চায়ের গল্প, শ্রম ও প্রকৃতিনির্মাণ (তিন)

সময়ভ্রমণ - ৪৮
আগের পর্বে

চিন থেকে চায়ের চারা এল ঠিকই। কিন্তু ব্রিটিশদের সমস্ত সমস্যার সমাধান হল না। সবচেয়ে বড়ো সমস্যা সস্তা শ্রমিকের যোগান। এই বিষয়টি নিয়ে ফরচুন থেকে রিসলে প্রত্যেকেই চিন্তিত ছিলেন। বিশেষ করে নেপালের হিন্দু রাজাকে আদৌ বাগে আনা যাবে কিনা, তা নিয়ে সন্দিগ্ধ ছিলেন সকলেই। অবশ্য ভুটান এবং তিব্বতের মানুষদের তাঁরা বর্বর বলেই মনে করতেন। তিব্বতী বৌদ্ধদের যে নিজেদের দেশের সংখ্যালঘু করে দেওয়া যাবে, সে-বিষয়েও বিশ্বাসী ছিলেন রিসলে। অবশেষে সিকিমের সঙ্গে বিবাদের মধ্যে দিয়েই সমস্যার সমাধানের রাস্তা খুলে গেল। এলাকার সামগ্রিক ডেমোগ্রাফি তো বদলে গেলই, সেইসঙ্গে এক বিরাট সংখ্যক সস্তা শ্রমিক ব্রিটিশদের অধিকারে এল। কোম্পানির চা চাষের ব্যবসায় এ এক বিরাট লাভ।

দক্ষ শ্রমজোগাড়ু হিসেবে ক্যাম্পবেল বিশেষ নাম কিনেছিলেন। গবেষক টাউনসেন্ড মিডলটনের কথা ইতিপূর্বে এসেছে। ঔপনিবেশিক ও উত্তর-উপনিবেশ দার্জিলিংয়ের রাজনীতি সমাজ পরিবেশ অর্থনীতি ইত্যাদি নিয়ে অতীব মূল্যবান একটি প্রবন্ধ সংকলন সম্পাদনা করেছেন মিডলটন ও সারা শ্নাইডারম্যান। 

দার্জিলিং রিকনসিডার্ড নামের সেই সংকলনের প্রথম দিকে মিডলটনের একটি লেখা আছে। মূলত লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরির ইন্ডিয়া অফিস রেকর্ডস-এর অন্তর্ভুক্ত অসংখ্য দলিলদস্তাবেজ ঘেঁটে, দার্জিলিংয়ের চা শ্রমিক ও দার্জিলিং জায়গাটা সম্পর্ক মিডলটন চমকপ্রদ সব তথ্য তুলে ধরেছেন। দার্জিলিং ছেড়ে দেশে চলে যাবার প্রাকমুহূর্ত অবধি পড়োশি দেশ(মুখ্যত নেপাল) থেকে লোক--কুলি এবং রাইয়ত--ধরে এনে নিজের রাজত্বে বসিয়েছেন ক্যাম্পবেল। কাকে কতটা জমি কী দামে কী শর্তে দিচ্ছেন, কোন জমিতে চা বাগান উঠছে, কুলিরা কী শর্তে চা বাগানে কাজে লাগছে, কী আইন কী আইনভঙ্গ, কী ঠিক কী ভুল, সব কিছু ঠিক করতেন ক্যাম্পবেল নিজেই, তাঁর হাতে অভূতপূর্ব শাসনক্ষমতা দেওয়া ছিল। কোম্পানির কালে এবং পরের দিকের কিছু বছরের রানির শাসনকালে কলকাতা বা লন্ডনের সরকার ক্যাম্পবেলের কাজে বাধা দেয়ইনি বলা চলে। লয়েডের সময় থেকেই দার্জিলিং কার্যত নিয়ন্ত্রণ-বহির্ভূত অঞ্চল, বাংলা সরকারের আইনকানুন সেখানে চলত না। অথচ, লয়েড ইচ্ছামতো কাজ করার সুযোগ পাননি, তাঁর ঘাড়ে মাথায় কলকাতার কৌন্সিলকর্তারা দিবারাত্র নিঃশ্বাস ফেলেছেন, তাঁকে অপমানজনক ভাবে তাড়ানো হয়েছে। সে তুলনায় ক্যাম্পবেল অমিত একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী, স্বভূমে স্বরাট। এতে দার্জিলিংয়ের উন্নতি ঘটেছে, যে জমি থেকে সিকিমরাজার আদায়তসিল নামমাত্র, ক্যাম্পবেল রাজত্বে সে জমি পত্রেপুষ্পেখাজনায় ও পুঁজিতে সদাপল্লবিত, কোম্পানির কর্তারা বিগলিত মন্তব্য করছেন, আহা, দার্জিলিংয়ের শাসনব্যবস্থা যেন জমিদারি চালানোর মতো মসৃণ, উপরন্তু সরকারি রাজস্বও দিব্যি আদায় হচ্ছে। তা হোক, ক্যাম্পবেলকে ছাড় দিয়েই রাখা হয়েছিল, কোম্পানিভারতের আইনে ব্যক্তি সায়েবপ্রশাসক কিম্বা নেটিভ জমিদার, কারুর হাতেই একচ্ছত্র আইনি ক্ষমতা ছিল না। ১৮৫৪ সালের এক দলিল থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন মিডলটন :

“অদ্যকল্য না হউক, অধিকার প্রসঙ্গে জটিল প্রশ্নাবলী উত্থাপিত হইবেক; অধ্যক্ষের(ক্যাম্পবেল) ক্ষমতার সীমা লইয়া আইনি চর্চা শুরু হইয়া যাইবে। ফলত, একটি নূতন আইন প্রণয়ন বাঞ্ছনীয়, যদ্বারা অধ্যক্ষকে ক্ষমতা প্রদান করা যাইবেক...”

ক্যাম্পবেল ইচ্ছামতো জমি বিলিয়েছিলেন। পাহাড়ের এবং পাদশৈল ও তরাই-মোরাং-এর প্রায় সমস্ত জমি পোড়ো বা ওয়েস্টল্যান্ড বলে দেখিয়ে সেগুলো জলের দরে, কখনো বিনিপয়সায় প্ল্যান্টার সায়েবদের দিয়ে দেওয়া হল। সেসব জমির অনেকগুলোতেই পুরোনো জুমিয়া বসতি বা চারণভূমি ছিল, নতুন বন্দোবস্তে সেসব গ্রাহ্য করা হল না। সায়েবরা এই 'পদ্ধতি' ভারতের সর্বত্র চালিয়েছে। যে জমি কারুর নামে লেখা নেই, তা রাষ্ট্রের, সরকারের, সরকারি আমলার। জমি নিয়ে রাষ্ট্ৰ, সরকার, আমলা ব্যক্তিমালিককে দেবে, সেই জমিতে লাভজনক কিছু হবে, পুঁজি ফলবে। জমিতে স্থায়ী ও নিরাপদ ব্যক্তিমালিকানা তৈরি করতে চেয়ে ওয়ারেন হেস্টিংস চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেছিলেন, কোম্পানিবাংলার চাষিদের ও হস্তশিল্পী কারিগরদের জবরদস্তি জমিদারের প্রজা বানানো হয়েছিল। সিকিম থেকে নেওয়া দার্জিলিং ও ভুটান থেকে নেওয়া জলপাইগুড়ির দুয়ার অঞ্চলে জমিদারি প্রথা চালু হয়নি। প্রয়োজনও ছিল না। যেখানে চা-চাষ করা মুশকিল, সরকার নিজে জমিদার হয়ে প্রজা বসিয়েছে। শুধু কৃষিজমি নয়, যেখানে স্থানীয় রাইয়তরা চাষ করে। বনভূমি ও টঙিয়া গ্রাম/বনগ্রামের গল্প এসেছে, গ্রামবাসীদের সেখানে সরকারের হয়ে বেগার দিতে হত। চা-চাষে গেছে যে জমি, সেখানে কথাই নেই, যে প্ল্যান্টার সেই জমিদার, যারা কুলি তারা প্রজাও বটে, কাজ না করলে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। 

আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, শ্রম ও প্রকৃতি-নির্মাণ (দুই)

ক্যাম্পবেল এবং পরবর্তী প্রশাসকরা দার্জিলিংয়ের জমি নিয়ে যথেচ্ছাচার করতে পেরেছিলেন, তার প্রধান কারণ, বাংলা সরকারের জমি সংক্রান্ত আইনকানুন দার্জিলিংয়ে খাটত না, জমির ওপরে রাইয়তের অধিকার স্বীকার করাই হত না একরকম। দ্বিতীয়ত, স্থানীয়দের কাছে জমির মালিকানার বা বসবাসের অধিকারের লিখিতপড়িত কাগজ ছিল না। ফলে যে জমিতে লোক আগে থেকেই বসে আছে, পশু চরাচ্ছে বা চাষ করছে, সেসব জমিও বিনাবাধায় হাতবদল হয়ে গেছে, যে কিনছে আর যে বেচছে তারা ছাড়া কেউ জানতেও পারেনি। 

আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, শ্রম ও প্রকৃতিনির্মাণ

ক্যাম্পবেল চলে যাওয়ার পরে, তিস্তার এপারে ওপারে সিকিম-ভুটান জুড়ে যে নতুন দার্জিলিং তৈরি হল, তার জমি মাপার কাজ শুরু হল। হান্টারের সংখ্যাতাত্ত্বিক বিবরণের দার্জিলিং খণ্ডে তৎকালীন ভূমিরাজস্বব্যবস্থার  বিশদ বৃত্তান্ত আছে। এক্ষেত্রে হান্টার নির্ভর করেছিলেন ১৮৭৪ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বরে জমা পড়া শ্রীযুত যে ওয়্যার এডগার(দার্জিলিংয়ের ডেপুটি কমিশনার) কতৃক প্রস্তুত রিপোর্টের ওপর। সে রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, 'অনিয়ন্ত্রিত' দার্জিলিংয়ে জমিজমা নিয়ে যে পরিমাণ নিয়মবহির্ভূত কাজ হয়েছে, আজকের সময়ে হলে নির্ঘাৎ তাকে ঘাপলা ইত্যাদি বলা হত। প্রথমত পুরোনো দার্জিলিং, যে জমিতে দার্জিলিং শহর এবং যেটা লয়েডের সময়ে হাতবদল হয়েছিল, সেখানে প্রথমে লয়েড এবং পরে ক্যাম্পবেল এবং তাঁর উত্তরসূরি বি ডব্লিউ মর্টন  যাকে যেভাবে ইচ্ছা জমি দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে পরে আসব। 

আরও পড়ুন
চিন, জাপান, হল্যান্ড, ব্রিটেন: চায়ের বহু গল্প (চার)

সায়েবদের কাছে বেচে দেওয়া জমিতেও যে জনবসতি ছিল, বা স্থানীয়রা সে জমি অন্য কাজে ব্যবহার করতেন, এডগারের রিপোর্টে তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। মিডলটন দেখাচ্ছেন, দার্জিলিংয়ের ভূমিব্যবহার নিয়ে কলকাতার কর্তারা চিন্তিত, ১৮৭২-৭৩ নাগাদই চিঠিচাপাটি কথাবার্তা চলছে, সম্ভবত সেই সূত্রেই এডগারের রিপোর্ট। রাজস্ববিভাগের ১৮৭৩ সালের নথি উদ্ধৃত করে মিডলটন বলছেন, চা-য়ের জন্য ইজারা দেওয়া জমিতে নেটিভ চাষি থাকলে তাদের বলা হতো সরে যেতে, কচ্চিৎ কদাচিৎ খাজনা দিয়ে থাকতে, কিম্বা কখনো সখনো, বাগানে কুলির কাজ করতে। 'দার্জিলিং জেলায় পোড়ো জমি বিক্রি নিয়ে বেনিয়ম' শীর্ষক বাংলা সরকারের এক সিদ্ধান্তে স্পষ্ট বলা হচ্ছে : 

আরও পড়ুন
চিন, জাপান, হল্যান্ড, ব্রিটেন: চায়ের বহু গল্প(তিন)

“পুরোনো ভূমিদান লইয়া দার্জিলিং জিলায় সচরাচর বলা হইয়া থাকে যে 'জমি দিবার পর' সেস্থলে লোকে আসিয়া বসিয়াছে। কিন্তু হুকারের জর্নল এবং অন্যান্য দস্তাবেজাদি হইতে স্পষ্ট বুঝা যাইতেছে যে যে অঞ্চলে একদা সমৃদ্ধ লোকবসতি বর্তমান ছিল অধুনা তাহা চা-কর দিগের সম্পত্তি। মাননীয় লাট সাহেব এ বিষয়ে নিঃসংশয় কৃষকদিগকে বে-এক্তিয়ার দখলদার রূপে চিহ্নিত করা হইয়াছে, তৎসহ পূর্ব হইতেই দখলে থাকা জমিকে দার্জিলিংয়ে প্রথমাবধি 'নষ্ট জমি' বিক্রির নিয়মানুযায়ী বিক্রয় করা হইয়াছে।”

এডগার তাঁর রিপোর্টে জানাচ্ছেন, কিছু কিছু চা বাগানে ঠিক কত জমি আছে, তার সঠিক হিসেব নেই। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলছেন ঘুমের বাঁদিকে তামসাং এবং মিম ('সম্ভবত ১৪০০ একর হবে'), এবং তাকদার একটু নিচে রংলি রংলিওট('৮০০ একর মতো হতে পারে মনে হয়') বাগানের কথা। এ ছাড়া আরো এগারোটা টুকরোয় বিভক্ত মোট দশ হাজার একর জমির কথা বলছেন এডগার, যেগুলো রাইয়ত সুদ্ধ বেচে দেওয়া হয়েছিল, পরে পোড়ো জমি হিসেবেও দেখানো হয় :

“...এই ১০০০০ একর... মদীয় পূর্বসূরি এই ভূমিসকলকে 'নষ্ট জমি' রূপে চিহ্নিতকরণের পক্ষপাতি ছিলেন, তত্ৰাচ আমি ঐ ভূমিমধ্যে কৃষিকর্মরত চাষিদিগের সাক্ষাৎ পাইয়াছি।...এই ভূমিখণ্ডগুলির অধিক অংশই একদা দানরূপে বিতরণ করা হইয়াছিল…বিবিধ কারণবশত ইহাদিগের স্বামীত্ব পুনরায় সরকারে অর্শিয়াছে।...মদীয় পূর্বসূরির মতে এতদৃশ ভূমিব্যবহারকারি চাষিমাত্রই অবৈধ দখলদার….এ বিষয়ে আমার মত হইতেছে সমুদয় চাষি সরকারে আপন আপন খাজনা দিতে আগ্রহী, উহাদিগের অজ্ঞাতসারে জমি বিক্রয় করা হইবে না তাহা নিশ্চিত করিতে হইবে...”

Powered by Froala Editor