কার?’ কেন বলে ফেলুদা এই কথা! চকিতে বোঝা যায়, আরে মন্দার বোস তো নিজেকে পরিচিত করেছিল গ্লোব ট্রটার বা ভূপর্যটক হিসেবে। তাই জটায়ুর কথার ‘পৃথিবীর যত রকমের কাচ’ তো তার পক্ষেই জড়ো করা সম্ভব। কী অসামান্য সূক্ষ্ম সরস উক্তি, একই সঙ্গে মজার আর শাণিত সংলাপ।

কী যে হল এরপরে আমাদের ছবির। ক্রমশ এইসব সূক্ষ্মতা হারিয়ে ছবিতে ভালো সংলাপ মানে ক্রমশ হয়ে গেল চোখা চোখা কথা! আর কাণ্ড দেখুন, সেই চোখা চোখা সংলাপ সম্পর্কেও ফেলুদার মুখে সত্যজিৎ বলেছিলেন তাঁর ভাবনার কথা। বোম্বাইয়ের ডিরেক্টর পুলক ঘোষালের হাতে জটায়ুর উপন্যাস ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’ থেকে যে ছবি তৈরি হবে, তার ‘হিন্দি সংলাপ লিখেছেন ত্রিভুবন গুপ্তে, যার এক একটা কথা নাকি এক-একটা ধারালো চাক্কু, সোজা গিয়ে দর্শকের বুকে বিঁধে হলে পায়রা উড়িয়ে দেয়।’ সংলাপ নিয়ে সত্যজিতের মজাদার এই সংলাপের পুরো আনন্দময় উপলব্ধিটি হারিয়ে গেছে কলকাতা থেকে ছাদ-সংস্কৃতি ভ্যানিশ হয়ে গিয়ে আর ছাদে হাততালি দিয়ে পায়রা ওড়ানো নিয়ে ছেলেছোকরাদের হুল্লোড় উধাও হয়ে গিয়ে! এখানেই বোধহয় শব্দের সত্যিকারের আরেক-ফের্তা মজা। তাই না?

Powered by Froala Editor