বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক

‘কালাপানি’ আন্দামান— ৩২
আগের পর্বে

অহিংসা এবং অসহযোগিতার পথে এক বছরের মধ্যে স্বরাজ প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন গান্ধীজি। কিন্তু চৌরিচৌরার ঘটনায় ১৯২২ সালে সেই আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন তিনি। এর বছর দুয়েক পরে কানপুরে আন্দামান ফেরত শচীন্দ্রনাথ সান্যাল এবং যোগেশচন্দ্র চ্যাটার্জী তৈরি করেন ‘হিন্দুস্তান রিপাব্লিকান অ্যাসোসিয়েশন’। যার সদস্য ছিলেন বিজয়কুমার সিংহ এবং ভগৎ সিং। স্বরাজ ফেরাতে সহিংস নীতিতেই ভরসা ছিল এইচআরএ-র। ১৯২৫ সালে কাকোরি রেলস্টেশনে বেশ কয়েকটি ডাকাতি চালানোর দায়ে গ্রেপ্তার হন বহু সদস্য। পুনরায় আন্দামানে পাঠানো হয় অনেককে। অন্যদিকে লালা লাজপত রাইয়ের মৃত্যুতে ব্রিটিশ শাসকদের স্বরাজ-প্রতিশ্রুতির প্রতি মোহভঙ্গ হয় গান্ধীজির। তারপর...

১৭ নভেম্বর, ১৯২৮ লালা লাজপত রাই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন।  মারা যাবার আগে তিনি ব্রিটিশ সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলে গেলেন, “এরপরে (লাহোরের ঘটনার পরে) যদি যুবসমাজ দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আক্রমণাত্মক কিছু করে বসে  আমি আশ্চর্য হব না।” অন্যদিকে কিন্তু বিপ্লবীরা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। শ্লোগান উঠল ‘খুন দা বদলা খুন’। কলকাতায় চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তী দেবী ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, “দেশের মানুষ এবং যুবকরা কি এখনো বেঁচে আছে? এই দেশের একজন মহিলা নাগরিক হিসাবে আমি পরিস্কার এই ঘটনার জবাব চাই।” ভগতের মনে পড়ে গেল জালিয়ানওয়ালাবাগের পৈশাচিক নরহত্যার ঘটনা।  ডায়ার সেই ঘটনা থেকে রেহাই পেয়েছিলেন কিন্তু স্কটের বেলায় তা হতে দেওয়া যায় না। বিপ্লবীরা লালা লাজপত রাইয়ের হত্যার প্রতিশোধ নেবার জন্য লাহোরের পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট স্কটকে মারার পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন।

১০ ডিসেম্বর, ১৯২৮। বিপ্লবী, ভগবতীচরণ ভোরার স্ত্রী, আরেক শ্রদ্ধেয় বিপ্লবী, দুর্গাদেবীর সভাপতিত্বে এইচএসআরএ’র একটি আলচোনাসভার আয়োজন হল। এই আলোচনাসভাতেই সিদ্ধান্ত হল স্কটকে দুনিয়া থেকে সরাতে হবে। লাজপত রাইয়ের প্রাণের দাম তাঁকে চোকাতেই হবে। ভগৎ সিং বাংলার উদাহরণ টেনে বললেন যে এই ধরনের বেশ কিছু ঘটনা ইতিমধ্যে বাংলার বিপ্লবীরা ঘটিয়েছেন এবং কিছু নিপীড়ক ব্রিটিশকে হত্যা করেছেন। আলোচনার শুরুতে  দুর্গাদেবী  আহ্বান জানালেন কে বা কারা স্কটকে হত্যা করতে চায়, তারা যেন হাত তোলে। এই কথা বলে তিনি নিজেই  প্রথমে হাত তুললেন। কিন্তু কমরেডরা কিছুতেই তাঁদের প্রিয় দুর্গাভাবীকে এই কাজ করতে দিতে রাজি নয়। আবার এই সময় তাঁর স্বামী, ভগবতীচরণও তখন লাহোরে উপস্থিত নেই, তিনি গেছেন কলকাতায় কংগ্রেস অধিবেশনে যোগ দিতে। একান্ত অনিচ্ছায় দুর্গাদেবী নিজের হাত নামালেন। ভগৎ সিং, সুকদেব, রাজগুরু, চন্দ্রশেখর আজাদ এবং ওই আলোচনাসভায় উপস্থিত অন্যান্য বিপ্লবীররা সকলেই এবার হাত তুললেন। ইতিমধ্যে সুকদেব দলের মধ্যে শুধু নয় সারা দেশে একজন দক্ষ সংগঠক হিসাবে পরিচিত হয়ে উঠেছেন। ফলে কেউই চাইলেন না এরকম একটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে সরাসরি সুকদেব জড়িত থাকুক। তিনি এরপর নিজেই ভগৎ সিং, রাজগুরু, চন্দ্রশেখর আজাদ এবং জয় গোপালকে বেছে নিলেন। এরপর পুরো পরিকল্পনা ছকে ফেলা হল। অপারেশন করবেন ভগৎ সিং, তাঁকে কভার দেবেন রাজগুরু, হত্যাকাণ্ড সারা হয়ে গেলে তাঁদের পালাবার ব্যবস্থার দায়িত্বে থাকবেন আজাদ এবং সর্বকনিষ্ঠ কমরেড, জয়গোপালের কাজ হবে পুলিশ স্টেশনে স্কট কখন আসবেন তার খবর এই তিনজনকে দেওয়া। ১৭ ডিসেম্বর, ১৯২৮ – লাজপত রাইয়ের মৃত্যুর ঠিক একমাস পূরণ হবে। ওই দিনটিকেই বেছে নেওয়া হল স্কট হত্যার জন্য। এই মর্মে ১৫ ডিসেম্বর এই চারজন হত্যাকাণ্ডের একটা মহড়াও দিয়ে নিলেন। ভগৎ সিং লাল কালিতে ‘SCOTT KILLED’ লিখে একটা পোস্টারও প্রস্তুত করে ফেললেন। তখন কি আর তিনি ভেবেছিলেন যে প্রথমত তাঁর গুলিতে স্কটের বদলে প্রাণ দিতে হবে স্যন্ডার্সকে এবং যার সাহায্য নিয়ে সেদিন তিনি এই পোস্টার লিখলেন, এইচএসআরএ’র কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সদস্য, হংসরাজ ভোরা, যিনি ওই পোস্টারটির চারখানা কপি বানালেন, তিনি বেইমানি করে লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় রাজসাক্ষী হবেন!

১৭ ডিসেম্বর, ১৯২৮। স্কট সেদিন ইংল্যান্ড থেকে আগত তাঁর শাশুড়ি-মাকে বাড়িতে নিয়ে আসবেন বলে ছুটি নিয়েছিলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার জয়গোপালের ওপর দায়িত্ব ছিল স্কটের আগমনবার্তা জানান দেবার, অথচ তিনি স্কটকে চিনতেন না এবং সেই কথা কাউকে জানাবার প্রয়োজনও বোধ করেননি। তিনি এই মহান কাজের দায়িত্ব পেয়ে এতটাই উত্তেজিত ছিলেন যে তিনি এই কথা বলে এই মহতি কাজ থেকে নিজেকে বিযুক্ত করতে চাননি। এই দায়িত্ব তাঁর ওপর অর্পিত হলেও তিনি তারপরেও স্কটকে চিনে রাখার প্রয়োজন বোধ করেননি। তার ফলে যা গোলমাল হবার তাই হল।   যথাসময় সহকারী পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট স্যন্ডার্সকে স্কট বলে ভুল করলেন জয়গোপাল। সকাল ১০-টায় খবর গেল যে স্কটসাহেব অফিসে ঢুকেছেন। পরিকল্পনামাফিক বিপ্লবীরা যথাযথ পজিশন নিলেন। দুপুরবেলা স্যন্ডার্স পুলিশ স্টেশন থেকে বেরোলেন। যখন তিনি তাঁর মটর সাইকেলে চড়তে যাবেন রাজগুরু তাঁর মসার পিস্তল থেকে গুলি চালালেন। ভগৎ সিং চিৎকার করে উঠলেন, “না, না  এই লোকটি সে নয়।” কিন্তু ততক্ষণে যা হবার তা হয়ে গেছে। রাজগুরুর এক গুলিতেই স্যন্ডার্স সাহেবের ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে গেছে। ভগৎ সিং অগত্যা তাঁর রিভলবার থেকে ওই মৃতদেহের ওপর আরো কিছু গুলি  উগরে দিলেন। এরপর তাঁরা পরিকল্পনামাফিক কাছেই ডিএভি কলেজে ঢুকে পড়লেন। এই গুলিগোলার আওয়াজ শুনে পুলিশ স্টেশন থেকে পুলিশ ইন্সপেক্টর ফার্ন বেরিয়ে এসেছিলেন কিন্তু আজাদের ছোঁড়া দুটি গুলি তার মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে যেতে তিনি দৌড়ে আবার অফিসের মধ্যে ঢুকে যান। হেড-কনস্টেবল ছানান সিং তাড়া করলেন ভগৎ সিং, রাজগুরু এবং আজাদকে। আজাদ বারেবারে চিৎকার করে তাকে ফিরে যেতে বললেন। বললেন, আমরা কোনো ভারতীয়কে মারতে চাই না। কিন্তু শেষে নিরুপায় হয়ে রাজগুরু গুলি চালালে সে মারা যায়। সেদিনের সেই দৃশ্যের সাক্ষী ছিলেন অনেকেই। ঊর্দু কবি এবং বিপ্লবী, ফৈয়জ আহমেদ ফৈয়জও ছিলেন সেদিনের ঘটনার সাক্ষী।

রাজগুরু, চন্দ্রশেখর আজাদ এবং ভগৎ সিং এই মিশন সম্পন্ন করে ডিএভি কলেজ প্রাঙ্গনে ঢুকে দেয়াল টপকে তাঁদের হস্টেলের কম্পাউন্ডে ঢুকে পড়লেন। এরপর তাঁরা যখন দেখলেন যে কেউ তাঁদের লক্ষ করছে না, তখন ধীরেসুস্থে হেঁটে তাঁরা হস্টেলের দিকে গেলেন। সেখানে আগে থেকেই আজাদ হস্টেলের টয়লেটের দেয়ালে তিনটি সাইকেল হেলান দিয়ে রাখা ছিল। এবার তাঁরা ধীরেসুস্থে খুব স্বাভাবিকভবে সাইকেল চালিয়ে লাহোরের মোজাং রোডের আস্তানায় ফিরে গেলেন। (মোজাং রোডের একটি ভাড়া করা বাড়িতে ছিল বিপ্লবীদের আস্তানা। এই বাড়িটির অবস্থান ছিল একটি কবরখানার পাশে, জায়গাটা নির্জন এবং পুলিশ ও সাধারণ মানুষের নজরের বাইরে, তাই বিপ্লবীরা এই আস্তানাটি নিরাপদ বলে বেছে নিয়েছিলেন।) পুলিশবাহিনী যখন ডিএভি কলেজের হোস্টেলে রোল কল করছে, হোস্টেল এবং কলেজ তছনছ করছে, শহরের নানা প্রান্তে ব্যাপকভাবে খানাতল্লাশি করছে, তখন মোজাং রোডের বাড়িতে বসে আছেন তিন বিপ্লবী। জয়গোপাল স্কটের আসার খবর দিয়েই বাড়ি ফিরে গেছে। তাঁরা তাঁকে এই ভুল খবরটা দেবার ফলে স্কটের বদলে যে স্যন্ডার্সকে মারা হল তার জন্য কিছু বলারও সুযোগ পেলেন না।

আরও পড়ুন
হিন্দুস্তান সোস্যালিস্ট রিপাব্লিকান অ্যাসোসিয়েশন

দুর্গাভাবী

 

আরও পড়ুন
স্বরাজ ভাবনার পুনরুত্থান

ভগৎ সিং আগে থেকে তৈরি করে রাখা পোস্টারগুলিতে তড়িঘড়ি স্কটের নামের ওপরেই কালি বুলিয়ে স্যন্ডার্স করে দিলেন। সারা লাহোর ‘হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাব্লিকান আর্মি’র কম্যান্ডার-ইন-চিফ, বলরাজের নামে পোস্টারে ছেয়ে গেল – ‘জে. পি. স্যন্ডার্স  মৃত – লালা লাজপত রাই হত্যার প্রতিশোধ’। এই পোস্টারের মুল কথা ছিল ‘খুন কা বদলা খুন’। অত্যাচারী শাসকদের এই প্রচারপত্রে সতর্ক করে বলা হল – দেশের নিপীড়িত মানুষকে অত্যাচার করলে এইভাবেই হাতেনাতে তার ফল পেতে হবে। ১৮ ডিসেম্বর, ১৯২৮-এর এই পোস্টারটি ‘বিল্পব দীর্ঘজীবী হোক’ বলে শেষ হয়েছে।

আরও পড়ুন
অসহযোগ এবং খিলাফত আন্দোলন

এখন তিন বিপ্লবী মোজাং রোডের বাড়িতে বসে ভাবতে লাগলেন কীভাবে লাহোর ছেড়ে পালানো যায়। এতদিন তাঁরা এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা নিয়ে এতটাই উত্তেজিত ছিলেন যে কেউই ভেবে দেখেননি এরপর কী হবে। কিন্তু লাহোর ছেড়ে যেভাবে হোক পালাতেই হবে। যখন তাঁরা পালানো নিয়ে চিন্তা করছেন, ঠিক সেইসময়ে সুকদেব এলেন। তিনি পরামর্শ দিলেন দুর্গাদেবীর বাড়িতে যেতে। যেই বাড়িতে দুর্গাদেবী থাকতেন, সেই বাড়ি রাত ১১-টা থেকে সকাল ৫টা পর্যন্ত পুলিশের নজরে থাকত। তাই ঠিক হল পরদিন সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে। পরদিন ভোররাতে তিনজন বেরিয়ে পড়লেন দুর্গাদেবীর বাড়ির উদ্দেশ্যে।  

আরও পড়ুন
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড – রবীন্দ্রনাথ এবং গান্ধীজি

সকাল পাঁচটার একটু পরে পুলিশ যখন দুর্গাদেবীর বাড়ি থেকে বিদায় নিল, তিন কমরেড তখন বাড়ির দরজায় ঘা দিল। দুর্গাদেবী কিছুক্ষণ দোনামনা করে দরজা খুলে দেখেন সামনেই ভগৎ সিং দাঁড়িয়ে, তাঁর পেছনে রাজগুরু এবং আজাদ।  দূ্র্গাদেবীকে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা জানালে তিনি বলেন যে তিনি সবই জানেন; স্কটের বদলে যে স্যন্ডার্সকে  মারা হয়েছে তাও তিনি বুঝেছেন কিন্তু এর ফলে তাঁদের সাহসিকতাকে অসম্মান করা যায় না। এরপর তাঁরা দুর্গাদেবীকে সুকদেবের কথা বলেন, তাঁদের যেভাবে হোক শহর ছেড়ে পালাতে হবে এবং দুর্গাদেবী যেন তাঁদের সাহায্য করেন। সুকদেবের পরিকল্পনামাফিক কিছুক্ষণের মধ্যে সমস্ত প্রস্তুতি নেওয়া হয়ে গেল। কলকাতায় ভগবতীচরণ ভোরার কাছে টেলিগ্রাম চলে গেল যে দুর্গাদেবী তাঁর ভাইকে নিয়ে কলকাতায় আসছেন। দুর্গাদেবীর সঙ্গে যাবেন ভগৎ সিং এবং রাজগুরু।  চন্দ্রশেখর আলাদাভাবে মথুরাগামী এক তীর্থযাত্রীদের দলে ভিড়ে তাদের সঙ্গে ভজন গাইতে গাইতে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে শহর ছাড়লেন।  চন্দ্রশেখর পরে ২৫ ডিসেম্বর দিল্লিতে আসেন।

ঘটনা ঘটার পরেপরেই সারা শহর জুড়ে শুরু হয়েছে চিরুনি তল্লাশি। শহর থেকে বেরনোর সমস্ত পথ বন্ধ। কড়া নজর রাখা হয়েছে লাহোর স্টেশনে। বিকেলের দিকে ইউরোপীয় পোশাকে সুন্দর দেখতে রঞ্জিত নামে এক স্মার্ট যুবক তাঁর স্ত্রী সুজাতা এক সদ্যজাত শিশু সন্তানকে নিয়ে লাহোর স্টেশনে এলেন, লক্ষ্ণৌ যাবার টিকিট কেটে ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাস কামরায় উঠলেন, সাথে তাঁর গৃহভৃত্য। কোনো বড়ো সরকারি অফিসার যেন বদলি হয়ে বাক্স-প্যাঁটরাসহ শহর ছাড়ছেন।  পুলিশ বুঝতেই পারল না, যাকে ধরতে তারা দাঁড়িয়ে আছে, সেই ভগৎ সিং তাদের চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

Powered by Froala Editor