বারাণসীর ভৃগু-পন্ডিত, গতজন্ম, তারও আগের আগের জন্মে…

মুছে যায়? —
আগের পর্বে

ষাট সত্তরের দশকে কাশীতে, হরিদ্বারে আমিষ নিষিদ্ধ। মদও। তবে আশির দশকে রাস্তায় রাস্তায় মাছ ভাজার দোকান। দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছেই মাছের বাজার। সেখানে বঁটির বদলে ব্যবহৃত হত ছোট হাতকুড়ুল। কাশীতে সেসময় বাঙালিদের প্রভাব সবথেকে বেশি। থাকতেন রাঢ়ী, পাশ্চাত্য বৈদিক ও বারেন্দ্র শ্রেণীর ব্রাহ্মণরা। কাশীতে বাঙালি ব্রাহ্মণ পরিবারে মেয়েদের কাচের চুড়ি পরা ছিল নিষিদ্ধ। ১৯৯৩ সালে সিগরায় ভারত সেবাশ্রম সংঘে একমাস ছিলাম পিতৃদেব অমরনাথ রায়ের সঙ্গে। তিন দিনের বেশি তীর্থযাত্রীদের থাকতে না দেওয়ার নিয়ম থাকলেও, সেই অনুমতি পাওয়া গিয়েছিল লেখক শঙ্কু মহারাজের চিঠির জন্য। তারপর…

কাশী এবং বেনারস দুটি আলাদা স্টেশন। এছাড়াও আর একটি রেল স্টেশন— বেনারস ক্যান্ট বা বেনারস ক্যান্টনমেন্ট। ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন আলাদা হয় বহু জায়গায়। দমদম ক্যান্টনমেন্টই তো আছে এখনও, আমাদের এই বঙ্গে। আসলে ক্যান্টনমেন্ট বা সেনানিবাস, নয়তো সেনাছাউনির কাছাকাছি স্টেশন নির্মাণ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের মস্তিষ্কপ্রসূত। এভাবেই আছে আগ্রা সিটি এবং আগ্রা ক্যান্ট বা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন।

কাশী স্টেশনটিও ষাট ও সত্তর দশকে বেশ ছোট, সংকীর্ণ। আশপাশও যেমন হয় পুরনো দিনের রেল স্টেশন, তেমন। অনেক কম গাড়ি সেখানে, মানে ট্রেন। কাশী স্টেশনের কাছাকাছি ষাটের দশকে, সত্তরে অনেক ঝুপড়ি। বাবা অমরনাথ রায়ের রেল চাকরির সূত্রে বার বার কাশী যাত্রা। পুরী বা দেওঘরেও। সেইসঙ্গে ঘাটশিলা। ঐ কাছাকাছি ট্রেন জার্নি, প্রায় নিখরচায় ভ্রমণ যেমন হয়।

সম্ভবত কাশী স্টেশনের কাছেই পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুরদের ‘হরধাম’। সেই বড়োসড়ো প্রাসাদপ্রায় বাড়ি— হরধাম বিক্রি হয়ে গেছে কিনা জানি না। বিক্রি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আলিশান সেই বাড়ির সামনে দেউড়ি, বড়ো গেট, আঁটাসোঁটা সমেত দারোয়ান। পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর পরিবারের যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, প্রদ্যোৎকুমার ঠাকুর— সকলেই ছিলেন বিদ্যোৎসাহী। 

‘হরধাম’-এ বারবার যেতেন পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুররা। সঙ্গে লোক-লশকর, চাকর-দাসী। বাবু বা গিন্নিমাদের ‘খাস’- লোক। খাস ‘চাকর-দাসী’। কলকাতা থেকে এই ভ্রমণ যাত্রায় সঙ্গে সব নেওয়া হত, ছুঁচ-সুতো থেকে শুরু করে, শৌচকার্যের পর ব্যবহার করা হবে, এমন গুঁড়ো মাটিও। কাশীর মাটিকে সোনা ভাবতেন বিশ্বাসী হিন্দুরা। ফলে কাশী থেকে কোনো মাটি বা মাটির তৈরি জিনিস তাঁরা আনতেন না। ‘কাশীর মাটি’ নিয়ে এলে, তাতে নাকি সোনাচুরির অপরাধ আর্শায়। এই জন্য কাশীর সব খেলনা কাঠের।

আরও পড়ুন
বারাণসীতে সবুজাভ গঙ্গা, বিষক্রিয়ার আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের

‘হরধাম’ গমগম করত পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর পরিবারের লোকজন এলে। সমস্ত ঘর-মহল ইত্যাদিতে ঝকমকিয়ে উঠত আলোদার ঝাড়লণ্ঠন। সে এক অন্য কাহিনি। 

আরও পড়ুন
ধর্মশালা, ধরমশালা, কিছু কথা

কাশীর বিখ্যাত তওয়ায়েফ— বাইজিদের বসবাসের জায়গা ডাল কি মণ্ডি বা দাল কি মণ্ডি। সেই তওয়ায়েফ গল্লি দেখার সুযোগ হয়েছে। সে কাহিনি এখানে নয়।

আরও পড়ুন
কমলাপতি, চন্দ্রশেখর, বহুরানি

কাশীর বেনারসী কারিগর, ব্যবসায়ী অধিকাংশই ইসলাম ধর্মাবলম্বী। দাঙ্গা লাগানো হলে সবার আগে লুটপাট হয় এঁদের বাড়ি। অভিযোগ আছে পি এ সি— প্রভিনসিয়াল আর্মস কনস্টেবুলারি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় গুলি চালিয়ে হত্যা করে ইসলাম ধর্মের মানুষদের।

আরও পড়ুন
গরুর গলায় তেত্রিশ কোটি দেবতা

কাশীর বেনারসীজীবী বা সিল্কজীবী ইসলাম ধর্মের মানুষরা এতটাই বিপন্ন বোধ করেন নিজেদের, যে তাঁরা বাড়িটিকে প্রায় দুর্গ করে রাখেন ডবল শাটার, কোলাপসবল গেট, ইত্যাদি দিয়ে। কিন্তু সেই অতি মজবুত ইস্পাত ও লোহার পাহারাদারি আটকাতে পারে না দাঙ্গাকারীদের, অনেক সময়।

কাশীতে দেখেছি ঘোর গরমে গাধারা ইট বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেকের পিঠে চারটে ছটা ইট। গর্দভরা চলেছে ধীরে, দূর থেকে হয়ত তাদের মনিটারিং করছে কেউ। আগ্রাতেও দেখেছি গাধাদের পিঠে বাড়ি তৈরির ইটের বোঝা। ইট ঝোলানো পেটের দুপাশে, শক্ত করে দড়ি বাঁধা সেই পোড়ামাটির ইট। কাশীর মাটিতে তৈরি পোড়ামাটির ইট তুলে বা খুলে নিয়ে এলে ‘সোনাচুরির পাপ’ স্পর্শ করে কিনা জানি না। কাশীতে সবই কাঠের খেলনা— ষাট সত্তর দশকেও। ঘোড়া, হাতি, ষাঁড়, উট, ব্যান্ডবাজিয়েরা, কী তার ফিনিশিং, দেখার, চোখ চেয়ে দেখার। এছাড়াও বড়ো কৃষ্ণ, রাধাকৃষ্ণ, ব্যান্ড পার্টিঅলাদের প্যানেল, তিন বা চারজন কি পাঁচজন একসঙ্গে, দেখতে দেখতে মুগ্ধ হতে হয়। সেই সব লকড়ি কা খিলৌনা বহু বছরই নেই। কাঠের খেলনার কারিগররা অনেকেই হয়ে গেছেন কাশীর রিকশচালক। সেটা আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা।

এই কাষ্ঠ খেলনার কারিগররা অনেকেই বানিয়ে ফেলতেন কাঠের পাখি— নানান চেহারার সেইসব রঙিন পাখিরা— টিয়া, শালিক, চন্দনা, ময়না, ফুলটুসি। কাশীর শীতলা ঘাটে দেখেছি অজস্র চুঁই শালিক। সাইজে হয়তো আমাদের এখানে যে নর্মাল শালিকদের দেখি, চোখের ওপরে হলুদ চশমা, হলদে পা, তেমনই, কেবল ঠোঁটের ওপর খানিকটা বাহারি রোম। বেশ লাগে দেখতে।

কাশীতে ষাটের দশকে কাঠ খোদাইয়ে খুব ছোট্ট হাতি, উট, ষাঁড় দেখেছি। হাতের আঙুলের এক কর মাপের থেকে সামান্য বড়ো এইসব খেলনা-প্রাণীর। কি তাদের সূক্ষ্ম কারুকাজ!

আস্তে আস্তে এইসব ছোট, সূক্ষ্ম কাজ উঠে গেল। সত্তর দশকের পর থেকেই অনুপস্থিত তারা। কাশীতে কাঠের বাড়ি, তিনটে পাখি ঠুকরে ঠুকরে কিছু একটা খাওয়ার চেষ্টা করছে, সেই রকম হাত দিয়ে নাড়িয়ে নাড়িয়ে খটখটাতে পারা এইসব খেলনারাও নিরুদ্দেশের পথে। কাঠের তৈরি লোলাকাঠি— লাল তার রং, শেষ দেখি বারাণসীতে। আগে কলকাতাতে পাওয়া যেত। ছোট ডাম্বেল চেহারার, কিন্তু বড়ো জোর এক আঙুল লম্বা। এছাড়াও কাঠের গাড়ি, বাস, পাওয়া যেত কাশীতে, দিশি কারিগরদের তৈরি।

আগেই বলেছি বেনারস বা বানারসের মূল বেনারসী কারিগররা থাকেন মদনপুরায়। মদনপুরায় এমনিতেই ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের বাস। গোধূলিয়া থেকে সোজা হেঁটে এলে দশাশ্বমেধ ঘাট, দশাশ্বমেধ বাজার। রাস্তার ওপর ডানদিকে পুরনো টাঙ্গা ইক্কার যে আড্ডা— রাখার জায়গা, তাঁকে বাঁ হাতে রেখে আবার সোজা মানে দশাশ্বমেধ ঘাটে না গিয়ে ডান দিকে ঘুরলে মদনপুরা, দুপাশেই বেনারসীর বাড়ি কাম দোকান। অনেকে হেকিমি দাওয়া— হেকিমি দাওয়া-দারু— এখানে দারু মানে অবশ্যই মদ্য নয়, তো এটা কেবল মাত্র দাওয়ার পাশে বসানো এক শব্দের প্রতিবেশী রূপ।

হেকিমি দাওয়া— ওষুধের দোকানে এক ধরনের পালতু— পোষা অন্ধকার থাকে। তার মধ্যে অতি প্রাচীন কোনো গন্ধ। কাশীতে মদনপুরায় এরকম ইউনানি বা হেকিমি দাওয়াখানা— ওষুধের দোকান বেশ কয়েকটি। তাদের নুসকা— দাওয়া প্রয়োগে পেট ফাঁপা, হাঁফানি, বদহজম নির্মূল, যৌন ক্ষমতা বৃদ্ধি, হৃদয় ঘটিত দৌর্বল্য দূরীকরণ— সবই আছে। কবিরাজদের সঙ্গে হেকিমদের চিকিৎসা তরিকা— পদ্ধতি খানিক মেলে, খানিক মেলেও না। আরব থেকে আসা এই ইউনানি বা হেকিমি চিকিৎসার ধারা— নুসকা, চুরণ প্রভৃতি মিশে গেছে ভারতীয় জীবনের সঙ্গে। এই আমার দেশ, আমাদের দেশ, আমার সংস্কৃতি, আমাদের সংস্কৃতি। 

অতি নামজাদা হেকিম— ইউনানি তরিকা— ধারায় চিকিৎসা করা লোকমান হেকিম, তিনি তাঁঁর চিকিৎসা গুণপনায় চরক, জীবকদের সমতুল্য প্রায়, তো সেই লোকমান হেকিম যখন রাস্তার মাঝখান দিয়ে হেঁটে যেতেন, তখন পথের দুপাশের যে বৃক্ষরাজি, তারা ডাল– শাখা, পাতা– পত্র সমেতম আভূমিনত হতে পারত। মানে হয়ে যেত আরকি। লোকমানের সম্মানে, তাঁকে যথারীতি— যথাবিহিত ইজ্জত দিতে। লোকমান হেকিম মনে করতেন পৃথিবীর— দুনিয়ার সমস্ত ভেষজ ও ওষধিতে আরোগ্যের বীজ লুকিয়ে আছে, যেমন বিশ্বাস করতেন জীবক। 

ইউনানি দাওয়াই তরিকায় বিভিন্ন ধরনের খনিজ লবণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেইসঙ্গে শহদ— মধু, অর্দ্রক বা আর্দ্রক— আদা, শুকনো আদা— শুঁট, এইসব ওষুধ অনুপানের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে ইউনানি দাওয়া-সম্ভার। তার সঙ্গে আছে আরও বহু জিনিস— গুণময় দ্রব্য।

মদনপুরার সেইসব ইসলাম ধর্মাবলম্বী, যথেষ্ট ধনী বেনারসী নির্মাতা ও কারখানা মালিকদের আর্থিক অবস্থা যথেষ্ট ভালো। তবু তাঁদের আতঙ্ক যেন কাটে না। কাশীতে বহু বড়ো বড়ো দাঙ্গা হয়ে গেছে। আগে লিখেছি আবার লিখছি, শিবক্ষেত্র কাশীতে পাঁঠা, খাসির মাংস বিক্রি হয় চিকের আড়াল দিয়ে। বাঁশে বোনা লম্বা চিক, তার পেছনে ঝোলানো কাটা খাসি বা পাঁঠা, ছাল ছাড়ানো। সেখানে কল্লা— গলা, মুঢ়ি— মুড়ো বা মুণ্ডু, গুর্দা, কালিপোচ, কলেজি, রাং ইত্যাদির হিসেব একদম পরিষ্কার। সাধারণভাবে একটা সময় ছিল যখন তথাকথিত উচ্চবর্ণের হিন্দুরা মাংসের দোকান থেকে আনা খাসির মাংস খেতেন না। পাঁঠার মাংস খেতেন। নিষ্ঠাকাষ্ঠা মানা, পাশ্চাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণরা দেবতা বা দেবীর সামনে বলি না দেওয়া ‘বৃথা মাংস’ খেতেন না।

আগেও লিখেছি, আবারও বলছি— কাশীটে সংস্কৃত পন্ডিত, বাইজি, বেশ্যা, তওয়ায়েফ, গানওয়ালি, রাগসঙ্গীত গাইয়ে ও বাজিয়ে, সাধু-সন্ন্যাসী, যোগী, জ্যোতিষী, এঁরা না এলে বা প্রয়োজনে বাসা বেঁধে বসে না পড়লে নাম হয় না, তাঁদের। এটা খুবই চালু ও পুরনো কথা। 

কাশীতে ‘ভৃগু’ এক আশ্চর্য ধরনের গণৎকার। তাঁরা বংশানুক্রমিক জ্যোতিষচর্চা করেন। তাঁদের কাছে অতীত জন্মের, গত গত— বিগত জন্মের তথ্য জানার জন্য আসেন মানুষ। কাশীতে ‘ভৃগু করানো’ জন্ম জন্মান্তরের— বিগত জন্মের, তারও আগের জন্মের খবর জানাবান জন্য বংশানুক্রমিক ‘ভৃগু’রা ছিলেন। 

এই ‘ভৃগু’দের দেখেছি বেশ কয়েকবার, নিপাট কৌতূহলে। ‘ভৃগু’দের মধ্যেও আবার তথাকথিত ‘বড়ো’, ‘ছোট’ আছে, তাঁদের সাম্মানিক বা সম্মান দক্ষিণার ওপর ভিত্তি করে। ‘ভৃগু’দের— ভৃগু পন্ডিতদের কারও কারও বাড়ি যথেষ্ট বড়ো। তার একতলায় প্রায়ান্ধকার ঘরেই অনেক সময় জন্ম-জন্মান্তরের কোষ্ঠীপত্র খোলা হয়। যে জাতক বা জাতিকা জানতে এসেছেন তাঁর পূর্ববর্তী জীবনের রহস্য কথা, তাঁদের বলে দেওয়া হতে থাকে এইসব এক জন্ম, দুই জন্ম, তিন জন্মের তথ্যকথা। সামগ্রিক তথ্যপঞ্জি। সে যেন এক রহস্যময় কোনো সিনেমাশট। কমজোরি আলোয় ভৃগু-পন্ডিত, তাঁর জ্যোতিষবিদ্যা নিয়ে বলে যাচ্ছেন প্রায় ঘণ্টা, দেড় ঘণ্টা। যেমন অর্থ দক্ষিণা হিসাবে দেওয়া হয় ভৃগু পন্ডিতকে।

এক বালকের স্মৃতিতে মনে পড়ে একটি প্রায়ান্ধকার বাড়ির সিঁড়ি। বড়ো বাড়ি— পাথরের হাভেলি। যেমন কাশীতে হয় সাধারণভাবে। সেই পাথরের— প্রস্তর নির্মিত হাভেলির এক তলায় একটি বড়ো সিঁড়ি। ঘোরানো সিঁড়ি, তাও পাথরের। সেই সিঁড়ির নিচেই, একটি প্রায়ান্ধকার ঘর। দিনেই সেখানে প্রায় নিঝুম অন্ধকার, প্রদীপের— তেল-প্রদীপের আলো। সেই আলোময় অন্ধকারটুকু নিবিড় ছায়ায় আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছে কোনো অকূল শূন্যতাকে।

পিদিম রোশনিতে সেই ভবিষ্যৎ বলা মানুষটি, তার মুখ অথবা দুচোখই চোখে পড়ে শুধু। সেই ঠোঁট দুটি ফরফর ফরফর করে। ফরফর ফরফর। তা থেকে উড়ে আসছে গত জন্ম বা তার আগের জন্মের খবরাখবর। সেই ভৃগুর কাছে যেতে গেলে বেশ ভালো টাকা লাগে। সে তো বালকবেলায় কাশীতে ভৃগুর কাছে নিয়ে যাওয়া কোনো আত্মীয়সম জনের কাছে শোনে, শোনে, শুনতে থাকে ভৃগু পন্ডিতের কাছে যাওয়ার স্মৃতি। সেই স্মৃতিতে হয়তো কিছু ‘জল’ থাকে, নাকি থাকে না? ভৃগু-পন্ডিত আধা সংস্কৃত, আধা হিন্দিতে, নাকি কাশীর নিজস্ব বোলি— ‘কাশিকা’তে বলে যাচ্ছে জন্ম অথবা জন্মান্তরের তরঙ্গগাঁথা। তরঙ্গ। তরঙ্গ। তরঙ্গ।

একটার পর একটা ঢেউ। ঢেউ। ঢেউ। কোন জন্মে, কোন বাড়ির গলি, উঠোন, ঠাকুরঘর, গাছতলা, মাঠ, আবার ফিরে আসা তুলসীমঞ্চ, গঙ্গাজলের কলসি— সব এক, সবকিছু এক হয়ে যায়। শূন্যতার ভেতর আরও শূন্যতা পেরিয়ে পেরিয়ে কেমন সব বায়বীয় ছবি। কেমন যেন ছানাকাটা জল রঙের ভেতর দিয়ে দিয়ে অধীর প্রাণকল। প্রাণবিকল।

কোথাও কোনো শব্দ নেই আর। এমনকি বাতাসও কোনো প্রশ্ন করে না। উত্তর দেয় না নবীন নয়, প্রাচীন প্রাচীনতর অন্ধকারের মধ্যে। ভবিষ্যকথা, ভবিষ্যৎবাণী নয়। অতীত। অতীত। অতীত। কেবল অতীতই। তারসঙ্গে দু-এক টুকরো ভবিষ্যৎও মিশে থাকে কী? নাকি সবই ঘন, নিবিড়, ছায়াচ্ছন্ন অতীত, অতীতই কেবল।

সে কেবল এড়িয়ে যেতে থাকে— ভবিষ্যৎ বক্তা এড়াতে চায় কি ভবিষ্যৎ? ভবিষ্যৎবাণী? ভবিষ্যতের রূপরেখা? নাকি অতীতই— মৃত অতীতের ফসিল— অন্ধকার ঘুরে নিতে চায়, ঘিরে নিতে থাকে সার্বিক জীবনের আলো-অন্ধকারে। নাহ, এখানে কোনো প্যারাসাইকোলজি নেই। 

সেই একতলার ঘর কাশীর, লাল পাথরে, হয়তো কালো পাথরেও তৈরি একতলার ঘরখানা, কাশীর তখনকার বাড়ি যেমন হয় কিংবা কলকাতারও অনেক উঁচু সিলিং। সিলিংয়ে আলোর গানটুকু সামান্য কোনো রেখা হয়ে জেগে, জেগে থাকে।

অচিন— অচেনা অন্ধকারের ভেতর, ভৃগু-পন্ডিতের খালি গা— নগ্ন গাত্র। গলায় রুদ্রাক্ষ আর স্ফটিকের অবোধমালা, দিন শেষের কথা সেখানে। মানে এই বাড়িতে ছিল কিনা জানা যায় না, নাকি দিন-দিনই, বোঝা যায় না আলোয়, অন্ধকারে। ভৃগু পন্ডিত বলে যাচ্ছে আর সামনে গোল করে পাকানো হলুদ হলুদ পর্চি, অনেক অনেক পুরনো তুলোট কাগজই হয়তো। খুব প্রাচীন। নাকি তুলোট কাগজই নয়, সে যেন এক ধরনের ফক্কিকারি যা চলছে, চলেছিল বছরের পর বছর, ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় কাঠের ধোঁয়ায় ধোঁয়ায়— ধূম্রাভাসে একটু একটু করে পুরনো, লালচে করে তোলা কাগজদের। তারপর তার ওপরে লাল কালিতে ভাগ্যের— ভাগ্য ফলের— তকদিরের আঁকিবুঁকি। হোরারি চক্র, পতাকি চক্র, রিষ্টিযোগ, লম, রাশি, দশা, অন্তর্দশা, প্রত্যন্তর দশা, অষ্টোত্তরী, আর বিংশোত্তরী দশা, দশা ভোগ, নবাংশ, লগ্নস্ফুট, জাতক বা জাতিকা তার পিতা বা মাতার ‘গণ্ডে পা’ দিয়ে জন্মানোর পর অকাল মৃত্যুর জন্মদাতা বা জন্মদাত্রীর অকাল মৃত্যুর কারণ হয়— এইসব ভুল, ঠিক কথা-কল্পনা ইত্যাদি প্রভৃতি সব— সব কিছু গুটিয়ে রাখা হতে থাকে সামনে।

জীবন যেন অতিকায় এক প্রাগৈতিহাসিক ডায়ানোসর, কথায়, কথায়— কথায় ফেরে তা অদ্ভুত নিশিযাপনের খেলা হয়ে দাঁড়ায়। সেই অতিকায় ডায়ানোসর অথবা আরও হিংস্র, টিরানোসোরাস রেক্স, উড়ন্ত টেরাড্যাকটিল চাঁদের আলো মেখে মেখে ফেলতে থাকে শ্লেট রঙের কোনো বিশুদ্ধ ছায়া। সেই ছায়ানুভূতি ধরেই যেন এগোতে থাকে ভৃগু-পন্ডিতের কণ্ঠস্বর। গতজন্ম, তারও আগের জন্ম, তার তারও আগের জন্মের, খুব পাওয়ার ফুল ভৃগু পন্ডিত হলে অনেক অনেক অর্থের বিনিময়ে বলে দিতে পারে নাকি সপ্তজন্ম-সাত জন্মের কথাসাগর, কে আর মনে রাখতে পারে সাতজন্ম, গত পরশুর কথাই তো মনে থাকে না অনেকের। দৃশ্যমান গত পরশু অনায়াসে অদৃশ্য হয়ে যায়।

Powered by Froala Editor