বারাণসী–বেনারস–কাশী

মুছে যায়? -- ৪৩
আগের পর্বে

আজ থেকে সাঁইত্রিশ বছর আগে কাশীতে মনমোহন পাণ্ডের ধর্মশালায় আমিষ খাওয়া যেত। তা অবশ্য নিজেকে রান্না করে নিতে হবে অথবা আনতে হবে বাইরে থেকে। দশাশ্বমেধের কাছেই ছিল মহেশ ভট্টাচার্যদের হরসুন্দরী ধর্মশালা। তিন রাতের বেশি সেখানে থাকা যায় না। তবে কাশীর সব ধর্মশালাতেই একই ছবি। রাত দশটার পরে আলো থাকে না। সেই ষাট বা সত্তরের দশকে কাশীতে ঘুরে বেড়ানো মানে ইক্কা আর টাঙ্গা। তখনও অটোরিক্সা আসেনি বেনারসে। তারপর...

উত্তরপ্রদেশের চন্দৌলি বা চান্দৌলি থেকে বাসে আসছি বেনারস। আকাশটার দিকে তাকালে হঠাৎ করে মনে হতে পারে ‘বুড়ির মাথার পাকাচুল’ বা ক্যানডিফ্লস যেন লুকিয়ে আছে আকাশটার পেছনে। কি অপরিসীম রঙদারি। মোহমুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। সাধারণত শীত সকালের আকাশ স্বর্ণরেণু মাখা একটু পরনোটেই হল চিত্রকল্প, তা হোক গিয়ে, আকাশটা, মেঘটা তারাও তো বহুপ্রাচীন। ১৯৮৪ সালে কাশীতে দেখেছি রাস্তায় রাস্তায় মাছ ভাজার দোকান, মাছ কেটে বিক্রি হচ্ছে, যেমন পুরী বা দিঘায়, সমুদ্র সৈকতে, কাশীতে বড় রাস্তার ওপর, গাড়ি লাগিয়ে। ষাট-সত্তর দশকে এই ব্যাপারটা— ঠেলা লাগিয়ে মাছ ফ্রাই করে বিক্রি করা। নো নো। না।

সত্তর দশকে বহু বাঙালি নকশালপন্থী বেনারস, ইলাহাবাদ, পুরীতে। দিল্লিতেও। সেখান থেকে কেউ কেউ ধরাও পড়েছেন তাঁরা। আবার পড়েনওনি। কাশী, পুরী, দিল্লির ধর্মশালা, ভাড়াবাড়ি, এসবই ছিল নকশাল খোঁজা গোয়েন্দা পুলিশের টার্গেট। রাতে, বিরেতে হানা। পশ্চিমবাংলা থেকে স্পেশাল ব্র্যাঞ্চের লোকজন অনায়াসে চলে যায় এইসব জায়গায়, তারপর গ্রেফতার করে যিনি গ্রেফতার হলেন, তাঁকে নিয়ে ট্রেনে ফেরা।

বেনারসে দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছাকাছি ‘দশাশ্বমেধ লজ’, কাশীতে থাকার জায়গায় পক্ষে অতি পছন্দের, আমার কাছে তো বটেই। দশাশ্বমেধের গা লাগোয়া প্রায় মাছের বাজার। বেশ বড়ো মাছ বাজারে পাওয়া যায়। নানা ধরনের মাছ।

আমার বালকবেলায় এই বাজারে মহাশোল মাছ বিক্রি হতে দেখেছি। খুব স্বাদু এই মাছ। বারাণসী ছাড়াও হরিদ্বারে পাওয়া যায় মহাশোল। কিন্তু হরিদ্বারে ষাট-সত্তর দশকে মাছ-মাংস-আমিষ নিষিদ্ধ একেবারেই। মদও।

আরও পড়ুন
ধর্মশালা, ধরমশালা, কিছু কথা

কাশীতে মহাশোল মাছের ঝোল খাওয়ার স্বাদু স্মৃতি এখনও মনে আছে। বড়ো মাছের টুকরোর গায়ে গায়ে গা মাখা মাখা রসা বা কাউ, অপূর্ব। আদা-জিরে বাটা, সামান্য গরম মশলা, কি যে সোয়াদদার, বলে বোঝানো যাবে না।

আরও পড়ুন
কমলাপতি, চন্দ্রশেখর, বহুরানি

দশাশ্বমেধের মাছ বাজারে ছোট হাতকুড়ুল দিয়ে ঘেঁড়ো— বড়ো কাতলা আর রহু মছদ্বি— রুই মাছের আঁশ ছাড়াতে দেখেছি। বঁটির ব্যবহার খুব কম, তবে চপার, কাটার ও ছুরি আছে বড়ো মাছ কাটতে। দার্জিলিংয়েও পাকা— বড়ো মাছ কাটার জন্য কানছা ও কানছিয়া ব্যবহার করেন। ছোট পোক্ত, ধারাল হাত কুড়ুল। তিরিশ-চল্লিশে তো বটেই, পঞ্চাশ-ষাট দশকে কাশী বেশ সস্তা। কথায় আছে ‘বনারস মে জিতনা কঙ্কর, উতনা হি শঙ্কর’। অর্থাৎ, যত কঙ্কর— কাঁকড়— পাথরের গুঁড়ো, তত শিব। দশাশ্বমেধের বেশ কাছেই বঙ্গালি টোলা বা বাঙালি টোলা, হাতিফটকা, কালীবাড়ি, কচুরিগলি।

আরও পড়ুন
গরুর গলায় তেত্রিশ কোটি দেবতা

কাশীতে এক সময় বাঙালিদের খুব প্রভাব। বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ, দাক্ষিণাত্য বৈদিক ও পাশ্চাত্য বৈদিকদের খুব রমরমা। বিশেষ করে বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ ও পাশ্চাত্য বৈদিকদের। আছেন রাঢ়ী শ্রেণীর ব্রাহ্মণেরা, তবে তুলনায় পাশ্চাত্য বৈদিক ও বারেন্দ্র শ্রেণীর ব্রাহ্মণদের তুলনায় কম। 

আরও পড়ুন
কমনের যে ইষ্ট করে ও অন্যান্য

কাশীতে রাজানুগ্রহে জমিদারদের ‘বদান্যতায়’ সত্র, টোল, দেবালয়। সত্রর আধিকারিক অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাশ্চাত্য বৈদিন ব্রাহ্মণেরা। টোলে তাঁরাই প্রধানত পড়ান। চতুষ্পাঠী মূলত পাশ্চাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণ আর বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের পরিচালনায় চলে। 

এক শতায়ু অতিক্রান্ত মহাত্মার কাছে শুনেছিলাম— কাশী অর্থে প্রকাশী। কাশী— কাশী হল প্রকাশী। সাধু, সন্ন্যাসী, পণ্ডিত, সাধক, বেশ্যা, ভিক্ষুর— কাশীর সকলের। বড়ো বড়ো সাধু— মহাত্মা, গাইয়ে-বাজিয়ে, তওয়ায়েফ— সকলের জন্য বারাণসী।

বারাণসীর অলি-গলি, গলি, তস্যগলির সব কিছুর গায়েতেই ইতিহাস। মুখে মুখে চলা গল্প, প্রতি ইতিহাস। দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছেই দশাশ্বমেধ লয। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের তৃতীয় পুত্র হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাঁর নাতি সুভগেন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি নিজের নাম ছোটো করে সুভো ঠাকুর হয়েছিলেন, ক্যালকাটা গ্রুপ নামে আর্টিস্ট সংগঠনের তিনি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, অন্যরা হলেন পরিতোষ সেন, রথীন মৈত্র, রথীন মিত্র, প্রাণকৃষ্ণ পাল, গোপাল ঘোষ, আরও হয়ত কেউ ছিলেন ক্যালকাটা গ্রুপে, তো সেই শিল্পসংগ্রাহক, শিল্পী, শিল্পবোদ্ধা, বিশিষ্ট আড্ডাধর সুভো ঠাকুর খুব পছন্দ করতেন ‘দশাশ্বমেধ লক’-এ থাকতে। সুভো ঠাকুরের বড়ো পুত্র সিদ্ধার্থ ঠাকুর— যার ডাকনাম গেটু, তিনিও পছন্দ করতেন ‘দশাশ্বমেধ লজ’। কাছেই দশাশ্বমেধ ঘাট, দশাশ্বমেধ ঘাট সংলগ্ন অতি বিখ্যাত গরম কচুরি জিলাবি— জিলিপি, লস্যি, রাবড়ি, মালাই, চমচম, প্যাঁড়ার দোকান। রাবড়ি ও মালাই সন্ধেবেলা টাটকা, কারণ সন্ধ্যার পর, আরও একটু রাত বাড়লে রাবড়ি-মালাইয়ের জ্বাল কাঠের উনোনে, সঙ্গে মাধা-সর সমেত গরম দুধ। দুধ কিনলে সরের মোটা কুচি একফালি। আহা! এই দুধ সাধারণত ভঁইসির— মোষের। গরুর দুধও আছে। মোষের দুধ সাদাটে, তার ঘিও— ভাদোয়া বা ভাদুয়া ঘৃত সাদা, গাওয়া ঘি— গব্য ঘৃত— গাইয়া কা দুধ সে বলা ঘিউ-ঘি, তা খানিকটা সোনালী— হলদেটে।

দশাশ্বমেধে গোধূলিয়া থেকে যেতে যেতে অনেক অনেক ফুলের দোকান। বিশ্বনাথ গলির ভেতরও ফুল আর ফুল, নানা দোকানে। বিশ্বনাথ গলির ভেতর দত্তদার জর্দা, তারপর কুলপি, প্যাঁড়া, রাবড়ি, দুধ, পিতলের, পাথরের নানা সামগ্রীর দোকান, কাঠের খেলনা, আতর বা ইত্তর, সে তো পাওয়া যায় দত্তদার দোকানেই। সাজা পানের দোকান, দেব-দেবীর মূর্তি, নানা মাপের শিবলিঙ্গ, গাঁজার কলকে। ‘বড়ো তামাক’ গঞ্জিকা সেবনের সুলফা— বড়োসড় সাইজের হয়, কাঠের, পাথরের, সাদা ও কালো পাথর, সেইসঙ্গে ঝুটা ও আসল রাদ্রাক্ষ, চন্দন পাটা, নকল স্ফটিকের মালা, আসল নয়, এমন স্ফটিক, বাঙালি হিন্দু বিধবাদের খাওয়ার ‘পাথর’— পাথরের কানা উঁচু থালা। নানা ধরনের তান্ত্রিক যন্ত্রম-প্লেট, আরও আগড়ম বাগড়ম কত কী। এই সঙ্গে চুড়ির দোকান— কাচের বাহারি চুড়ি, নানা ডিজাইনের, চুড়ি আসে উত্তরপ্রদেশেরই মথুরা থেকে। 

ইসলাম ধর্মের না- বেওয়া— বিধবা না হওয়া নারীরা কাচের রঙিন চুড়ি খুব পরেন। হিন্দি বলয়ে কাচের চুড়ি পরেন বিবাহিত আর বিয়ে না হওয়া মেয়েরা। বাঙালি ব্রাহ্মণ পরিবারে— বিশেষ করে পাশ্চাত্য বৈদিক পরিবারে, নারীদের চুড়ি পরা নিষেধ। কেন না এই চুড়ি নাকি মুসলমানী— যাবনিক কালচারের প্রতীক। আর চুড়ি কোনোভাবে ভাতের ছোঁয়ায়, এঁটো হলে তা ভেঙে গেলে দিতে হবে— এমনই নিষেধাজ্ঞা। সেই চুড়ি হাতেই রাখা যাবে না। ভেঙে ফেলতে হবে। আসলে ষাটের দশকের একদম শেষ থেকেই বোম্বাইয়া সিনেমার প্রভাবে বাঙালি— হিন্দু বাঙালি মেয়েদের মধ্যে এক হাতে, দুহাতে রঙিন এক ঢাল কাচের চুড়ি পরার রেওয়াজ ছিল।

ষাটের দশকে মফস্বল শহরে, শহরে আসতেন চুড়িওয়ালারা, শাঁখা পরা নর শাঁখারিরা তাঁরা বার করতেন চুড়ি, হাঁড়ি ও প্যাঁটরা, কোনো কোনো জিভে— কখনও কখনও উচ্চারণে পেঁটরা। তার ভেতর থেকে শাঁখা, পলা, প্লাস্টিকের শাঁখা, চুড়ি, কাচের চুড়ি বার করে আনতেন। তারপর বিবাহিতদের শাঁখা ভেঙে গেলে, যাকা ‘শাঁখা ভেঙে গেছে’ না বলে ‘শাঁখা বেড়ে গেছে’ বলা হত, তো সেইসব এয়োস্ত্রীদের হাত ‘শক্ত’ হলে তাঁরা সাবান আনিয়ে, সাবানের জল করে শাঁখা পরিয়ে দিতেন নিজস্ব কসরতে।

কাশীতে ষাটের দশকে সত্তরেও এত কাচের চুড়ি আর শাড়ির দোকান নেই, গোধূলিয়া থেকে ঘোড়ার গাড়ির আড্ডা ডান হাতে ফেলে সোজা দশাশ্বমেধ ঘাটের দিকে যেতে বাঁ হাতে একটি প্রাচীন দোতলা বাড়ির দোতলাতেই সি পি আই— ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অফিস। কুড়ি কুড়ি বছর পার হয়ে গেছে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি— সি পি আই— এক থেকে দুই হওয়ার। সি পি আই এবং সি পি আই (এম)।

সরু সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে এলে কাশীর সি পি আই-এর অফিস এবং অফিস বেয়ারার বসার জায়গা। যতদূর মনে পড়ে তাঁর পরনে পা ঢিলা পায়জামা। তার ওপর উলিকট এবং গরম চাদর। তাঁর সঙ্গেই কথা— দেহরক্ষীর গুলিতে ইন্দিরা গান্ধীর হত্যা, তারপর দেশজুড়ে নতুন করে উত্থান রাজীব গান্ধীর সঙ্গী জগদীশ টাইটলার, যার থুতনিতে গোটি, দিল্লির শিখ বিরোধী দাঙ্গা যা হয়েছিল ‘প্রিয়দর্শিনী’ হত্যার পর, সব কথা উঠে এল পরপর। রাজীব গান্ধী কীভাবেই এই দেশ চালাবেন, তা নিয়েও কথা উঠল। কথা হল, অনেকক্ষণ ধরে। সি পি আই-এর পার্টি অফিসের দেওয়াল শুধুই চুনকাম করা। দেওয়ালে ধূলি-ঝুল ধূসরিত সর্বভারতীয় সি পি আই নেতাদের ছবি। বোধ হয় এস এ ডাঙ্গে, রাজেশ্বর রাও, পি সি যোশী— পূরণ চাঁদ যোশী বা এরকম কেউ কেউ। মার্ক্স-এঙ্গেলস-লেনিন তো ছিলেনই। হয়তো হো-চি-মিনও। ফিদেল কাস্ত্রো, চে গেভারা, মাও-সে তুঙ, জোসেফ স্তালিন— কেউই নেই। সব ছবি কাচ বাঁধানো, ধুলো খাওয়া।

সেই সি পি আই অফিসে যাঁর সঙ্গে কথা বললাম তিনি বাঙালি। কথায় বাক্য গঠনে সামান্য পশ্চিমা টান। কাশীতে বাঙালিরা একসময় সবদিকে যথেষ্ট প্রতাপান্বিত। তাঁরা অধ্যাপক, সংস্কৃত পণ্ডিত, গাইয়ে বাজিয়ে, রাজনৈতিক নেতা। বেনারসে অখিল ভারতীয় জনসঙ্ঘ ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি— সি পি আই, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী)— সি পি আই (এম) তাদের কিছু কিছু প্রভাব ছিল। জনসঙ্ঘ— অখিল ভারতীয় জনসঙ্ঘর ক্যানডিডেট হতেন বাঙালি।

গোধূলিয়া থেকে দশাশ্বমেধ ঘাট পর্যন্ত হাঁটতে একটু ডাইনে বাঁয়ে করলেই প্রখ্যাত পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক বানারসী দাস বা বনারসী দাসের বড়ো দোকান। এঁরা অত্যন্ত পুরনো পাবলিশার ও বুক সেলার। বানারসী দাস বা বনারসী দাস থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সব, সিরিয়াস বই ইংরেজিতে আর হিন্দিতে বেরোয়। সেই বই বিপণিতে বেশির ভাগ ক্রেতাই বিদেশি। দোকানে দুপুর ছাড়া প্রায় সময়ই ভিড়। আমি দুপুরের দিকে ভালো বই দেখার জন্য যেতাম ১৯৯৩ সালের গরমে— মার্চে। ততদিন বাবরি মসজিদ ভাঙা পড়েছে গাঁইতি আর লোহার শাবলে, রডে। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর। সাহিত্য আকাদেমির ভ্রমণ ভাতা পেয়ে ১৯৯৩ সাএ চলে গেলাম কাশী, সেখানে ছিলাম এক মাস। সিগরায় ভারত সেবাশ্রম সংঘ-র থাকার জায়গা। সিগরা থেকে হেঁটে দশাশ্বমেধ প্রায় চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট, জোরে হাঁটলে— খরপায়ে হেঁটে এলে। সিগরায় ভারত সেবাশ্রম সংঘ-তে একমাস ছিলাম পিতৃদেব অমরনাথ রায়কে নিয়ে। রেলের চাকরি থেকে রিটায়ার করা অমরনাথ রায় তখন ফার্স্ট ক্লাস পাস পান। তিনি আমার যাত্রাসঙ্গী।

কাশীতে ভারত সেবাশ্রম সংঘর প্রধান মহারাজকে চিঠি লিখে দিলেন লেখক শঙ্কু মহারাজ। তিনি সেই মহারাজাজির বিশেষ স্নেহভাজন। ভারত সেবাশ্রম সংঘর যে কোনো শাখাতেই তিন দিনের বেশি মানে তিন রাতের বেশ থাকা যায় না। ভারত সেবাশ্রম সংঘর নিয়ম অনুযায়ী হিন্দু এবং স্বামী-স্ত্রী অথবা পরিবারিকভাবে অন্যদের সঙ্গে নিয়ে থাকতে পারবেন যাত্রীরা। কিন্তু লেখক শঙ্কু মহারাজের চিঠিতে কাজ হল, আমরা এই আশ্রমের দোতলায় এক মাস থেকে গেলাম, বাবা আর আমি। এই যে একমাস থাকা, ঘোর গরমে তীব্র মশা, অথচ কোনো মশারি নেই, সেসব কথা পরের সংখ্যায় বলব।

এবার চন্দৌলি বা চান্দৌলি থেকে বেনারস পৌঁছনোর পর জায়গা হল না ‘দশাশ্বমেধ লজে’। এত ভিড়। তাছাড়া নির্বাচন, সাংবাদিকরাও এসেছেন, সারা ভারত থেকে প্রায়, তখন একরকম বাধ্য হয়েই প্রায় ‘দশাশ্বমেধ লজ’-এর আশা ছেড়ে মহেশ ভট্টাচার্যদের হরসুন্দরী ধর্মশালায়।

দশাশ্বমেধ ঘাটের একেবারে কাছে, রাবড়ি, মালাই, চমচমের গা লাগোয়া রাম ভট্টাচার্যর আর্ট ও অ্যান্টিকের দোকান। প্রচুর পুরনো মূর্তি, ঘড়ি, পেইন্টিং— ছোট, বড়ো, গ্লাস পেইন্টিং, অধিকাংশই ফেক, সেসব নিয়ে, সাজিয়ে রামবাবু বসে থাকেন দিবারাত্র। মাথার বড়ো চুল, গালে দাড়ি, গলায় স্ফটিকের মালা, রুদ্রাক্ষের মালা, সোনা বাঁধানো, গালে বেনারসী পান, সবসময় ঠাসা, সুগন্ধী জর্দা সহযোগে চলছেই অনবরত চর্বণ। মুখের ভেতর— গালের মধ্যে পানের গিলৌরি— পিক জমা করা আছে। কথা বলতে গেলে সেই গিলৌরি বা পানের পিক ভাণ্ডারে তরঙ্গ ওঠে। কথা জড়িয়ে যায় সামান্য।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের তৃতীয় পুত্র হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তিনিই সুভো ঠাকুর— সুভগেন্দ্রনাথ, টুবো ঠাকুর— সিদ্ধিন্দ্রনাথ, বাসব ঠাকুর— বাসবেন্দ্রনাথ ঠাকুর— এঁদের বাবা। কন্যা সন্তানও ছিল তাঁর। তো জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর তিনি গ্রন্থকারও ছিলেন। তাঁর লেখা বইয়ের নাম— ‘মুদির দোকান’, ‘কলকাতার চলাফেরা’, এছাড়াও আরও কয়েকটি বই তিনি লিখেছিলেন।

সুভো ঠাকুরের বিপুল আর্ট ও অ্যান্টিক সংগ্রহ— বিভিন্ন ধরনের দোয়াত, জামেওয়ার, গ্লাস পেইন্টিং, হুঁকো, গড়গড়া, পারফিউম বটল, ওয়াইন বটল, ডিকেন্টার, বিভিন্ন রাজবাড়ির কোর্ট অফ আর্মস তার মধ্যে পাথুরিয়া ঘাটার ঠাকুরবাড়ির কোর্ট অফ আর্মস, সেলার, মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, প্রদ্যোত কুমার ঠাকুরদের ব্যবহার করা জিনিসপত্র, সবই নাকি বিক্রি হয়ে গেছে লক্ষ লক্ষ অথবা কোটি কোটি টাকায়। সুভো ঠাকুরের সংগ্রহে ছিল নানা ধরনের কলম— হ্যান্ডেল-কলম থেকে ফাউন্টেন পেন— ঝর্ণা কলম। কাচ, পোর্সেলিন, পাথর, পোড়া মাটির, টেরাকোটা, কাঠ, মোষের শিং, পেতল— সব ধরনের উপাদান দিয়ে তৈরি করা দোয়াত— মস্যাধার— ইঙ্কপট ছিল সুভগেন্দ্রনাথের সংগ্রহে। জওহরলাল নেহরু রোতে একদা আমেরিকান লাইব্রেরির ওপর সুভো ঠাকুরের ফ্ল্যাটে কাচের শো কেসের ভেতর দোয়াতেরা। সুভো ঠাকুর দাবি করতেন বঙ্কিমবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শবযাত্রার মালা, নেপোলিয়ঁ বা নেপোলিয়নের কাচের তৈরি দোয়াত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখার টেবিল, লর্ড ক্লাইভের কাচের হুক্কা— সব আছে তাঁর সংগ্রহে। সেইসঙ্গে পিতলের অজস্র কলম, গ্লাস, নানা ধরনের নাট ভাঙার সামগ্রী— সব মিলিয়ে বিপুল আর্ট ও অ্যান্টিকের সংগ্রহ।

Powered by Froala Editor