ধরুন নিছকই খেলার সামগ্রী কিনতে গেছেন কোনো শপিং মল বা কোনো মাল্টিব্র্যান্ড স্টোরে। তবে পছন্দের সামগ্রী বেছে নিতে গেলে হামেশাই পড়তে হয় ধর্মসংকটে। নেপথ্যে দুটি প্রবাদপ্রতিম ব্র্যান্ড— পুমা এবং অ্যাডিডাস। তবে দুই মাল্টিনেশনাল কোম্পানিরই সূত্রপাত হয়েছিল একটিমাত্র পরিবার থেকেই। আর তাদের উত্থানের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস।
১৯১৯ সাল। জার্মানির হের্জোগেনারক শহরে ছোট্ট ব্যবসা শুরু করে ডাসলার পরিবার। তৈরি হয় জুতো তৈরির আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে স্নিকারসের কারখানা ‘গেব্রুইডার ডাসলার’। নেপথ্যে ছিলেন দুই ভাই— অ্যাডলফ এবং রুডলফ ডাসলার। প্রাথমিকভাবে নিজেদের পৈতৃক বাড়িতেই চলত জুতো প্রস্তুতির কাজ। বছর দশকের মধ্যেই কর্মী সংখ্যা দাঁড়ায় ১২ জন। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকা চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিতেই একটি বড়ো কারখানা নির্মাণ করেন ডাসলার ভাতৃদ্বয়।
আঞ্চলিক খ্যাতি ছিলই, তবে আসন্ন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে মোড় ঘুরে যায় ব্যবসার। সেটা ১৯৩৬ সাল। বার্লিন অলিম্পিক। অলিম্পিকে নিজেদের তৈরি জুতো নিয়েই ডাসলাররা দ্বারস্থ হয়েছিলেন জেসি ওয়েন্স-সহ বিখ্যাত অলিম্পিক প্রতিযোগীদের কাছে। জুতোর বৈশিষ্ট দেখে তৎকালীন বিখ্যাত আন্তর্জাতিক সংস্থাদের সরিয়ে অখ্যাত এই অঞ্চলিক কোম্পানির জুতোকেই বেছে নিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অনেকে। আর তারপরেই ভাগ্য খুলে যায় ডাসলার কোম্পানির। তাঁদের জুতো ব্যবহারকারী অ্যাথলিটরা নিয়ে আসেন ৭টি স্বর্ণপদক, ৫টি করে রূপো এবং ব্রোঞ্জ। শুধুমাত্র জেসি ওয়েন্সই জিতেছিলেন চারটি সোনা।
কিছুদিনের মধ্যেই বিশ্বের সেরা ক্রীড়াসামগ্রী প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলির মধ্যে জায়গা করে নিল গেডা (গেব্রুইডার ডাসলার)। তবে বেশিদিন স্থায়ী হল না সেই ব্যবসা। বদলে গেল কারখানার উৎপাদিত পণ্যই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জুতোর বদলে বাধ্য হয়েই শুরু হল আগ্নেয়াস্ত্র প্রস্তুতির কাজ। অ্যাডলফ বাড়িতে থেকেই পরিচালনা করতেন কারখানা। অন্যদিকে রুডলফ থাকতেন দেশের বাইরে জার্মানির সেনানিদের কাছে অস্ত্র পৌঁছে দেওয়ার তত্ত্বাবধানে।
আরও পড়ুন
ভাই ঢুকে যাচ্ছে চুল্লিতে, পা ধরে তাকে আকাশে ছুড়ে দিলেন জয় গোস্বামী
বিশ্বযুদ্ধের শেষে ১৯৪৫ সালে আত্মসমর্পণ করে জার্মানি। যুদ্ধক্ষেত্র থেকেই সেসময় ওয়ার ক্রিমিনাল হিসাবে গ্রেপ্তার হন রুডলফ ডাসলার। বছর খানেক বাদে মুক্তি পেয়ে আবার ফিরলেন শহরে। শুরু হল সাবেকি জুতোর ব্যবসা। তবে দুই ভাইয়ের সম্পর্কে যেন কোথাও একটা চির ধরেছিল এর পরেই। যার জেরে ১৯৪৮ সালে ভেঙে গেল জার্মানির অন্যতম সংস্থা গেডা। অ্যাডলফ ডাসলার ওরফে অ্যাডি তৈরি করলেন অ্যাডিডাস, রুডলফ বানালেন পুমা।
কিন্তু কেন ভাঙন ধরেছিল সেই সম্পর্কে তা আজও অজানা সকলের কাছে। অনেকের মতে যুদ্ধে বন্দি কারণ হিসাবে অ্যাডলফকেই দায়ী করেছিলেন তাঁর ভাই। অভিযোগ ছিল আমেরিকার কাছে গোপন তথ্য ফাঁস করেই তিনি ধরিয়ে দিয়েছেন তাঁকে। আবার কেউ কেউ বলে দুই ভাইয়ের স্ত্রীদের মধ্যে বিবাদ এমনই চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে পরিবার ভাগ হয়ে যায় তাতেই।
আরও পড়ুন
মাঝরাত্তিরেও গিজগিজে ভিড়, মুমতাজ ভাইয়ের পান-সিগারেটের দোকানের রহস্য কী?
তবে শুধু যে পরিবারই ভাগ হল তেমন নয়। ভাগ হয়ে গেল গোটা শহরের মানুষরাই। যেন দেশভাগের ক্ষুদ্র সংস্করণ। একদল অ্যাডিডাসকে ব্র্যান্ড হিসাবে বেছে নিলেন। একদল রুডলফের পুমাকে। কারণ সে সময় গোটা হের্জোগেনারক শহরের প্রতি পরিবারের অন্তত একজন করেই কাজ করেন হয় অ্যাডিডাস নয়তো পুমার কারখানায়। শহরের মাঝখান দিয়েই বয়ে গেছে অওরাখ নদী। তার উত্তরে জায়গা নিলেন অ্যাডিডাস সমর্থকরা, আর দক্ষিণে পুমা। তবে এই দুই সংস্থার প্রতিষ্ঠার সঙ্গেই শহরের মোট জনসংখ্যা ৭০০০ থেকে প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছিল ২৪৫০০-তে।
বিবাদ এমনই পর্যায়ে পৌঁছেছিল এক সংস্থার সামগ্রী ব্যবহারকারী অন্যদের ‘উচিত শিক্ষা’ দিতেন সাক্ষাৎ হলেই। বাড়িতেও অতিথি এলে তাঁর জুতো দেখে তবেই দেওয়া হত প্রবেশাধিকার। দুই অঞ্চলেই প্রচলিত ছিল বিপরীত পক্ষকে নিয়ে মজার চুটকি চালাচালি। কখনো কখনো শালীনতাকেও ছাপিয়ে যেত সেসব। তাছাড়া বার থেকে শুরু করে রেস্তোরাঁ— সব জায়গাতেই লক্ষ্য করা যেত এই বৈষম্য।
আরও পড়ুন
মুক্তিযোদ্ধা থেকে শিক্ষাব্রতী – বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে ‘বাচ্চু ভাই’ ছিলেন নিরলস
১৯৭৪ ও ’৭৮ সালে যথাক্রমে রুডলফ ও অ্যাডির মৃত্যুর পর ব্যবসার দায়িত্ব নেন তাঁদের সন্তানরা। তবে প্রচলিত ‘রাইভালরি’ থেকেই যায় শহরে। আরও এক-দেড় দশক পর ১৯৯০ সালে পারিবারিক ব্যবসা থেকে পাবলিক সেক্টরে বদলে যায় দুই সংস্থাই।
ব্যবসায়িক দিক থেকে দেখতে গেলে পুমার থেকে বর্তমানে বেশ খানিকটা এগিয়েই রয়েছে অ্যাডির তৈরি কোম্পানি। বিশ্বের খেলার সামগ্রী প্রস্তুতকারকদের মধ্যে নাইকির পরেই স্থান তাঁদের। বিশ্বব্যাপী স্টক এক্সচেঞ্জে তাঁদের মূল্য ৫১ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে পুমা প্রথম দশে থাকলেও তাঁদের ব্যবসায়িক মূল্য ৭ বিলিয়ন ডলার।
একই শহরে মাত্র দশ মিনিটের হাঁটা পথের ব্যবধানে দুই বৃহত্তম আইকনের হেডকোয়ার্টার। রয়েছে দুই কোম্পানিরই আলাদা ফুটবল মাঠ, স্টেডিয়াম, ফুটবল দল। শহরে এখনও রয়েছে বৈষম্য, তবে তার ঝাঁঝ অনেকটাই কমেছে আগের তুলনায়। সম্প্রীতির বার্তা দিয়ে দুই ২০০৯ সালে দুই কোম্পানির ফুটবল দলের মধ্যে একটি ম্যাচও আয়োজন করে পুমা। দিনটা ছিল বিশ্ব শান্তি দিবস। বর্তমানে ক্ষমতায় থাকা ডাসলার পরিবারের তৃতীয় প্রজন্ম মিটিয়ে ফেলতে চান অতীতের সমস্ত পারিবারিক সমস্যাই। কিন্তু তা সত্ত্বেও আজ জার্মানির এই ছোট্ট শহর ধরে রেখেছে সেই অন্ধকার ইতিহাসকে।
আজও হের্জোগেনারক শহরে গেলেই গোটা শহর জুড়ে চোখে পড়বে অসংখ্য সৃজনশীল নির্মাণ। তার কিছু পুমার, আর কিছু অ্যাডিডাসের তৈরি। তবে পাল্টেওছে অনেক কিছু। একটা সময় গণপরিবহনের ব্যবহৃত যানবাহনগুলিতে কোনো একটি সংস্থার লোগো ব্যবহার করা হত। আজ একই সঙ্গে পাশাপাশি দেখা যায় পুমা আর অ্যাডিডাসকে। শহরের মেয়র নিজেও দুই ব্র্যান্ডই ব্যবহার করেন। এমনকি একটি সম্প্রীতিমূলক ফুটবল ম্যাচে দু-পায়ে দুই কোম্পানির জুতো পরে বিবাদ মেটানোরও বার্তা দেন তিনি।
অ্যাডিডাস এবং পুমা— দুই ব্র্যান্ডেরই উৎপাদিত পণ্য মূলত একই গোত্রের। দুই সংস্থাই প্রস্তুত করে ক্রীড়াসামগ্রী। ফলে চূড়ান্ত ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা। কিন্তু তা সত্ত্বেও ৭০ বছর পেরিয়ে এসে বিশ্ববাজারে এখনও দাপট বজায় রেখেছে তাঁরা। একে অপরের সঙ্গে এই ‘রাইভালরি’-ই সামনে এনেছে একের পর এক চমকপ্রদ পণ্য। তবে ১৯৪৮ সালের সেই ভাগ না হলে পৃথিবী দেখতেই পেত না এই দুই স্পোর্টস ম্যানুফ্যাকচারার জায়েন্টকে। প্রতিযোগিতা না থাকায় হয়তো সম্পৃক্তও হয়ে যেত গেডার সৃজনশীলতা। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে স্বীকার করে নিতেই হবে ‘দাগ ভালো’...
Powered by Froala Editor