বলি, কুরবানি— মাংস

মুছে যায়?— ৫২
আগের পর্বে

বাংলা সাহিত্যে অলৌকিকের সঙ্গে বীভৎস রসের প্রবক্তা কালিকানন্দ অবধূত। প্রথম জীবনে স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন তিনি। পরে ব্রিটিশদের চোখে ধুলো দিতে তন্ত্রপথে সন্ন্যাস নেন। দুর্গম হিংলাজে দীর্ঘদিন আধ্যাত্মিক জীবন কাটিয়েছেন তিনি। পরবর্তীতে চুঁচুড়ায় ভৈরবীকে নিয়ে থাকতেন তিনি। সঙ্গে থাকত একাধিক পোষ্য সারমেয়। কালীঘাটের মন্দিরের পালাদার তথা গ্রন্থপ্রণেতা অলক মুখার্জি ঘনিষ্ঠ ছিলেন তাঁর। তিনিই জানিয়েছিলেন, কালীঘাটের পণ্ডপুকুরের ধারে অবধূতের র হুইস্কিপানের কথা। কালিকানন্দ অবধূতের মৃত্যুর কয়েক বছর পর তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলাম ‘সংকেত’ পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে। তারপর…

বলিদানের যূপ, যূপকাষ্ঠ, হাঁড়িকাঠ বা হাড়কাঠ তৈরির কারিগর ছিলেন গ্রামে। খুব শক্তপোক্ত কাঠে তৈরি হত হাঁড়িকাঠ। পাঁঠা আর মোষ বলিদানের হাঁড়িকাঠ চেহারায় আর আকারে আলাদাই। কালীঘাটের কালীমন্দিরে কালীমূর্তির সামনে বলিদান করানো রবির কথা তো আগেই বলেছি।

কালীঘাটের কালীমন্দিরে মোষ বলি দেওয়া হত ষাট-সত্তর দশকেও, দুর্গাপুজোর অষ্টমী-নবমীর সন্ধিক্ষণে সেই বলিদান পর্ব। মোষ বলির কাতান, রামদা, বগিদা বা খড়্গ যাই বলি না কেন, সবই ছাগ বলির কাতান, খড়্গ বা রামদা-বগিদার থেকে আয়তনে বড়ো, পোক্ত, ধারালো। ওজনদার তো বটেই।

মহাষ্টমীর দিন মোষবলির আগে যে মোষকে বলি দেওয়া হবে, তার গলা, ঘাড়— সব ঘি বা ডালডা দিয়ে টেনে টেনে নরম বা বলিযোগ্য করা হত। কারণ বলি বেঁধে গেলে ‘মহা অকল্যাণ’— এটা যাঁরা বলি করেন ও করান, বিশ্বাস করেন তাঁরা, মনে-প্রাণে। আমি আরও কোথাও কোথাও মোষ বলির প্রস্তুতিতে এমনভাবে মহিষের গলা, ঘাড় নরম— বলিযোগ্য করতে দেখেছি। বিশেষ করে চিলকিগড়ে, অষ্টভুজা দেবীর সামনে। চিলকিগড়ের ‘রাজা’ ও ‘রানি’ আসতেন ব্রহ্মতন্ত্র ঘরানার সন্ন্যাসী সাহিত্যিক তারাপ্রণব ব্রহ্মচারীজির কাছে, প্রণবানন্দ পিতাজি মহারাজের কাছে— ১৫ বি ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে, মাতৃকাশ্রম প্রণবসংঘে।

আগেই লিখেছি ব্রহ্মতন্ত্র ঘরানায় কোনো পশুবলির রেওয়াজ নেই। নিজের প্রবৃত্তি ও রিপুদের বলি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, পূর্ণাহুতির সময়। পূর্ণাহুতি হয় হোমের শেষে, অমাবস্যা-পূর্ণিমার হোমে।

আরও পড়ুন
শাঁকনি সাপের মালা, কালিকানন্দ অবধূত

চিলকিগড়ের যে রাজারানি আসতেন ১৫ বি ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে, তাঁদের পদবি সিংদেও। ওঁরা নিজেদের বলতেন রাজপুত। তবে রাজপুত-চেহারার সঙ্গে রাজাসাহেবের চেহারার কোনো মিলই খুঁজে পাইনি। বাংলা স্টাইলে ধুতি পরতেন রাজাসাহেব। নাকের নিচে ছাঁটা সাদা-পাকা গোঁফ, মাথার কাঁচাপাকা চুল ব্যাকব্রাশ, উল্টে আঁচড়ানো। সামান্য কোঁচকানো সেই কেশ। বেশ লম্বা, সামান্য ভুঁড়ি আছে। ষাটের ওপর বয়স।

আরও পড়ুন
শিবাভোগ ও সাদা শেয়াল

রানিমা— তাঁকে এই নামেই সম্বোধন করতেন ব্রহ্মচারীজি। এক হাত কাচের চুড়ি— রঙিন— দুহাতেই। নাকে ঝকঝকে নাকছাবি, কপালে বড়োসড় বিন্দিয়া টিপ। গায়ের রঙ ময়লাই। তবে নাসাটি খড়্গাকৃতি। সাধারণভাবে সিনথেটিক বা সিল্ক শাড়ি একটু যেন টেনে, ঘুরিয়ে, সাবেক বিহারি ডিজাইনে পরা কদাচিৎ, নয়তো কুঁচি দিয়ে। এইটা— এ ছবি আমি সত্তর দশকের বলছি। রানিমা চোখে কাজল বা সুর্মা দেন, চশমাও আছে চোখে। তাঁর কণ্ঠস্বর একটু ভারি, গমগমে।

আরও পড়ুন
শিবাদাদু, শান্তি-স্বস্ত্যয়ন, বাহিন

চিলকিগড়ের রাজা সাহেবও গাত্রবর্ণে বেশ ময়লাই। সিংদেও পদবি ওঁদের। ওঁদের আত্মীয় শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে আছে ওড়িশাতেও। সেটাও জেনেছি ওঁদের কাছেই। তো চিলকিগড়ে অষ্টধাতুর কনক দুর্গার সামনে মোষবলি, দুর্গাপুজোর সময়। অষ্টধাতুর আগে সম্ভবত সোনার মূর্তি ছিল, এমনই শুনেছি। সেইসব মূর্তি— কনক দুর্গার মূর্তি ক্রমান্বয়ে চুরি হয়ে গেছে।

আরও পড়ুন
অম্বুবাচী, অমাবতী, আমাবতী

চিলকিগড়ে দুর্গাপুজোর সময়, সন্ধি পূজাক্ষণে মোষ বলি দেখি। সে এক ভয়ানক হত্যাযজ্ঞ।

বলি জিনিসটাই আমার পছন্দ হয় না। যত বয়স বেড়েছে, তত এই অপছন্দ বেড়েছে। কম বয়সে কোন্নগরে শকুন্তলা কালীবাড়িতে পাঁঠাবলির রক্তস্রোত, মনে পড়ে। এক রাতে— পুজোর দিনে পাঁচশো-ছশো ছাগমুণ্ড গড়াগড়ি খায় অনায়াসে, ঘাতকের অস্ত্রাঘাতে।

তো সে যা হোক, চিলকিগড়ের কনকদুর্গার সামনে মোষ বলির কাতান, পাথরে, বালিতে, জলে শান দিয়ে দিয়ে আরও বেশি বেশি ধারালো করতে দেখেছি। কালীঘাটের কালীমন্দিরে বেশ কয়েকটা বলি হওয়ার পর রবি কাতান পাল্টাতেন। একটা টিনের লম্বাটে বাক্সে রাখা থাকত বলিদানের রামদা। বালি দিয়ে ঘষে ঘষে কাতানে শান দিতে দেখেছি তাঁকেও। সে বড়োই কুদরতি রঙ্গবিরঙ্গী। হ্যাঁ, এই কথাটা আখ্যানকার ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, যিনি বাংলা ভাষায় ট্রিম অফ কনশাসনেস-চেতনা প্রবাহর ভাবনাটি আনলেন, তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ অন্তঃশীলা, ময়ূরকণ্ঠী প্রভৃতি। ধূর্জটিপ্রসাদের পুত্র কুমারপ্রসাদ ক্রিকেট, ধ্রুপদী সঙ্গীত, আড্ডা সব নিয়েই অতি মাহির— প্রসিদ্ধ। কুদরতি রঙ্গবিরঙ্গী তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ।

ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় মারা যান কর্কট রোগে। কালান্তক কর্কট রোগ। ধূর্জটিপ্রসাদ খুব পড়ুয়া লেখক। তাঁর গদ্য একেবারেই স্বতন্ত্র। তো সে যাক গে, চিলকিগড়, তাঁর কনকদুর্গা মন্দির, এসব নিয়ে অনেক অনেক কথা, কাহিনি, অতিকাহিনী বলতেন রাজা ও রানি। সেসব কথায় আর বিস্তারে যাচ্ছি না।

নেপালে মোষবলি প্রথা আছে যথেষ্ট পরিমাণে। মোষের মাংসের চলও সেখানে খুব। ঈদ কুরবানিতে গরু, মোষ, ছাগল, খাসি, দুম্বা, ষাঁড়, বলদ, উট— সব চলে।

এই কাটাকাটির পারিশ্রমিক সব আলাদা আলাদা, বলিদারি করার আকারের ভিত্তিতে। উত্তরপ্রদেশ, কাশ্মীর, সম্ভবত ওড়িশাতেও গো কুরবানি নিষিদ্ধ। সেখানে খাসি। কাশ্মীরে মূলত ভেড়া, দুম্বা।

ঈদের কুরবানির জন্য যে ছুরি, তা খুবই ধারালো হওয়ার বিধান আছে। যাতে আড়াই প্যাঁচ বা পোচের মধ্যে কুরবানির পশুটির গলা নামিয়ে দেওয়া যায়। সূরা আওড়াতে আওড়াতে। শুনেছি উট নাকি নিজের গলা বাড়িয়ে দেয় কুরবানির জন্য। তবে উটের মাংস খেয়ে দেখেছি, অবশ্যই কুরবানি দেওয়া উটের মাংস। সামান্য নোনতা। যেমন মোষের মাংস টাটকা হলেও অল্প টকসা।

কুরবানি বা কোরবানির গরু, ষাঁড়কে আপেল খাওয়াতে দেখেছি। কুরবানির মাংসদার গরু, ষাঁড়কে, টেবল বা সিলিং ফ্যান-সহ রাখা তো অনেক পুরনো রেওয়াজ। ইদানিং তো এয়ার কন্ডিশনার এসে গেছে।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি ইসলাম ধর্মের বহু মানুষ ‘ঝটকা’ বা এক কোপে কাটা পশুর, পাখির মাংস খান না। তাঁরা জবেহ বা জবাই করা পশু-পাখির গোশত খান। কুরবানি বা কোরবানির সময় সূরা পাঠ করা হয়।

সনাতন ধর্মীরা অনেকেই তো আগে দেব-দেবীর সামনে বলি দেওয়া পশুর মাংস ছাড়া খেতেন না। বিশেষ করে তথাকথিত উচ্চবর্গীয় ব্রাহ্মণ, পাশ্চাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণরা। তাঁরা কসাই ঘরে কাটানো পশুমাংসকে ‘বৃথা মাংস’ বলতেন ও পরিত্যাগ করতেন, সে কথা বলেছি আগেও।

বলি দেওয়া ছাগ মাংসে প্রচুর রোম বা লোম। সেই লোম বাছা একটা বড়ো কাজ। এই কাজ করেন গ্রামের মেয়েরা। অখণ্ড মেদিনীপুরের হাট থেকে বা বীরভূমের হাট থেকেও পাঁঠার মাংস এনে দেখেছি মাংস থেকে লোম বাছতে দিন উজাড়। ষাটের দশকে গ্রামে দেখেছি কলাপাতা, কচুপাতায় ‘ভাগায়’ মাংস বিক্রি হতে। ঘাটশিলা, দেওঘরেও। নদীর মাছও ভাগায়। কালীঘাটে কালী মন্দিরের কাছেই বাগদি পাড়ায় শালপাতায় বাগার মাংস। ঘাটশিলা, দেওঘরেও শালপাতা।

পঞ্চাশের দশকে, ষাটেও বাড়ি জিজ্ঞেস করে, কতজন খরিদ্দার হল, সেই বুঝে পাঁঠা বা খাসি মারা হত। মূলত পাঁঠাই। মালদহে বইমেলা উদ্বোধন করতে গিয়ে শুধু সবুজ ঘাস খাওয়া কচি পাঁঠার মাংস খেয়েছি, অনবদ্য। বাঁকুড়াতেও তাই। মালদহের কচি পাঁঠার হাড় যেন পাকা কাতলার কাঁটা থেকে অল্প মোটা।

কোচবিহারে দেখেছি মাথায় হাতুড়ি মেরে মন্দিরে পাঁঠা হত্যা প্রথা। কাতান, রামদা অথবা খড়্গের বদলে। পাঁঠাকে মুখ চেপে ধরে বলি করাতে দেখেছি বালিতে ষাটের দশকে। পাঁঠা পাছড়ানো বা ধরার জন্য সাহসী, উৎসাহী লোকজন ছিলেন, বিশেষ করে পাশ্চাত্য বৈদিক শ্রেণীর কোনো কোনো ব্রাহ্মণ পরিবারে। সেই ধারা স্বাভাবিকভাবেই বিলুপ্তির পথে অথবা বিলুপ্ত।

সনাতনীরা বলির আগে, বলি দেওয়ার জন্য উৎসর্গীকৃত পাঁঠার কানে কানে কী যেন বলেন, পুরোহিতই বলেন সাধারণত। তখন জোরে জোরে ঢাঁক, কাঁসি বাজছে, আর অতি জোরে জোরে মা, মা, মা— চিৎকার।

বলি হবে এমন পাঁঠার গলায় সাধারণত রক্তজবার মালা। চান করানো হয়েছে তাকে। পাঁঠাটি অসহায়ভাবে ম্যা ম্যা করছে। সামনের বেলপাতা, ফুল, যা তাকে উৎসর্গের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে, খাচ্ছে খাচ্ছে। আর অঝোর ধারায় পেচ্ছাপ করে যাচ্ছে, এ দৃশ্য খুব চেনা।

ঈদের কুরবানির গরু, মোষ, ভেড়া বা অশ্ব যা যা পশু থাকে, সবই নিখুঁত হতে হবে শিঙ থেকে খুর পর্যন্ত। খুঁতো গরু, খাসি, ভেড়া কুরবানি হয় না। বলির ক্ষেত্রেও তাই। খুঁতঅলা, রোগগ্রস্ত পাঁঠা বলি হবে না। কালীপুজোয় কালো পাঁঠা অতি প্রশস্ত বলির জন্য।

ইসলাম ধর্মের মানুষরা কেউ কেউ এক দেড় দুবছর ধরে বাড়িতে খাসি পুষে রাখেন। কাবলি ছোলা, ভুষি, আপেল-সহ নানা পোস্টাই জিনিস খাওয়ানো হয়। সেই পাটনাই বা বর্বরি খাসির পায়ে পেতলের মোটা রিং। ঘুঙুর। খাসি চললে ঝুম ঝুম ঝুম ঝুম শব্দ ওঠে।

ইদানিং গত তিরিশ বছর আর হয় না এইসব পালা পোষা, বাঙালি মুসলমানের ঘরে সার্বিকভাবে। দু-এক ঘর হিন্দি-উর্দুভাষী মানুষ এভাবে ঈদ-ই-আযজার কুরবানির খাসি পালন করে থাকেন। কুরবানি দেওয়ার সময় তার জন্য চোখ দিয়ে জল পড়ে মালিকের। কারণ আল্লাহতালার কাছে কোনো এক ‘আল্লাহর বান্দা’ নিজের সবথেকে প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করছেন, সেই হজরত ইব্রাহিম আর ইসমাইলের ধর্ম-গল্প।

বলির পাঁঠা কেনার আগে তার কোমরের কাছে একহাত দশ আঙুল দিয়ে ওপর দিকে তুলে মোটামুটি কতটা মাংস হবে, তার আন্দাজ করে নিতেন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি কালীঘাটের কালীমন্দির লাগোয়া ছাগলহাটায় একটি পাঁচ-ছ সের মাংস হবে, এমন পাঁঠার দাম আশি টাকা বড়োজোর। তখন বাজারে পাঁচ সিকে— একটাকা চার আনা সের খাসির মাংস। দুরো বা কাউঠা নামের কচ্ছপের মাংস ছ আনা কিলো— সাঁইত্রিশ নয়া পয়সা। আমি ছ আনা আট আনা সের গো মাংসও দেখেছি ষাটের দশকে। ইদানিং তা প্রায় তিনশো। কোথাও কোথায়ও আড়াইশো টাকা।

গো কুরবানির পর বট, ক্ষিরি, ফেঁপসা— সবই আলাদা আলাদাভাবে রান্নার ব্যবস্থা আছে। ষাটের দশকে শুনেছি ব্রহ্মপুরে মাংসঅলারা আসতেন বাড়ি বাড়ি ঘুরে গো-মাংস বিক্রি করতেন। বট, ফেঁপসা ফ্রি হত অনেক সময়। গরুর বাঁট কুরবানির পর কুচি কুচি কুচি কুচি করে ক্ষিরি হয়। ক্ষিরি খেতে চমৎকার। 

শুনেছি মেটিয়াবুরুজ বা মেটেবুরুজে জ্বাল দিয়ে দিয়ে কুরবানির মাংস এক বছর রাখা হয় আর সেই গোমাংস মুড়ি দিয়ে টিফিন ও ভাতের সঙ্গে খাওয়ার। এই এক বছরের হিসাব সত্যি না মিথ্যে বলতে পারব না। তবে কুরবানির ঈদের পর গোশত আর গোশত। ঈদ-কুরবানির গরুকে শিঙে দড়ি বেঁধে ফেলা বেশ তকলিফের। কুরবানির গরু, ষাঁড় কখনও কখনও যথেষ্ট আহত করে কুরবানি দিতে আসা লোকজনদের। ফলে গরুকে মাটিতে ফেলা ও জবেহ— জবাই করা বেশ পরিশ্রমের কাজ। জোয়ান ছেলেরা ছাড়া পারে না। ঈদের কুরবানির গোশত অবশ্য পিস করে দাঁড়ি পাল্লায় মেপে ওজন করে আত্মীয় বাড়ি বাড়ি, প্রতিবেশীদের পাঠান বাড়ির মেয়েরা। কুরবানির এই মাংস কাটার জন্য ধারালো ছুরি, ধারওয়ালা ছোট, পোক্ত হাতকুড়ুল সবই আছে। তারপর দাঁড়ি পাল্লা ধরে বাটখারা মেপে ওজর করা, নারীরাই সব করেন। পাঠান, পাঠানোর ব্যবস্থা করেন বাড়ি বাড়ি। প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের। মোটরবাইকে বাইকে থলিতে থলিতে মাংস যায়। আসে।

কালীঘাট কালীমন্দিরে কালীপুজোর রাতে বলির হাঁড়িকাঠের সামনে লম্বা দাড়ি আর চুল সমেত আসতেন আঁই আঁই বাবা। ‘আঁই আঁই বাবা’ কেন, না মুখে দিনরাত আঁই আঁই আঁই আঁই উচ্চারণ করেন। রোগা চেহারা। তেমন লম্বা নন, একাবারেই। পরনে ধুতি আর সোনালি হলুদ পাঞ্জাবি। তিনি আঁই আঁই আঁই আঁই বলতে বলতে বলির যূপকাষ্ঠ স্পর্শ করতে চাইতেন। সে নিয়ে বলব সামনের বার, আঁই আঁই বাবার হাঁড়িকাঠ স্পর্শাভিলাষ।

মন্দিরের ঘাতক রবি শ্যামা কালীপুজোর রাতে বলিকাঠের চারদিকে খুব ভিড় জমে গেলে ছিন্নশির, রুধির লিপ্ত ছাগদেহটিকে ছুঁড়ে দিতেন জমাট বাঁধা পাবলিকের দিকে। বলি দেওয়া পাঁঠার রক্ত তীরবেগে ছিটকে এসে অনেকেরই গায়ে, পায়ে, ব্যস ভিড় পাতলা। তারপর আবার ভিড়। তখনও বলিদানের হাঁড়িকাঠ দুটিকে ঘিরে দেওয়া হয়নি। সেটা সত্তর দশকের শেষ।

Powered by Froala Editor