জার্মানি থেকে ভারতকে স্বাধীন করার স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বামীজির 'বিস্মৃত' ভাই

তাঁর দাদা বিশ্ববন্দিত। আজও প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে উচ্চারিত হয় মানুষটির নাম। হবে না? তিনি যে নরেন্দ্রনাথ দত্ত তথা স্বামী বিবেকানন্দ। আর এহেন দাদার ছায়াতেই বিস্মৃতির গহ্বরে চলে গেছেন তাঁর ভাই। অথচ, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত মানুষটি মোটেই ভুলে যাওয়ার মতো ছিলেন না। ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম হচ্ছে তখন। ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত সেই সময়ে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, এই দেশে জাতপাতহীন এক ব্যবস্থার স্বপ্ন আর শ্রেণীহীন সমাজের স্বপ্ন সমার্থক। ‘শ্রেণী’কে প্রধান গুরুত্ব দেওয়া ভারতীয় কমিউনিস্টরা সেদিন তাঁর কথা শোনেননি। জাতপাত, বর্ণ আর অর্থনৈতিক শ্রেণীবিভাজনকে ভূপেন্দ্রনাথ এক করে ফেলছেন বলে হয়ত সমালোচনাও করেছিলেন কেউ কেউ। আর আজ, ভূপেন্দ্রনাথের সেই কথাকেই ধ্রুব সত্যি বলে মেনে নিয়েছে এ-দেশের কমিউনিস্টরা। মাঝে সময় গড়িয়ে গেছে অনেকটাই।

কৈশোরে ব্রাহ্ম সমাজে যোগ দেওয়ার কারণেই হয়ত বর্ণ-হিন্দুত্বের পোশাক অনেকটাই আলগা হয়ে এসেছিল তাঁর গা থেকে। এরপর, যৌবনে জড়িয়ে পড়লেন স্বদেশি আন্দোলনে। অরবিন্দ ঘোষের ঘনিষ্ঠ। সম্পাদনা করেছেন ‘যুগান্তর’ পত্রিকা। গ্রেপ্তারও হন স্বাভাবিক নিয়মেই। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে পাড়ি দেন আমেরিকায়, পরে জার্মানিতে। ভারত-জার্মান বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের অন্যতম এক মুখ ছিলেন তিনি। বার্লিনে স্থাপিত ‘ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স কমিটি’র সম্পাদকও হয়েছিলেন। ১৯২১ সালে ‘কমিন্টেনে’ যোগ দিতে সোভিয়েত রাশিয়ায় পাড়ি দিয়েছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ। সেখানে ভারতের সমকালীন রাজনৈতিক অবস্থা, ভারতীয় কৃষিসমাজ নিয়ে লেখা তাঁর বিশ্লেষণ পড়ে নাকি বিস্মিত হয়েছিলেন লেনিন স্বয়ং।

সুপণ্ডিত ভূপেন্দ্রনাথের শিক্ষার পরিধিও ছিল চমকে দেওয়ার মতো। আমেরিকা থেকে এমএ করেছেন, জার্মানির হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃতত্ত্ববিদ্যায় ডক্টরেট। বিষয়ের অতলে পৌঁছতে পারার সহজাত ক্ষমতা তাঁর ছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ভারতবর্ষে জাত-পাত-বর্ণের আবহমান ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করে কমিউনিজমের শ্রেণীহীন সমাজের স্বপ্নকে প্রোথিত করা যাবে না। যেখানে উচ্চবর্ণ প্রতিমুহূর্তে শোষণ চালাচ্ছে নিম্নবর্ণের উপরে, যে দেশে দলিতরা আজও কেবলমাত্র ‘নিচুজাত’ হওয়ার কারণে বঞ্চিত, অত্যাচারিত, তাদের মৃতদেহ শ্মশানে ঢুকতে দেওয়া হয় না—সেই দেশে অর্থনৈতিক শোষণই একমাত্র শোষণ হতে পারে না। সেই দেশে শ্রেণীহীন সমাজের স্বপ্ন দেখা সম্ভবই নয় জাতপাতহীন সমাজ গঠন ছাড়া।

ভূপেন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন আগেই। ভারতের অন্যান্য কমিউনিস্টরা পারেননি সেদিন। দাদা ‘স্বামী বিবেকানন্দ’-কেও নতুন চোখে চিনতে শিখিয়েছিলেন তিনি। ‘স্বামী বিবেকানন্দ, পেট্রিয়ট-প্রফেট’ বইটিতে তাই ‘পেট্রিয়ট’ শব্দটি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ভূপেন্দ্রনাথ আমাদের উপহার দিয়েছিলেন এমন অনেক নতুন দৃষ্টিকোণ, শিখিয়েছিলেন ভারতীয় সমাজ-ব্যবস্থার অনেক সারসত্য। আমাদের পূর্বপুরুষরা তাঁকে সেদিন শিক্ষক হিসেবে মান্যতা দিতে পারেননি।

গতকাল বড় নিঃশব্দে চলে গেল ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের ১৩৯তম জন্মদিন। আজ শিক্ষক দিবস।