হিন্দুস্তান সোস্যালিস্ট রিপাব্লিকান অ্যাসোসিয়েশন

‘কালাপানি আন্দামান’— ৩১
আগের পর্বে

একদিকে গান্ধীজি যখন জেলে তখন ভাঙন ধরল কংগ্রেসের মধ্যে। চিত্তরঞ্জন দাশ, মতিলাল নেহরু প্রমুখ পরিবর্তনকামীরা লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে ফিরে যাওয়ার পক্ষে তৈরি করলেন পৃথক দল স্বরাজ্য পার্টি। ১৯২৩-এর সেন্ট্রাল অ্যাসেম্বলিতে আসে সংখ্যাগরিষ্ঠতাও। তবে অন্যদিকে অসহযোগ আন্দোলনের আড়ালে নতুন করে প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছিলেন বিপ্লবীরা। বাড়ি বাড়ি তাঁরা লিফলেটের মাধ্যমে পৌঁছে দিতে থাকেন বিপ্লবীদের শহিদ গাথা। বেরতে শুরু করে বিপ্লবীদের আত্মজীবনীও। যা ব্যাপক সাড়া ফেলে তৎকালীন সমাজে। সংগঠিত হয় তরুণরা। বাংলার বুকে ঘটতে থাকে একের পর এক ডাকাতি, ডাকঘর লুঠ। পুলিশ ইন্সপেক্টরকে লক্ষ্য করে বোমাও ছোঁড়া হয় কলকাতায়। ততদিনে রাউলাট আইন প্রত্যহার করেলেও, পুনরায় বাংলার জন্য বিশেষ দমননীতি গ্রহণ করে সরকার। তারপর…

৪ সেপ্টেম্বর, ১৯২০, কলকাতায় কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে লালা রাজপত রাইয়ের সভাপতিত্বে গান্ধীজি প্রস্তাব রাখলেন, যদি সবাই তাঁর ‘অহিংস এবং অসহযোগিতার পথ’ গ্রহণ করতে সম্মত হন তাহলে তিনি কথা দিচ্ছেন যে এক বছরের মধ্যেই তিনি ‘স্বরাজ’ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবেন।  গান্ধীজি বিপুল জনজাগরণকে কেন্দ্র করে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করলেন। কিন্তু ‘চৌরিচৌরা’র ঘটনাকে অজুহাত করে এই ব্যাপক আন্দোলন যা ব্রিটিশ রাজত্বকে টলিয়ে দিতে সক্ষম হয়ে উঠছিল, ১২-ই ফেব্রুয়ারি, ১৯২২-এ তা প্রত্যাহার করে নিলেন।

অক্টোবর ১৯২৪। একবছর আগে কানপুরে আন্দামান ফেরত শচীন্দ্রনাথ সান্যাল এবং যোগেশচন্দ্র চ্যাটার্জী গঠন করলেন ‘হিন্দুস্তান রিপাব্লিকান অ্যাসোসিয়েশন’ (এইচআরএ)। সাজাহানপুরের রামপ্রসাদ বিসমিল, আসফাকউল্লা, রাজেন্দ্র লাহিড়ী, চন্দ্রশেখর আজাদ, মন্মথনাথ গুপ্ত এবং আরও অনেকে যোগ দিলেন এই নবগঠিত সংগঠনে। বিজয়কুমার সিংহ এবং ভগৎ সিংও যোগ দিলেন এই সংগঠনে। জানুয়ারি, ১৯২৫-এ এইচআরএ’র সংবিধান রচিত হল। এর পরেই ‘Revolutionary’ নামে একটি প্যামপ্লেট বিলি করে তাতে ‘সন্ত্রাসবাদ’ ও ‘নৈরাজ্যবাদ’এর সঙ্গে ‘বিপ্লব’-এর তুলনা করা হল।

ইতিমধ্যে রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লবের ইতিহাস ভগৎকে অনুপ্রাণিত করেছে। ভগৎ ধীরে ধীরে মার্কসবাদে দীক্ষিত হচ্ছেন। তিনি মার্কসকে গুরু হিসাবে মানছেন। তিনি বই পড়ে জানছেন যে সামাজিক আসাম্য সৃষ্টি মানুষের অবদান এবং এক শ্রেণির মানুষ তাকে চিরস্থায়ী করে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। শ্রেণিচেতনা তাঁর মধ্যে জারিত হচ্ছে। জমিদার শ্রেণির সন্তান হয়েও এখন তিনি উপলব্ধি করছেন যে ভারতের জন্য স্বাধীনতার যুদ্ধ মানে শুধু ব্রিটিশদের হাত থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরিত করা নয়, স্বাধীনতার লড়াই মূলত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সংগ্রাম। তাঁর অগাধ বিশ্বাস ছিল যে গরিবি দূর না করে শুধুমাত্র স্বাধীনতা পাওয়ার অর্থ হল শুধু নামেই স্বাধীনতা যা আপামর জনসাধারণের কোনো উপকারে আসবে না।   তিনি প্রশ্ন তুলছেন, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া কীভাবে রাজনৈতিক স্বাধীনতা সফল হতে পারে? স্বাধীনতার কী অর্থ যদি গরিব মানুষ গরিবই থেকে যায়? তিনি ভাবছেন, কীভাবে এই গরিব ও বড়লোকের মধ্যে অসাম্য দূর করা যায়? দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের শিক্ষাকে তিনি করায়ত্ত করছেন। রাজনৈতিক তত্ত্বকে তিনি আর প্রাথমিক বলে মনে করছেন না, এগুলি যে আসলে রাজনীতির পশ্চাদবর্তী ঘটনার  ফল, তা মানতে শিখছেন। মার্কসের কাছ থেকে তিনি শিখছেন রাজনৈতিক প্রক্রিয়া মুল কারণ নয়, অর্থনৈতিক শক্তিই হল এর মূল উৎস।

ভগৎ সিং  বিশ্বাস করতেন, যদি ব্রিটিশ শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তি ঘটে শুধুমাত্র ক্ষমতার হাতবদল হয় তাহলে দেশের মানুষের ভাগ্য বিড়ম্বনা একই থেকে যাবে। ভারতের মান্ধাতা আমলের ব্যবস্থা, যা অলঙ্ঘ্য প্রাচীরের মতো উন্নয়নের বাধাস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তা যদি ভেঙে ফেলা না যায় তাহলে দেশের কোনো উন্নতিই হবে না। এবং তা বদলাতে গেলে একটাই অস্ত্র, তা হল ‘বিপ্লব’।

আরও পড়ুন
স্বরাজ ভাবনার পুনরুত্থান

৯ আগস্ট, ১৯২৫। এইচআরএ সাহারানপুর-লক্ষ্ণৌ রেললাইনে অবস্থিত এক জনবিরল স্টেশন ‘কাকোরি’তে ৮-ডাউন ট্রেনে ডাকাতি সংগঠিত করে এবং সেই ট্রেন থেকে রেলের নগদ অর্থ লুঠ করে। এই ডাকাতি হয় পরিকল্পনামাফিক যাতে অংশ নেন রামপ্রসাদ বিসমিল, আসফাকউল্লা, রাজেন্দ্রনাথ লাহিড়ী, রোশন সিং, শচীন্দ্রনাথ সান্যাল, শচীন্দ্রনাথ বকসী, চন্দ্রশেখর আজাদ, মুকুন্দী লাল, মুরারী লাল, কুন্দন লাল, বনোয়ারী লাল, মন্মথনাথ গুপ্ত, যোগেশচন্দ্র চ্যাটার্জী এবং আরো অনেকে। ২৬ সেপ্টেম্বর এই ডাকাতির সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করা শুরু হয়। এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত প্রায় সমস্ত স্বদেশী বিপ্লবীদের ধরা হয় বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন তারিখে। মামলা শুরু হয়। যা ‘কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে পরিচিত। প্রাথমিক ভাবে ২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা শুরু হয় ৪ জানুয়ারি, ১৯২৬-এ সৈয়দ আইনুদ্দীনের এজলাসে। প্রথমে দু’জন  এবং পরে আরো দু’জন রাজসাক্ষী হতে চাইলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নেওয়া হয়। বাকিদের মামলা লক্ষ্ণৌ আদালতে স্পেশ্যাল সেশন জজ হ্যামিলটনের এজলাসে পাঠানো হয়। বেশ কিছুদিন পর আসফাকউল্লা খান এবং শচীন্দ্রনাথ বকসী ধরা পড়েন এবং তাঁদেরও মামলায় আসামি করা হয়।  

আরও পড়ুন
অসহযোগ এবং খিলাফত আন্দোলন

৬ এপ্রিল, ১৯২৭ মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। সারা আদালত কক্ষ তখন ভেসে যাচ্ছে বিসমিল এবং তাঁর সঙ্গীসাথীদের উচ্চকিত আবৃত্তিতে মৌলনা হসরত মোহনের গজলে –

আরও পড়ুন
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড – রবীন্দ্রনাথ এবং গান্ধীজি

সার্ফরোশি কি তামান্না আব হামার দিল মে হ্যায়,
দেখনা হ্যায় জোর কিতনা বাজুয়ে কাতিল মে হ্যায়।।

আরও পড়ুন
জাতীয়তাবাদের উত্থান

সারা আদালত চত্বর কেঁপে কেঁপে উঠছে ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনিতে। সেদিন আদালতের রায়ে রামপ্রসাদ বিসমিল, ঠাকুর রোশন সিং, আসফাকউল্লা এবং রাজেন্দ্রনাথ লাহিড়ীর ফাঁসির আদেশ হল। মন্মথনাথ গুপ্ত নাবালক ছিলেন তাই ওনাকে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে চোদ্দ বছরের জন্য কারাবাসের সাজা দেওয়া হল। শচীন্দ্রনাথ সান্যালকে আন্দামান সেলুলার জেলে আজীবন কারাবাসে দণ্ডিত করা হল। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে উনিই একমাত্র বিপ্লবী যিনি দুবার আন্দামানে বন্দি ছিলেন। কাকোরি রেল ডাকাতির আগে লাহোর ও বেনারস ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হয়ে ১৯১৫ সালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে তাঁকে আন্দামানে সেলুলার জেলে পাঠানো হয়। সেখান থেকে তিনি মুক্তি পান ১৯২০ সালে। পরে কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলায় দেশের জেলে কিছুদিন কারাদণ্ড ভোগ করার পরে পুনরায় ১৯৩২ সাল থেকে আবার যখন আন্দামানে রাজবন্দিদের পাঠানো শুরু হয় সেই সময় পুনরায় তাঁকে আন্দামানে প্রেরণ করা হয়।  শচীন্দ্রনাথ বকসী, গোবিন্দচন্দ্র কর, যোগেশচন্দ্র চ্যাটার্জী এবং মুকুন্দী লালের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড আর রাজকুমার সিংহ, সুরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, বিষ্ণুচরণ দুবলিশ এবং রামকিষেণ ক্ষেত্রীর দশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হল। ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল, প্রেমকৃষ্ণ শর্মার পাঁচ বছর, বনওয়ারীলাল, প্রণবেশকুমার চ্যাটার্জীর চার বছরের কারাদণ্ড হল।

১৯ ডিসেম্বর ১৯২৭। গোরক্ষপুর জেলের ফাঁসির মঞ্চে ফাঁসির দড়িকে চুম্বন করে শেষ বিদায় নিলেন রামপ্রসাদ বিসমিল, ফৈজাবাদ জেলের ফাঁসির দড়িতে শহিদ হলেন আসফাকউল্লা (ব্রিটিশ আমলে সিপাহি বিদ্রোহের পর আসফাকউল্লাই একমাত্র মুসলিম যাঁর ফাঁসি হয়েছিল), ঠাকুর রোশন সিং শহিদ  হলেন এলাহাবাদ জেলা জেলের ফাঁসির মঞ্চে। ১৭ ডিসেম্বর, ১৯২৭ – গোন্ডা জেলে ফাঁসি হল রাজেন্দ্রনাথ লাহিড়ীর। বাকিদের বিভিন্ন জেলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কারাদণ্ড ভোগ করতে পাঠানো হল। শচীন্দ্রনাথ সান্যালকে পাঠানো হল আন্দামান সেলুলার জেলে।

৮-৯ সেপ্টেম্বর, ১৯২৮ দিল্লিতে ফিরোজ শাহ কোটলা ময়দানে যুক্তপ্রদেশ, পাঞ্জাব, রাজপুতানা এবং বাংলার বিপ্লবীদের এক সভা হল। এই সভায় উপস্থিত ছিলেন বটুকেশ্বর দত্ত, বিজয়কুমার সিংহ, যতীন্দ্রনাথ দাস, যশপাল, চন্দ্রশেখর আজাদ, ভগবতীচরণ ভোরা, রাজগুরু, মহাবীর সিং এবং ভগৎ সিং। এই অধিবেশনেই দলের নাম পরিবর্তন করে ‘হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাব্লিকান অ্যাসোসিয়েশন’ (এইচআরএসএ) রাখা হল। এই সংগঠনের মূল লক্ষ্য হল সশস্ত্র  বিপ্লবের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে ‘ফেডারেল রিপাব্লিক অফ ইউনাইটেড স্টেটস অফ ইন্ডিয়া’ গঠন করা যেখানে সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটাধিকারের অধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সরকার নির্বাচিত হবে। চন্দ্রশেখর আজাদকে চিফ কম্যান্ডার করে এই দলের অংশ হিসাবে ‘হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাব্লিকান আর্মি’ নামে একটি সেনাবাহিনী গঠন করা হল। এই আলোচনাসভার সিদ্ধান্ত মতে পুলিশের হাত থেকে পরিচয় লুকানোর জন্য ভগৎ সিং ফিরোজপুরে গিয়ে এক চিকিৎসকের সাহায্য নিয়ে তাঁর চুল কেটে ফেললেন এবং গোঁফ দাড়ি সব কামিয়ে ফেললেন। (এই ঘটনার সাক্ষী ছিলেন ভগতের সঙ্গী, জয়গোপাল যিনি পরে বিশ্বাসঘাতকতা করে রাজসাক্ষী হলে, স্যন্ডার্স হত্যা মামলায় এই ঘটনাটির বিবরণী আদালতে পেশ করেন।)  

১৯২৭-এর অক্টোবরে স্যার জন আলসব্রুক সাইমন ভারতবর্ষে এলেন।  সাইমন কমিশনের কাজ ছিল সাংবিধানিক সংস্কার করে ভারতকে কতটা ক্ষমতা হস্তান্তর করা যেতে পারে তার পর্যালোচনা করে রিপোর্ট দেওয়া।  ব্রিটিশ কাউন্সিল অ্যাক্ট, ১৯১৯ (মন্টেগু-চেমসফোর্ড বা মন্টফোর্ড সংস্কার) মোতাবেক প্রতি দশ বছর অন্তর এই কাজ করা বাধ্যতামূলক ছিল। প্রথমদিকে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ব্রিটিশদের বিশ্বস্ত ছিলেন এবং নিজে মনে করতেন ব্রিটিশদের সঙ্গে  সহযোগিতার মাধ্যমে তাঁর অহিংস মন্ত্রের প্রয়োগে সামান্য হলেও ভারতীয়রা নিজেরাই নিজেদের শাসন করার অধিকার পাবে। তিনি মনে করতেন শুধুমাত্র স্বায়ত্ত্বশাসন পেলেই আপাতত চলবে কিন্তু কংগ্রেসের ভেতরেই তখন পূর্ণ স্বাধীনতার আওয়াজ উঠে গেছে। সাইমন কমিশনের ওপর বয়কট ইত্যাদির চাপ সৃষ্টি করেও পরে ৩১ ডিসেম্বর, ১৯২৯-এ অবশ্য স্বায়ত্ত্বশাসনের অধিকারটুকুও পাওয়া গেল না। 

৩০ অক্টোবর, ১৯২৮। সাইমন বোম্বে থেকে লাহোরে এলেন। ভগৎ সিং এবং তাঁর কমরেডরা স্বায়ত্ত্বশাসনের পক্ষে ছিলেন না, তাঁরা চেয়েছিলেন পূর্ণ স্বাধীনতা। তবু গান্ধীজির সাইমন কমিশন বয়কটের ডাকে তাঁরা সাড়া দিলেন।  কমিশনের ভারতে আগমনের বিরুদ্ধে লাহোর রেলস্টেশনের রাস্তায় এক বড়ো মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন লালা লাজপত রাই। ওইদিন, সাইমন কমিশনের সদস্যরা রেলস্টেশনের বাইরে আসার সঙ্গে সঙ্গে মিছিলে অংশগ্রহণকারী জনতা এগিয়ে আসে। মিছিলে থেকে শ্লোগান ওঠে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। (১৯২১-এ কংগ্রেস নেতা তথা ঊর্দু কবি, মৌলনা হসরত মোহানী  এই শব্দবন্ধটির জন্ম দিলেও এটিকে জনপ্রিয় করেন ভগৎ সিং।) ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ শ্লোগান উঠল। ভগৎ সিং এই শ্লোগান তুলে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে একটি নতুন শব্দবন্ধ যোগ করলেন, এক নতুন মাত্রা যুক্ত হল স্বাধীনতার লড়াইয়ে। এই শ্লোগান বিপ্লবের ডাক পাঠাল, বিদ্রোহের এক নতুন অর্থ দিল। মিছিল থেকে একইসাথে অবাধ্যতার ঢেউ উঠল, ‘সাইমন কমিশন গো ব্যাক’, ‘আংরেজ মুর্দাবাদ’। মিছিল সমবেত কণ্ঠে আওয়াজ তুলল –

হিন্দুস্তানি হ্যায় হাম, হিন্দুস্তান হামারা,
মুর যাও, সাইমন, যাঁহা হ্যায় দেশ তুমারা।

এই মিছিলের আগেও লালা লাজপত রাইয়ের সঙ্গে ভগৎ সিং অনেক মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন।  ভগৎ লালাজিকে তাঁর উগ্র হিন্দুপ্রীতির জন্য বিশেষ পছন্দ করতেন না। লাজপত রাইও তাঁকে ‘রাশিয়ার চর’ বলে নিন্দা করতেন। তাছাড়া লাজপত বিপ্লবীদের ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন যুবকের দল’ বলে মনে করতেন। লাজপত চাইতেন দুটি ভারতবর্ষ – হিন্দু ভারতবর্ষ এবং মুসলিম ভারতবর্ষ। ভগৎ সিং সম্পূর্ণ অর্থে নাস্তিক ছিলেন। লাজপত রাইয়ের এই মতবাদ কোনদিন তিনি মেনে নিতে পারেননি। ভগৎ সিং মনে করতেন দেশ স্বাধীন হলে দুই সম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের ফলেই তা হবে এবং এই দুই সম্প্রদায়ের সম্মিলিত চেষ্টায় জন্ম নেবে নতুন ভারতবর্ষ। মতের অমিল থাকলেও একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসাবে লালা লাজপত রাইকে তাঁর নিষ্ঠা ও দেশভক্তির জন্য অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন ভগৎ। 

লালা লাজপত রাইয়ের নেতৃত্বে প্রচুর মানুষ লাহোর রেলওয়ে স্টেশনের রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে শ্লোগান তুলছেন। বিশাল পুলিশবাহিনী মিছিল সরাতে চেষ্টা করছে। লাজপত রাই চিৎকার করে বললেন,  “সরকার যদি সাইমন কমিশনকে এই বিশাল বিরুদ্ধতার মিছিল দেখতে দিতে না চান তাহলে কমিশনের সদস্যদের চোখ বেঁধে সরকারি ভবনে নিয়ে যাওয়া হোক।” এরপর পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট, জে. এ. স্কটের আদেশে পুলিশ লাঠি চার্জ করলে লালা লাজপত মারাত্মকভাবে আহত হন এবং এই আঘাতের ফলে অসুস্থ হয়ে কিছুদিন পর তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন। এই ঘটনায় আগুনে যেন ঘি পড়ল।  সারা দেশে নিন্দার ঝড় বয়ে গেল। গান্ধী-নেহেরু – এঁরা দুজনে এই ঘটনার নিন্দা করে বিবৃতি দিলেও এর বেশি কিছু করার কথা ভাবলেন না। অনেক পরে ১৯৩০-এ লাহোরে যেখানে লালা লাজপত রাইকে মারা হয়েছিল তার অনতিদূরে রবি নদীর তীরে জওহরলাল নেহেরু কংগ্রেসের ত্রিবর্ণ পতাকা উত্তোলন করে লালাজির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পূর্ণ স্বরাজের দাবি তুললেন। গান্ধীজিও ততদিনে একটু একটু করে বুঝতে শুরু করেছেন যে ব্রিটিশরা কখোনই ভারতীয়দের হাতে কোনো ধরনের ক্ষমতা তুলে দেবে না।

Powered by Froala Editor