রবিশঙ্কর: বাবাকে প্রথম দেখলেন যখন তাঁর বয়স আট

শঙ্কর সরণি - ২৩
আগের পর্বে

উদয়শঙ্করের প্রতিষ্ঠা আর বিকাশের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে আরও একটি নাম। তাঁর ছোট ভাই রবিশঙ্কর। রবিশঙ্করের জন্মের সময় উদয় বিলেতে। পিতাকে কখনও কাছ থেকে পাননি রবিশঙ্কর। মাকে দেখেছেন সংসার চালাতে নিয়ত যুদ্ধ করে যেতে। পরিবারের সম্মান বাঁচাতে রাতের অন্ধকারে বিক্রি করে গিয়েছেন নিজের সমস্ত অলঙ্কার। সেইসঙ্গে গ্রাস করেছে একাকিত্ব। ছোট থেকে মায়ের এই কষ্ট দেখে বড়ো হওয়ার ফলেই রবিশঙ্করের মধ্যে জন্ম নিয়েছিল একটা Anti-Father Feelings। তাঁর চরিত্রের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল বর্ণনার দক্ষতা। ছোট থেকে বইই ছিল তাঁর সঙ্গী। ৫ বছর বয়সের আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল পড়াশোনা। সেইসঙ্গে ছাপ ফেলেছিল কাশীর মনোরম দৃশ্য ও তার বিচিত্র জীবনযাত্রা।

রবিশঙ্কর বাবাকে প্রথম দেখলেন, তখন তাঁর বয়স আট। লম্বা, ফর্সা। টকটকে গায়ের রঙ। ভীষণ দামি স্যুট। ওডি কোলোনের গন্ধে ভেসে আছে চারপাশ। যেন সত্যি সাহেব। বাবাকে দেখে হাঁ হয়ে রইলেন তিনি। বাবার চিঠি আসত। বাবা নয়। ১৯২৮-এ এলেন শ্যামশঙ্কর। উঠলেন কাশীর বিখ্যাত অভিজাত হোটেল, হোটেল দে প্যারিস-এ। ইতিমধ্যে ১৯২৫-এ মারা গিয়েছেন তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী মিস মোরাল। শ্যামশঙ্করের সঙ্গে এসেছেন মিস জোনস। মিস মোরালের বোন। আর এসেছেন তাঁর সাম্প্রতিক বান্ধবী ম্যাডাম হেনি। বাবা এসে প্রথমেই রবিশঙ্করকে শেখালেন, আদবকায়দা। ওঠা-বসার রীতি রেওয়াজ।  একদিন নিয়ে গেলেন হোটেলে। হোটেলের অন্দরসজ্জা দেখে থ হয়ে রইলেন তিনি। কাশীর ভেতর এ কোন জগৎ, এক্কেবারে আনকোরা, অপরিচিত। বিলাসী পরিবেশ। বাবা হুকুম করলেন ব্রেকফাস্ট। বেয়ারা ঢুকল, সে কী রাজকীয় বন্দোবস্ত। এগ, বেকন সব সাহেবি খানাপিনায় ভরে উঠল টেবিল। রবিশঙ্করকে মেম বললেন, here is the chair, hold it, fork on the left hand। খাবার আগে এত কী কাণ্ড! হতবাক বালককে অনুবাদ করে দিলেন বাবা। সে যাত্রায় দশদিন ছিলেন শ্যামশঙ্কর। তারপর তাঁকে দেখেছিলেন, দু-বছর পর।

মাকে ভালোবেসেছিলেন রবিশঙ্কর। মায়ের বেদনাকে, দুর্দশাকে দিনের পর দিন কাছ থেকে দেখেছিলেন বলে, তৈরি হয়েছিল একটা ‘anti-father feeling’। নিজেই বলেছেন সেকথা। কিন্তু খেয়াল করব, জীবনে অপ্রাপ্তি আর অবহেলাকে হাহুতাশে করে তোলেননি অধিকতর রিক্ত। বরং খুব আশ্চর্য লাগে, তাঁর জীবনকে দেখা। নিজেরই জীবনকে তিনি দেখেছেন অন্যতর এক দ্রষ্টার ভূমিকায়। আসক্তি আর স্বার্থের ছোঁওয়া বাঁচিয়ে দেখেছেন বলে, ধরা পড়েছে একই সত্যের বহুতর মাত্রা। বহুতর অভিমুখ। পিতার প্রতি অভিমান নিশ্চয়ই ছিল, কিন্তু শ্যামশঙ্করের অগাধ পাণ্ডিত্য, সারস্বত সাধনায় তাঁর বিচিত্র গতিবিধির খবরাখবর তিনিই দিয়েছিলেন জগৎসংসারকে। সংসারের প্রতি অবহেলা ছিল শ্যামশঙ্করের, নিজের প্রতিও ছিল অমনোযোগ। জেনিভায় লিগ অব নেশনে ছিলেন। মালব্যজীর সঙ্গে বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। বন্ধু ছিলেন ইয়েটস-এ্রর। গৃহশিক্ষক ছিলেন ঝারোয়ারের রাজপুত্রের। এস্টেটের যদযাবতীয় শিক্ষা বিষয়ক ব্যপার-স্যাপার দেখাশোনা করতেন তিনি। সেখানকার বিপুল সম্ভারের লাইব্রেরি গড়ে তুলেছিলেন কঠিন পরিশ্রমে। ডবল এম এ করেছিলেন। ডক্টরেট করেছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। নতুন ভাষা জানার আগ্রহে, শিখলেন ফ্রেঞ্চ। আইন পড়েছিলেন, পরে চলে যান প্রিভি কাউন্সিলে। সেখানে বার অ্যাট ল করলেন। কিন্তু ইতিহাস তার হদিশ পায়নি। কারণ জ্ঞান-কর্মের রঙ্গিবিরঙ্গিতে মজে থাকত শ্যামশঙ্করের মন, আত্মপ্রচার আর আত্মপ্রতিষ্ঠা জুতসই ঠেকেনি তাঁর কাছে। 

রবিশঙ্কর

 

বৈভববিকীর্ণ শৌখিন ছিল  তাঁর যাপন,  একথা ঠিক। তবে ছিল, অন্য একটি বিপ্রতীপ সত্যও। আবু পাহাড়ে শ্যামশঙ্কর দু-বছর ছিলেন যোগসাধনা শিখতে। ছিলেন এক যোগীর কাছে। সামগান শিখতে চষে ফেলেছিলেন দক্ষিণ ভারত, পুনে, বেনারস সবখান। দেখতে চাইছিলেন একই সংগীত প্রত্যেক ঘরানায় গিয়ে কীভাবে ধরতে চায় নতুন চলন। কাশীতে দু-বছর শিখলেন ধ্রুপদ। সেসব নেশা যে কৃচ্ছ্রসাধনের, সে কথা বলে দিতে হয় না। গৃহের অনটনের হদিশ পাননি, হদিশ পাননি নিজের অর্থ উপার্জনের গুরুত্বেরও। দান করার মর্জিতে বাছবিচার ছিল না, সেইজন্যই দানের প্রয়োজনীয় ক্ষেত্র কী হওয়া উচিত ভাবায়নি সেই কথাখানাও। এসবের হালহকিকত জানিয়ে রবিশঙ্কর বলেন, ‘এটা একটা পিকুইলিয়র ব্যাপার ছিল’। তবে মজার কথা হল, শ্যামশঙ্করকে আপাতভাবে জানলে পিকুইলিয়র, অদ্ভুতুড়ে আর মনে হয় নির্মম। সে কথা অব্যর্থ। কিন্তু সেইসব তথ্যের সঙ্গে তার আশপাশের আনদেখি আনশুনি কথাকাহিনি প্রকাশ করে স্বয়ং রবিশঙ্করই তাঁকে করে তোলেন মরমী।

আরও পড়ুন
রবিশঙ্কর: সেই থেকে তৈরি হয়েছিল একটা অ্যান্টি- ফাদার ফিলিং

এতদসত্ত্বেও হেমাঙ্গিনীর প্রতি  তাঁর  ঔদাসীন্য নিষ্ঠুর হয়ে বাজে। বিবাহে স্বামীর আশ্বাসভঙ্গ কোনখানে মুচড়ে তোলে  শোক-অসম্মান, কী অপার সেই বেদনা। অথচ গভীর সেই ক্ষতকে নিশ্চুপ ধারণ করেছিলেন হেমাঙ্গিনী। সন্তান প্রতিপালন করেছিলেন প্রশান্ত ধৈর্যে। রবিশঙ্কর জানিয়েছিলেন, ‘মা’র এই কষ্টটা আমি বুঝতাম।… মার সঙ্গে আমার একটা অদ্ভুত ফ্রেন্ডশিপ ছিল। তবে মা কখনও নিজের দুঃখটা প্রকাশ করতেন না।’ নিজের শৈশবকে রবিশঙ্কর আসক্তির অনুরক্তিতে গ্রহণ করেছিলেন। আবার একই ঘটনাকে বুঝতে চেয়েছিলেন, নিরাসক্ত যুক্তিসন্ধানে। বলেছিলেন, ‘বাবার ব্যাপারটা খানিকটা আমি বুঝতে পারি—সাইকোলজিক্যাল। …they were very little together from the very beginning’। উত্তরপ্রদেশের গাজিপুর, তারও বারো-তেরো মাইল ভেতরে ছিল হেমাঙ্গিনীর পিতৃনিবাস। ‘কাজেই ওঁর পুরো কালচারটাই অন্যরকম ছিল’। মায়ের অক্ষমতার বাস্তবক্ষেত্রটিকে বোঝবার চেষ্টা করেন তিনি। এইসমস্ত কথার স্রোতেই যুক্ত করেন,  বাংলা থেকে বহুদূর ওইরকম প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেড়ে ওঠায় পরিণতির সুযোগ পায়নি তাঁর বাংলা লেখা। ‘এই জন্য ওঁদের কিছুতেই মিল হত না’। দূরবর্তী সম্পর্কে পত্রযোগেও দাম্পত্যকে জিইয়ে রাখায় হেমাঙ্গিনীর অসহায়তা এইবার কী তীব্র হয়ে বেজে ওঠে। অনুতাপ নয় আক্ষেপ নয়, হাহাকার নয়, কী অমল জীবনবোধে তিনি খুঁজেছেন তাঁর শৈশব আর তাঁর সংকটকে।

আরও পড়ুন
আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাইনে তোমারে

মেরি পিকফোর্ড

 

আরও পড়ুন
ঈশ্বর তোমাকে নৃত্যের জন্যই গড়েছেন

এইখানে জুড়ে নেওয়া   দরকার একখানা কথা। আমরা লক্ষ করব, একই পরিস্থিতি একই সত্য অথচ প্রতিটি মানুষের পরিপ্রেক্ষিত থেকে তা কেমন স্বতন্ত্র, কেমন অভাবনীয় রকমের অদ্বিতীয়। মনে করা দরকার, শ্যামশঙ্করের বেবাক নির্লিপ্তিতে কাশীতে তখন তাঁর সংসার যুঝছে আকণ্ঠ অনটনে। অথচ এ সত্য পৃথিবীর আরেক ক্ষেত্রে গিয়ে তৈরি করছে সত্যকে দেখার আরো এক বেদি। ঠিক সেই সময়ই বিদেশে শ্যামশঙ্কর ব্যাপৃত রয়েছেন ভারতীয় সংস্কৃতিকে বিশ্বলোকে পৌঁছে দেওয়ার কাজে। তৎসমকালের পক্ষে কী অভিনব পদ্ধতিতে তিনি বক্তৃতার সঙ্গে জুড়ে নিচ্ছেন পারফর্মিং আর্টকে। চিত্রকলায় পারদর্শিতার খবরে তাঁরই ইচ্ছায় উদয়শঙ্কর পাড়ি  দিলেন বিদেশ, যোগ দিচ্ছেন রয়্যাল আর্ট কলেজে। তাঁরই একান্ত ইচ্ছা আর উদ্যোগে উদয়শঙ্কর যুক্ত হচ্ছেন নৃত্যকলার সঙ্গেও। মনে পড়বে, এই সময় থেকেই পিতা আর তাঁর জ্যেষ্ঠ সন্তান প্রথম এসে দাঁড়ালেন বাৎসল্য আর প্রতিবাৎসল্যের গণ্ডিতে। বদলে গেলেন শ্যামশঙ্কর। 

আরও পড়ুন
নৃত্য সেদিন পেরিয়ে গেল মঞ্চের সীমা

কাশীতে তাঁদের বাড়ির পাশেই ছিল শ্রীশ দে-র বাড়ি। মস্ত জমিদার তাঁরা। আকাশ ফুঁড়ে ওঠা বাড়ির গেট। গাড়ি, জুড়ি, মোটরে ছয়লাপ চারদিক। খিলান করা বারান্দা। ওই বাড়ির বড়মানুষি কাণ্ড-কারখানা দেখতে দেখতে হুশহুশ করে কেটে যেত দিন। নিজেদের দুরবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়ে সেই প্রথম তাঁর আতিশয্যকে দেখা। একদিন টেনিস খেলার সুবাদে সেখানে যাতায়াত শুরু হল দেবেন্দ্রশঙ্করের। কী কারণে তিনিও গেলেন একদিন। সকলেই তাঁকে টেনে নিয়ে গেল ভেতর মহলে। খুব আদর যত্ন করে খেতে দিল তাঁকে। এমন খাতির তিনি চোখে দেখেননি কখনও। শ্বেতপাথরের থালায় এসে পড়ল গরম গরম পুরি। থালার চারপাশ ঘুরে শ্বেতপাথরের বাটিতে রকমারি তরকারি। মেঠাই। সাজিয়ে দেওয়ার সে কী ধুম। কে জানে কেন কিন্তু সে বাড়িতে সকলেই তাঁকে ভালোবাসত খুব। সমবয়সী এক বন্ধু হল। কবে যেন হয়ে উঠলেন বাড়িরই একজন। এই সূত্রেই প্রথম তিনি চেয়ে দেখলেন ধনাঢ্যের অভিজাত যাপন। আসলে জীবনের মধ্যে যে বনেদি নান্দনিক পারিপাট্য, ওই শৈশবেও সেই জরুরি কথাটা স্পর্শ করেছিল তাঁর মনকে।  

লিলিয়ন গিশ

 

সে যুগেও কাশীতে সিনেমার ছিল প্রভূত হাঁকডাক। ভিড়ত এলমো লিঙ্কনের টারজান। মেরি পিকফোর্ড। সঙ্গে জগৎবিখ্যাত সব ছবি। লিলিয়ন গিশ তাও ছিল। এত আনন্দ আয়োজন। রবিশঙ্কর বলেছেন, তবু একরাশ একাকিত্ব যেন ছেয়ে থাকত তাঁর দিবারাত্র। কাশীর বারোয়ারি দুর্গাপুজোর সবচেয়ে বড় উত্তেজনা ছিল নাটক। প্লে দেখতে দেখতে তাঁর বয়সীরা সব ঢুলত, কিন্তু চোখের পাতা পড়ত না তাঁর। দ্বিজেন্দ্রলালের নাটক তাঁর প্রিয় ছিল খুব। এছাড়াও ছিল বঙ্কিমচন্দ্র, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ। রাজসিংহ, কৃষ্ণকান্তের উইল, বিল্বমঙ্গল। রাত জুড়ে বালকের বিস্ময়ে লেগে যেত রোশনাই।

একবার ঘটল এক ঘটনা। দেবেন্দ্রশঙ্করদের ক্লাব করল এক নাটক। সে নাটকে হিরোর কী প্রখর উপস্থিতি। দুঃসাহসী অভিযান। তেমনই চমৎকার নায়িকা। কালো কালো ডাগর দুই চোখ। কী অপরূপ শোভা। অমন সৌন্দর্যে যুগে যুগে প্রাণপাত করেছে পুরুষ। রবিশঙ্কর তখনও বালক। তবু তাঁর মজলিসি ধরনে পরবর্তীকালে সে ঘটনা মনে করে, তিনি বলেছিলেন, তো সেই নায়িকাকে দেখে, ‘আমি তো পাগল হয়ে গেলাম। ছোটোবেলা থেকেই আমার সুন্দরী মহিলা দেখলেই প্রেমে পড়া অভ্যেস ছিল। সে ছোটো হোক, বড়ো হোক। মানে আমি ভীষণ romantically involved হয়ে যেতাম। And I used to fantasise। কী fantasise করতাম জানি না। কিন্তু I used to fall in love from that stage’। সেসব শুনে-টুনে দেবেন্দ্রশঙ্করের এক বন্ধু, সে বললে, চল, তার সঙ্গে দিই আলাপ করিয়ে। ধড়াস-ধড়াস উথাল-পাথাল করছে বুক। ব্যাক স্টেজ পর্যন্ত যাত্রা, সে পথ যেন ফুরায়ই না। কাছে গিয়ে যখন দেখলেন তাকে, থমকে বাক্যস্ফূর্তি হল না কিছুক্ষণ। যত দূর সম্ভব হাঁটুর ওপর তোলা শাড়ি। বেরিয়ে আছে কালো কালো লোমশ দুটো ঠ্যাং। পরচুলটা পাশে খুলে রেখে, মনের সুখে সে পুরুষ মানুষ টানছে বিড়ি। 

Powered by Froala Editor