বিশ্বযুদ্ধের ৭৬ বছর পরেও নাৎসি শাসন! জার্মানিতে আজও রয়েছে এই গ্রাম

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটেছে আজ থেকে ৭৬ বছর আগে। সেইসঙ্গে জার্মানির বুকে হিটলারের নাৎসি শাসনেরও অবসান ঘটেছে। তবে এখনও যদি কোনো গ্রামে গিয়ে শোনেন সমস্ত মানুষ ডান হাত সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলছেন ‘হেইল হিটলার’! অবাক হবেন নিশ্চই। তবে এখনও পূর্ব জার্মানির বুকে রয়েছে এমনই এক গ্রাম। জার্মানির পুলিশের খাতায় সেই গ্রামের পরিচয় ‘নিও-নাৎসি ভিলেজ’। বালটিক সাগরের অদূরেই এমনই আশ্চর্য গ্রামের নাম ইয়ামে।

পুরনো পার্সি ইঁটের ১২টি বাড়ি নিয়ে ইয়ামে গ্রাম। আর তাকে ঘিরে আছে গভীর বনভূমি এবং বিস্তীর্ণ খোলা মাঠ। এমনিতে বেশ মনোরম। তবু জার্মানির কোনো মানুষ এই গ্রামের আশেপাশে যাওয়ার সাহস পান না। তবে তিন দশক আগেও পরিস্থিতি এমন ছিল না। বাকি সমস্ত গ্রামের মতোই এখানেও নিশ্ছিদ্র শান্তি বিরাজ করত। ঠিক এই সময় নাৎসিপন্থী নেতা স্বেন ক্রুগারের উত্থান হয় ইয়ামে গ্রামে। নাৎসি আদর্শকে সামনে রেখে তিনি তৈরি করে ফেলেছেন একটি রাজনৈতিক দলও। জার্মানিতে সেই দলের গ্রহণযোগ্যতা শূন্য হলেও ইয়ামে গ্রামের প্রত্যেকেই তাঁর আধিপত্য মেনে নিয়েছেন। অবশ্য তা মূলত ক্রুগারের ভয়েই।

পুলিশের খাতায় একাধিক কেসে নাম আছে স্বেন ক্রুগারের। খুন, রাহাজানি থেকে শুরু করে দাঙ্গায় নেতৃত্ব দেওয়া, যাবতীয় অভিযোগে শাস্তি পেয়েছেন একাধিকবার। কখনও তিন বছর, কখনও পাঁচ বছর কারাগারে দিন কাটিয়েছেন। আবার ফিরে গিয়ে নিজের আধিপত্য বিস্তার করেছেন। পুরো গ্রামকে সাজিয়েছেন নাৎসি পোশাকে। প্রবেশপথেই চোখে পড়বে এক বিরাট দেয়ালচিত্র। একটি আর্য পরিবারের ছবি। আপাত নিরীহ এই ছবিটিই ছিল নাৎসিদের আর্য যাতীয়তাবাদী আদর্শের প্রতীক। এই দেয়ালচিত্রের কিছু দূরেই আছে এক বিরাট কাঁচের শো-কেস। তার মধ্যে নিপুনভাবে সাজানো নাৎসি শাসনের সময়কার নানা দলিল। হলোকাস্টের যাবতীয় নির্মমতার তথ্য। আছে গুয়েরিনের নেতৃত্বাধীন বাছাই করা গেস্টাপোদের ছবিও। এই সমস্ত ছবি সামনে রেখেই নাৎসি আদর্শকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ক্রুগার।

শুধুই বড়োরাই নয়, ছোটোদের মধ্যেও ক্রমাগত নাৎসি আদর্শের বিষ ছড়িয়ে চলেছেন ক্রুগার। এখানকার শিক্ষাব্যবস্থাও বাকি জার্মানির থেকে আলাদা। হিমলারের হাতে যে নাৎসি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, তাই এখনও চলে ইয়ামে গ্রামে। প্রতিদিন বিকালে পার্কে দাঁড়িয়ে চলে মিলিটারি প্রশিক্ষণ। সব মিলিয়ে হিটলারের শাসনাধীন জার্মানিকেই দেখতে পাওয়া যাবে এই গ্রামে।

আরও পড়ুন
এশিয়ার বুকে নির্মম গণহত্যা জাপানি সেনার, ছাপিয়ে গিয়েছিল নাৎসিদেরও!

তবে এর মধ্যেও একটিমাত্র নাৎসি বিরোধী পরিবার বাস করে ইয়ামে গ্রামে। বহু অত্যাচার এবং হুমকিতেও তাঁরা গ্রাম ছেড়ে যাননি। বরং ক্রুগারের আধিপত্য থেকে ইয়ামেকে মুক্ত করার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। ২০০৪ সালেই এখানে বাসা বাঁধেন হোর্স্ট এবং বিগিট লোহমিয়ার। বারবার তাঁদের বাড়ি বিক্রি করে দেওয়ার জন্য হুমকি দেওয়া হয়। তবে এই সময়েই লোহমিয়ার পরিবারের সুরক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করে পুলিশবাহিনী। ক্রুগারকে সম্পূর্ণ পরাস্ত করতে না পারলেও সবসময় গ্রামের উপর নজর রেখেছে পুলিশ। অন্যদিকে ক্রুগারও তাঁর বিরাট বাড়িকে রীতিমতো দুর্গে পরিণত করেছেন। ২০০টি অটোমেটিক রাইফেল নিয়ে সবসময় প্রস্তুত থাকে তাঁর নিজস্ব সেনাবাহিনী।

আরও পড়ুন
ফিরতে পারে নাৎসিবাদ! বিরোধী দলের ওপর নজরদারি জার্মানিতে

লোহমিয়ার পরিবার অবশ্য এই যুদ্ধে সংস্কৃতিকেই হাতিয়ার করে তুলতে চান। আর তাই নিজের বাড়ির বাগানে প্রতি বছর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে আয়োজন করেন এক বিরাট নাৎসি-বিরোধী সঙ্গীতানুষ্ঠান। ২০০৭ সাল থেকেই এই অনুষ্ঠান চলে আসছে। জার্মানির এমন কোনো রকস্টার নেই, যিনি এই অনুষ্ঠানে কোনোদিন আসেননি। দুদিনের অনুষ্ঠানে দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ এসে ভিড় জমান। আর তাঁদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকে বিরাট পুলিশ বাহিনী। এই অনুষ্ঠানও নানাভাবে বানচাল করার চেষ্টা করেছেন ক্রুগার। ২০১৫ সালে অনুষ্ঠানের কিছুদিন আগেই লোহমিয়ার পরিবারের বাড়ির একটা অংশে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। তবে কোনো অত্যাচারেই তাঁদের দমানো যায়নি।

আরও পড়ুন
বাকিংহ্যাম প্যালেসে নাৎসি-আক্রমণের ভয়, বন্দুক চালানো শিখলেন রাজকুমারী এলিজাবেথ

লোহমিয়ার পরিবারের পাশে এসে দাঁড়ানোর সাহস গ্রামবাসীদের কারোর নেই। তবে তাঁদের বিশ্বাস, গ্রামবাসীদের মন থেকে নাৎসিবাদের বিষ সরে যাচ্ছে। ক্রুগারকে একদিন হার মানতেই হবে। আর সেদিন যেন মানুষ সেই ভয়ঙ্কর আদর্শকে ঝেড়ে ফেলে মানবিকতাকে হাতিয়ার করে তুলতে পারে, সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছেন লোহমিয়ার দম্পতি। তাঁদের অস্ত্র নেই, সৈনবাহিনী নেই। আছে শুধু মানবিকতা আর গান।

তথ্যসূত্রঃ Life in the Nazi village, Deutsche Welle

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More