মাইহারে অসম্পূর্ণ রইল তিমিরবরণের শিক্ষা

শঙ্কর সরণি - ১৭
আগের পর্বে

ভারতবর্ষে এসে উদয়শঙ্কর একটি প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজেছিলেন। কী ঘরানা তাঁর নৃত্যের? এমন প্রশ্নের কাছে তাঁকে নিরুত্তর থাকতে হত। কিন্তু নৃত্য পরিবেষণের ইচ্ছা থেকেই গেল। এই সময়েই উদয় দেখা করলেন ইম্প্রেসারিও হরেন ঘোষের সঙ্গে। হরেন ঘোষের সূত্র ধরেই আলাপ হল সাহিত্যিক হেমেন্দ্রকুমার রায়, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গেও। প্রত্যেকেরই ভালো লেগে গেল শান্ত, বুদ্ধিদীপ্ত উদয়শঙ্করকে। ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ ওরিয়েন্টাল আর্টস থেকে আয়োজন করা হল উদয়শঙ্করের একক নৃত্য়ানুষ্ঠান। এরপর উদয়শঙ্করের আলাপ হল তিমিরবরণ ঘোষের সঙ্গে। বিচিত্র মানুষটির জীবনে নানা অভিজ্ঞতা। খোদ আমির খাঁ সাহেবের কাছে সরোদ শিখেছেন তিমিরবরণ। উদয়শঙ্করের জীবনে এই পরিচয় স্থায়ী প্রভাব রেখে যাবে।

শিবু ঠাকুরের গলি আর জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি ছিল অদূরবর্তী। মিহিরকরণ প্রায়ই যেতেন কবির কাছে নানা কাজে। রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরাদেবীর বাড়িতে একদিন বসেছিল আসর। তিমিরবরণ সেখানে বাজিয়েছিলেন সরোদ। তিমিরবরণের গুণপনার কথা অশ্রুত রইল না কবির কাছে। অতঃপর যেদিন ঠাকুর বাড়িতে গেলেন মিহিরকরণ, রবীন্দ্রনাথ বললেন, তোমার ভাই এমন বাজায়, আর সে কথা আমি কি না শুনলাম অন্যের কাছে? আয়োজন করা হল। সরোদ নিয়ে ঠাকুরবাড়িতে এলেন তিমিরবরণ। আজও তবলায় তাঁকে সঙ্গত করবেন শিশিরশোভন। তিমিরবরণ চরণ স্পর্শ করলেন রবীন্দ্রনাথের। তারপর তার ছাড়লেন তাঁর প্রিয় রাগে। রাগ পুরিয়া ধানেশ্রী। টানা প্রায় একটি ঘণ্টা চলল সেই রাগবিস্তার। সকলে দেখলেন, চোখ বন্ধ, আত্মস্থ, শুনছেন কবি। একটি বারের জন্যও খুললেন না চোখের পাতা। শুধু তালের ঝোঁকে বার কয়েক মৃদু নড়ে উঠল মাথা। সুর থামতে আরো কিছুক্ষণ ধ্যানস্থ রইলেন কবি। তারপর চোখ মেলে সস্নেহ তাকালেন, নিতান্ত অর্বাচীন এই গুণীটির দিকে।  বললেন, শুনলাম তুমি মাইহার যাচ্ছো। ফিরে এসে শান্তিনিকেতনে এসো। তোমাকে আমার দরকার।

আলাউদ্দিন খাঁ শর্ত দিয়েছিলেন তিমিরবরণকে, তিনি শেখাবেন, তবে তার আগে তাঁকে আনতে হবে গুরুর অনুমতি। প্রিয় শিষ্যকে ছেড়ে দিতে ভেতরের মোচড়টি ব্যথিয়ে তুলল সমস্ত অন্তর। তবু হাসিমুখে, উদারচিত্তে তিমিরবরণকে বিদায় দিলেন আমির খাঁ সাহেব। ধীরে তাঁর জীবনেও এসে জুটলেন আরো দুই প্রতিভাধর। বাণীকণ্ঠ মুখোপাধ্যায় আর রাধিকামোহন মৈত্র। তিমিরবরণ এসে পড়লেন, তখনকার গণ্ডগ্রাম মাইহারে। তখনও আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের কোনো শিষ্য ছিল না। তিনি গান শেখাতেন মাইহারের রাজাকে। গান শেখাবেন কথা দিলেন রাজাকে, কিন্তু একথাও জানালেন, সংগীত শিক্ষাদানের জন্য তিনি গ্রহণ করবেন না কিচ্ছু। সংগীত তাঁর ইবাদত। তিনি পালন করবেন গুরুর ধর্ম। নিশ্চুপ রইলেন রাজা। গুরুর স্বধর্মকে মর্যাদা দিলেন তিনি। কিন্তু তিনিও রাজা, পালন আর আশ্রয় যে তাঁরও স্বধর্ম। অবস্থা বুঝে খাঁ সাহেবকে, রাজা দিলেন যাবতীয় দেবত্র সম্পত্তির দায়িত্ব। এইবার পেশ করলেন তাঁর অনুনয়, সাম্মানিকটুকু গ্রহণ না করলে যে বিঘ্নিত হবে তাঁরও রাজধর্ম। শিষ্যের ছলটুকু বিলক্ষণ টের পেলেন বাবা। দেড়শত টাকা স্থির হল তাঁর সাম্মানিক। স্থির হল রাজার ইচ্ছায় তিনি গড়ে তুলবেন মাইহার ব্যান্ড।

জনমানবশূন্য মাইহারে গিয়ে তিমিরবরণ পড়লেন অথৈ জলে। কিন্তু সংগীতের মহাসাগরে মগ্ন মৈনাকের মতো পান করলেন সুরধারা। কঠিন পরিশ্রমে ব্রতী রইলেন। গ্রীষ্মের সময় রেওয়াজ করতেন সারারাত। মরুভূমির নৈঃশব্দ্যে অনৈসর্গিক হয়ে বাজত তাঁর ঝালা। শীতের রাতে কনকনে ঠাণ্ডায় বরফের মতো জমে থাকত হাত। বসতেন রাত তিনটেয়, থামতেন সকাল দশটায়। পাঁচটা বছর গড়িয়ে গেল এমনিভাবে।

এবার বাড়ি ফিরলে দাদা মিহিরকরণ তাঁর বিবাহ সম্পন্ন করলেন। ঠিক তার পরপরই তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল হরেন ঘোষের। হরেন ঘোষই তাঁকে আমন্ত্রণ জানালেন পরেরদিন সন্ধ্যায় উদয়শঙ্করের নৃত্যানুষ্ঠানে। পরেরদিন তিমিরবরণ গেলেন উদয়শঙ্করের অনুষ্ঠানে। আর তাঁর জীবন বইতে লাগল অন্য খাতে। 

আরও পড়ুন
সুরের ঝরনাধারার নির্জনে ছিল এঁদের বাস

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তিমিরবরণ ও শিশিরশোভন।

 

আরও পড়ুন
তাঁর জীবনে দেশ এল, বিদ্বেষের ধারাটি সঙ্গে নিয়ে

উদয়শঙ্করের জীবনকে বিস্তারিতভাবে, পরম নিষ্ঠায়, অতীব যত্নে রচনা করেছিলেন শ্রীসুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায়। উদয়শঙ্করের সান্নিধ্যেই তিনি করছিলেন সেই কাজ। ১৯৭৩-৭৪ সালে তা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় ‘দেশ’ পত্রিকার পাতায়। সেই সুধীরঞ্জন যখন উদয়ের জীবনে তিমিরবরণের আবির্ভাবকে রচনা করছিলেন,   তখন নির্মোহ জীবনীলেখকের মতোই একটি উক্তিতে তিনি ব্যক্ত করেছিলেন তাঁর মনোভাব। লিখেছিলেন, উদয়শঙ্করের নাচ দেখতে গিয়ে, ‘ভাগ্যলিপি পরিবর্তন হয়ে গেল তিমিরবরণের। যিনি হতে পারতেন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সরোদ শিল্পী— তিনি লুপ্ত হলেন, হারিয়ে গেলেন বিস্মৃতির অতলে।’ বলেছিলেন, ‘এক প্রতিভার বিকাশ, আর এক প্রতিভার বিনাশ। উদয়শঙ্কর হলেন দিগ্বিজয়ী নৃত্যবীর। আর তিমিরবরণ? তিনি হলেন উদয়শঙ্করের চাকচিক্যময় নৃত্যমঞ্চের নৃশংস বলি।’ তবে সেকথা আপাতত থাক। এখনও বহুদূর সেসব।

আরও পড়ুন
যা আমি খুঁজছিলাম, সেই সমস্ত কিছু ধারণ করেছিল উদয়

ফিরে আসি ফেলে রাখা কথায়। উদয়শঙ্করের অনুষ্ঠানের সময়কাল এক ঘণ্টা। ছোট্ট স্টেজ। পেশাদারি নয়, অনুষ্ঠান মূলত ঘরোয়া। তাঁর সঙ্গে সঙ্গত করবেন প্রখ্যাত বেন্টেলম্যান ভ্রাতৃদ্বয়। একজন বাজাবেন বেহালা অন্যজন পিয়ানো। সেদিন প্রাচ্য চিত্রকলা ভবনে উদয়শঙ্কর পরিবেশন করলেন মোট চারটি নৃত্য। ইন্দ্র, গন্ধর্ব, শিব এবং শেষে বধূবেশে মারোয়ারি নৃত্য। অনেকখানি দ্বিধা, সংশয় আর অস্বস্তি নিয়ে সেদিন হাজির হয়েছিলেন দর্শককুল। আয়োজকদের মধ্যেও ছিল ঈষৎ উদ্বেগ। কলারসিকের নজরে পরখের ভ্রুকুটি। কিন্তু নৃত্যের পরতে পরতে মুদ্রা-অভিনয়-অঙ্গ সঞ্চালনের অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতায় দর্শক প্রথম শিশুর সারল্যে চেয়ে দেখলেন। তারপর কোন মুহূর্তে হয়ে পড়লেন একাত্ম, খেই রইল না আর। বিমোহিত, উন্মুক্ত হৃদয়ে উদয়শঙ্করকে গ্রহণ করলেন ভারতীয় দর্শক। ভিন দেশ ভিন দেশি মানুষ নয়, তাঁকে গ্রহণ করেছে তাঁর ‘ঘর’। সেদিন বাকরুদ্ধ হয়ে রইলেন উদয়। আর মন্ত্রমুগ্ধ তিমিরবরণ।

আরও পড়ুন
তাঁর আশ্রয় উদয়ের জন্য থাকবে সদা অবারিত

অনুষ্ঠানের শেষে উদয়শঙ্করকে একদিন নিজের বাড়িতে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন তিমিরবরণ। তিনি তাঁর বাজনা শোনাতে চান তাঁকে। উদয় খুশি হলেন খুব। তাঁকে নিয়ে যাবার দায়িত্ব নিলেন তরুণ সুভো ঠাকুর। রবিশঙ্কর বলেছিলেন, ‘তিমিরদাদের বাড়িটা ছিল একটা গানের আখড়া। ওটা সংগীতের তীর্থস্থানও বলা যায়।’ এই বাড়িতে তখন নিয়মিত যাতায়াত ছিল অতুলপ্রসাদ সেন, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ধূর্জটি মুখোপাধ্যায়, ডঃ সত্যেন বোস, কাজী নজরুল প্রমুখদের।

গুরু আলাউদ্দিন খাঁ-এর সঙ্গে তিমিরবরণ।

 

এ প্রসঙ্গে আমির খাঁ সাহেবের রয়েছে এক অতুলনীয় কীর্তিকাহিনি। আমির খাঁ সাহেব বড়বাজারের এই শিবু ঠাকুরের গলিতে এসেই তালিম দিতেন তিমিরবরণকে। মেছুয়াবাজারে তাঁর বাড়ি থেকে বেশি দূর নয়, ভট্টাচার্যি বাড়ি। একদিন ঘোর দুর্যোগ। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে সেদিন। বিকেলে তাঁর শিষ্য বাড়ি যাবার কথা। ধোপ-দুরস্ত চুড়িদার-পায়জামা পড়ে প্রস্তুত তিনি। কিন্তু না, আকাশ সেদিন মেতেছে খেলায়। সে নাছোড়। গুমরি গুমরি মেঘ গরজে গগনে। অপেক্ষায় প্রহর কাটে খাঁ সাহেবের। কলকাতার রাজপথে ততক্ষণে আছড়ে পড়ছে গভীর তরঙ্গ। খাঁ সাহেব চুড়িদার-পায়জামা পরিবর্তন করে, পড়লেন কুর্তা-লুঙ্গি। হাঁটু পর্যন্ত তুলে কষে বাঁধলেন সেটাকে কোমরে। তারপর জল-ভেঙে ভট্টাচার্যি নিবাস যখন দেখতে পেলেন দূরে, অমল এক হাসি ফুটে উঠল তাঁর বৃষ্টিস্নাত চেহারায়। শ্রাবণ ঘন বরিষধারার বিশ্বভুবন মাতাল করে ভেসে চলেছে তিন ভাইয়ের বাজনার অপূর্ব সুর-মূর্ছনা। দরজা খুলে হতবাক তিমির, কেমনভাবে এলেন তিনি? স্মিত হেসে, খানিক লজ্জা পেয়ে ওস্তাদ শুধু বললেন, প্রকৃতি সুরের এমন মেহফিল সাজিয়েছে আর আজই সংগীত বেজুবান থাকবে, তা হয় না।    

মাইহারে তিমিরবরণ আলাউদ্দিন খাঁকে দেখেছিলেন, রাজার অনুরোধে তিনি গড়ে তুলেছিলেন মাইহার ব্যান্ড। সেই ধাঁচে তিমিরবরণও বাড়ির সকলকে নিয়ে তৈরি করেন ফ্যামিলি অর্কেস্ট্রা। বলাবাহুল্য, এই ব্যান্ড মূলত বাড়ির সকলকে নিয়ে হলেও এঁরা প্রায় প্রত্যেকেই ছিলেন গুণী, সংগীতবোদ্ধা এবং এক-একজন দিকপাল। বেহালা মিহিরকরণ বাজাতেন, শিশিরশোভন তবলা। মিহিরকরণের পুত্র অমিয়কান্তি, ভাগ্নে ধ্রুবজ্যোতি আর ভাগ্নী সবিতা বাজতেন সেতার। আরেক ভাগ্নী লতিকা, এসরাজে তাঁর ছিল অসম্ভব সুন্দর হাত। ভাইঝি সুনীতি আর বাসন্তীও বাজাতেন সেতার। এর সঙ্গে ছিলেন আরো কয়েকজন পারিবারিক বন্ধু। ছিলেন অনাদি দস্তিদার, বাজাতেন বীণ।  ক্যালকাটা কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কের ডিরেক্টর ছিলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, তিনি ধরতেন বেহালা। আনন্দবাজার পত্রিকার কর্ণধার অশোককুমার সরকার বাজাতেন সেতার। ছিলেন নাহার পরিবারের বিক্রম সিং নাহার, তিনিও বাজাতেন সেতার আর জিতেন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত সুর তুলতেন সুরবাহার-এ।

পরের দিনই অ্যালিস বোনারকে সঙ্গে নিয়ে উদয়শঙ্কর আর সুভো ঠাকুর এলেন শিবু ঠাকুরের গলিতে। তিমিরবরণ এবং তাঁর ফ্যামিলি অর্কেস্ট্রায় হতবাক হয়ে রইলেন উদয়শঙ্কর। যেমন বাজনা তেমনি প্রতিটি যন্ত্রের মধ্যে সংযোগস্থাপন, অতুলনীয় এঁদের সমন্বয়নির্মাণ। যন্ত্র আর যন্ত্রীরা যেন পারস্পরিক স্বচ্ছন্দ সুরের ভাষায় মেতে রয়েছেন নিজস্ব আলাপচারিতায়। উৎকর্ষের এই উচ্চতাকে কল্পনা করেননি তিনি, একথা তাঁকে স্বীকার করতেই হল। ঈশ্বর যেন তাঁর আকাঙ্ক্ষাকে মূর্ত করে তুলতেই, পাঠিয়েছেন সাক্ষাৎ দেবদূত। মুগ্ধতার অবধি রইল না অ্যালিস বোনারেরও। সকল শিল্পীকে তাঁর অনিবার ভালো লাগাটি প্রকাশ করলেন উদয়। ঠিক পরের দিন নিমন্ত্রণ জানালেন মিহিরকরণকে, অ্যালিস বোনারের পার্ক স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে।   

তিমিরবরণের সরোদ শিক্ষার গুরু আমির খাঁ সাহেব।

 

প্রশস্ত একটি ঘর। ঘরে রয়েছে অ্যালিস আর উদয়ের সংগৃহীত চেনা-অচেনা কত রকম বাদ্যযন্ত্র। ঢাক, ঢোল, মৃদঙ্গ, খোল, খমক, করতাল, গুপীযন্ত্র, পাখোয়াজ, বাঁশি, শিঙা প্রভৃতি কতকিছু। বাদ্যযন্ত্র আর তিমিরবরণের আত্মিক সম্বন্ধ কার না-জানা? ভারতীয় অর্কেস্ট্রার জনক তিনি। বিহ্বল হয়ে পড়লেন তিমিরবরণ। হরেক যন্ত্র আর তাঁর আন্তঃসম্পর্ক সৃষ্টি অধুনা তাঁর সবচেয়ে আগ্রহের বিষয়। অত্যন্ত সন্তর্পণে মিহিরকরণের কাছে উদয় রাখলেন তাঁর ইচ্ছা বা তাঁর স্বপ্নের কথাটি। নিজের দল গড়ার কথা বললেন উদয়, জানালেন বিষ্ণুদাস শিরালীর কথা। তারপর বললেন, তিমিরবরণকে তাঁর দলে পাওয়ার অনুমতিটি তিনি কামনা করেন তাঁর কাছে।

অনুমতি দিলেন মিহিরকরণ। মাইহারে অসমাপ্ত রইল তিমিরবরণের শিক্ষা। তিমিরবরণ যোগ দিলেন উদয়শঙ্করের দলে। ইতিমধ্যে হরেন ঘোষের প্রত্যুতপন্নমতিত্ব আর কর্ম পরিকল্পনায় ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের মধ্যেও উদয়শঙ্করকে নিয়ে তৈরি হল জিজ্ঞাসা। মুহূর্তের গুরুত্ব বুঝলেন হরেন ঘোষ। স্থির হল উদয়শঙ্কর এবার অনুষ্ঠান করবেন সর্বসাধারণের জন্য। সাতদিনের জন্য ভাড়া নেওয়া হল নিউ এম্পায়ার প্রেক্ষাগৃহ। তিমিরবরণ আর তাঁর পারিবারিক ব্যান্ডের ওপর দায়িত্ব এসে পড়ল সংগীতের।

এগারো জনের অর্কেস্ট্রায় নিজেকে আপামর ঢেলে প্রস্তুত করলেন তিমিরবরণ। এইধরনের কাজের মধ্যে তিনি দেখতে চাইছিলেন নিজেকে। দু থেকে আড়াই ঘণ্টার অনুষ্ঠান। ইন্দ্র, গন্ধর্ব, শিব এবং শেষে বধূবেশে মারোয়ারি নৃত্যের সঙ্গে এবার যুক্ত হল ছোরা ও অসি নৃত্য। প্রথমবার উদয়শঙ্করের অনুষ্ঠানে তিমিরবরণের মনে হয়েছিল, এই প্রকরণের নৃত্যে বিদেশীয় যন্ত্র ভারি বেখাপ। যথোপযুক্ত ভারতীয় যন্ত্রানুসঙ্গেই এর পূর্ণতর রূপটি লাভের একটি সম্ভাবনা রয়েছে। নিজে সেই কাজের ভারটি পেয়ে কোথাও এতটুকু ফাঁক রাখলেন না তিনি। অনুষ্ঠান সম্পন্ন হল। অব্যর্থ ছিল তিমিরবরণের ভাবনা। একে ভারতীয় যন্ত্রানুসঙ্গ তায় তিমিরবরণদের ঘরানার প্রশিক্ষিত উচ্চমার্গের ধ্রুপদী সংগীতের সংযোগ, যেন সৌরমণ্ডলের আলো এসে প্রস্ফুটিত করে তুলল উদয়শঙ্করের নৃত্যলোক। যেন সোনার প্রদীপ, তাকে ধারণ করল সোনার পিলসুজ, কে কার অহঙ্কার হয়ে জ্বলে উঠল কনকবরণ দ্যুতিতে।  

সাতদিন পূর্ণ রইল প্রেক্ষাগৃহ। উপচে পড়ল ভিড়। ধন্য ধন্য করল দর্শক। উদয়শঙ্করের নৃত্যশেষে প্রণাম জানান, হই-হই রই-রই করে ওঠে দর্শক। চিৎকার ওঠে ‘আবার আবার’। এক-এক দিন মারোয়ারি নৃত্যের জন্য বার চারেক ফিরে ফিরে তাঁকে আসতে হত স্টেজে। উদয়শঙ্করকে নিয়ে দেশের মেতে ওঠার, বাঙালির মেতে ওঠার সেই শুভসূচনা।

Powered by Froala Editor