পদাবলি, মার্ক্স, রবীন্দ্রনাথ ও মধ্যরাতের ঠাট কাফি

You took my hand, opened my mind and touched my heart...

এসব কি বিলাপ! কী বিলাপ! তবু তো দু-একজন আছেন। প্রবল সংশয়ে, বিশ্বাসে আছেন। প্রতিবাদে, ভালোবাসায় আছেন। আব্দুল কাফি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। আমাদের কাফিদা। বাংলা বৈষ্ণব সাহিত্যের ক্লাস নেন কাফিদা। পড়ান রবীন্দ্রনাথ, কার্ল মার্ক্স। না, বইয়ের পড়াতে তিনি বা তাঁর ছাত্রছাত্রীরা অভ্যস্ত নন। কারণ বৈষ্ণব সাহিত্যে মিশে যেতে পারে ভারতীয় রাগসংগীত, রবীন্দ্রনাথের কবিতা বোঝাতে গিয়ে চলে আসতে পারে একালের কবি জয় গোঁসাই আবার মার্ক্সবাদ বলতে বলতে হঠাৎ এসে যেতে পারে প্রাত্যহিক জীবনচর্যা।

২০১৪ সালের জুলাই মাস। অনেক স্বপ্ন নিয়ে যাদবপুরে ভর্তি হওয়া। খুব ছোটবেলা থেকেই একটি নাম ভীষণভাবে টানত। শঙ্খ ঘোষ। যে ক্যাম্পাসে বসে শঙ্খবাবু লিখে গেছেন একের পর এক যুগোত্তীর্ণ কবিতা, সেই গাছ, সেই মাঠ, সেই ক্লাসরুম, সেই বিভাগকে ছুঁয়ে দেখার সাধ তখন থেকেই। মনে মনে তখন প্রবল ইচ্ছা, এমন একজনের দেখা যেন পাই৷ যিনি প্রশ্ন করতে শেখাবেন, প্রতিবাদ করতে শেখাবেন, ভালোবাসতে শেখাবেন। সেই তখনই প্রথম দেখা আব্দুল কাফিকে৷ যার যত ব্যস্ততা, মিছিল-মিটিং থাকুক না কেন, কাফিদার ক্লাসে দেখা যেত উপচে পড়া ভিড়। একেবারে পিছনের বেঞ্চের ছেলেটার চোখে লেগে থাকত উজ্জ্বল আলো। কাফিদা পড়াচ্ছেন বৈষ্ণবীয় রস। জীবনের প্রাত্যহিকী থেকে এক এক করে তুলে আনা হচ্ছে ঘটনাবলি৷ কাফিদার সেইসব কথা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আমরা অবলীলায় পাঠ করে ফেলছি কাফি স্যারকে।

আব্দুল কাফি ছাত্র-ছাত্রীদের মুগ্ধ করেন। কীভাবে ডুবে গিয়ে পড়াশোনা করতে হয়, তার দিনলিপি শিখিয়েছেন আমাদের। কাফিদার মতে সেই পড়া আর পড়া হয়ে থাকবে না, মগ্ন হয়ে যেতে হবে। দেখা হলেই হাসি খেলে যায় ওই রোগা ছিপছিপে শরীর জুড়ে। হয়ে ওঠেন আপনজন। নম্র, ভদ্র, সহজ এই মানুষটার চোখ বড়োই গভীর। সেই চোখের ভিতরে যেমন ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি ভালোবাসা বোঝা যায়, তেমনই ওই চোখে উঁকি মারে প্রতিবাদ, বিদ্রোহ। আমি অধ্যাপক, তুমি ছাত্র - এই জটিল সম্পর্কে না গিয়ে যাদবপুর আমাদের সহজ হতে শিখিয়েছে। কী অবলীলাক্রমে তাই শিক্ষক-শিক্ষিকারা হয়ে ওঠেন দাদা-দিদি। ‘আপনি’ সম্বোধনের জায়গায় বসে থাকে ‘তুমি’। ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে বন্ধুত্বটা না তৈরি হলে হয়তো সত্যিই পড়াশোনাগুলো বস্তাপচা সিলেবাসের মধ্যেই আটকে যেত। আর একটা কথা না বললেই নয়, কাফিদা আমাদের প্রশ্ন করতে শিখিয়েছেন। সাহিত্যকে চুলচেরা বিশ্লেষণের মধ্যে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। এই সূক্ষ্ম বিশ্লেষণী ক্ষমতা না থাকলে আমাদের কীসের সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা! ক্লাসে কাফিদার আসা মানেই প্রত্যেকে চুপ। ভয়ে নয়, শ্রদ্ধায়। কাউকে কোনোদিন বকেননি, জোর করে শ্রদ্ধার বোঝাও চাপিয়ে দেননি। ঠিক এরকমই দমকা হাওয়ার মতো তিনি।

কাফি আসলে একগুচ্ছ মিউজিক্যাল নোট্‌স। আমি গান বুঝি না, সুর বুঝি না। তবে বারবার মনে হয় ভারতীয় রাগ সংগীতের সবচেয়ে অশ্রুত রাগ কাফি। মধ্যরাত্রির এই রাগের প্রকৃতি ঝড়ের মতো চঞ্চল। ঠাট কাফিতেই সাধারণত গাওয়া হয়ে থাকে ধ্রুপদ, ভজন এবং ঠুংরি। রাগ সংগীতের এই অধ্যায়টি জানলে আমার উপরের লেখা কথাগুলো বারবার ফিরে ফিরে আসবে। মিলে যাবে প্রত্যেকটা শব্দ, বাক্য। যাদবপুরে আমার কাটানো দু’টো বছর কাফিদার সঙ্গে ভালো করে বন্ধুত্বই হয়নি। এই বন্ধুত্ব না হওয়ার জন্য দায়ী হয়তো আমরা দু’জনেই। কিন্তু ভিতর ভিতর যে শব্দগুলো কখনওই ভুলতে পারি না, সেই ‘পদাবলি’, ‘চঞ্চল’, ‘মধ্যরাত’ আমাদের দু’জনের ইন্সট্রুমেন্টের ভিতর বসে থাকে। আমি প্রণামে বিশ্বাসী নই। মনে করি ওই জড়িয়ে ধরাটুকুই সম্বল। যেকোনো কিছুর শেষের পর একটা শুরুর কথন থাকে। এই লেখাটিও শুরু হল এইবার...

আসলে নামটাই ‘কাফি’।

More From Author See More