কালী, মহালক্ষ্মী, দীপাবলি, দিওয়ালি

মুছে যায়?— ৬৬
আগের পর্বে

কোজাগরী পূর্ণিমায় কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো মূলত পূর্ববঙ্গের আচার। যাঁরা পদ্মাপারের বাঙাল নন, তাঁরা কালীপুজো বা দীপান্বিতার দিন মহালক্ষ্মী পুজো করেন। ইদানিং গজলক্ষ্মী পুজো এবং তার হিন্দি ঘেঁষা বাংলা পাঁচালির চল বেড়েছে পশ্চিমবঙ্গে। ১৯৫৩-৫৪ সালে বাজারে পাওয়া লক্ষ্মীর পাঁচালির বেশিরভাগই ছাপা হত চিৎপুরের বটতলায়। খেলো কাগজে লাল অক্ষরে ছাপা হত সেসব বই। অবশ্য তারকেশ্বরের পাঁচালি ছাপা হত কালো কালিতে। তার মলাটে লেখা ‘রাঢ়েচ তারকেশ্বর…’। সঙ্গে তারকেশ্বরের শিবলিঙ্গের ছবি। তারপর...

আশ্বিন মাসে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো একেবারেই পূর্ববঙ্গের— পদ্মাপারের বাঙালদের। যশোর, খুলনার যাঁরা আদি অধিবাসী, তাঁরা তো সেই অর্থে ‘খানদানি বাঙাল’ নন একেবারেই, তাঁরা কালীপুজোর দিন যে ‘মহালক্ষ্মী’ পুজো, তা করে থাকেন নিজেদের বাড়ি। মহালক্ষ্মীপুজো দিনেই হয়। গোবরের তৈরি প্রেত-প্রতিম অলক্ষ্মী। যেন কোনো জাদু-টোনার পুতুল শোয়ানোকলার ‘পেটকো’— কলা গাছের ‘পেটো’— ছালের— বাকলের ওপর। কলাগাছ কেটে তার ‘পেটকো’— ‘পেটো’ বা বাকলের ওপর মহালক্ষ্মী পুজোর গোবরে তৈরি অলক্ষ্মী যেমন রাখা হয়, তেমনই এই কলার ‘পেটো’ দিয়ে কোজাগরী লক্ষ্মী আরাধনার নৌকো তৈরি করা হয়। সেই আরাধনা নৌকোয় থাকে তিনটি বা চারটি গোলা, তাও তৈরি হয় কলাগাছের ছাল দিয়ে, সেইসব গোলায় ধান, পঞ্চশস্য, কড়ি, সোনা-রুপোর টাকা, যার যেমন সামর্থ্য রাখেন। রুপোর টাকা মানে রানি মার্কা, নয়তো ন্যাড়া রাজা মার্কা। এক সময়, যখন ষোলো আনা ছিল এক টাকার হিসেব, অর্থাৎ চৌষট্টি পয়সায় এক টাকা, তখন এই টাকা ‘রানি’ মার্কা রুপোর টাকা এক টাকাই। থাক সে সব কথা। কেননা চল্লিশ টাকায় ফুল গিনি দেখেছেন, এমন মানুষ বেঁচে ছিলেন এই সেদিনও। গিনির মধ্যে ফুল গিনি, হাফ গিনি— এরকম বিভাজন— ভ্যারাইটি তো ছিলই। এখনও বাজারে রানি মার্কা, ন্যাড়া রাজা মার্কা ফুল গিনি, হাফ গিনি পাওয়া যায়। শৌখিন কালেকটাররা কেনেন, তবে ফুল গিনি বেশি, হাফ গিনি কম।

কোজাগরী পূর্ণিমায় একদা পূর্ববঙ্গের বাঙালদের যে লক্ষ্মীপুজো, সেই অনুষ্ঠান জেলা ভেদে বিভিন্ন রকম। আমি এখানে মূলত লক্ষ্মী সরার ডিজাইনের বিভাজন বলছি। আমাদের বাড়ি তিন পুতলা লক্ষ্মী, অর্থাৎ লক্ষ্মী, জয়া-বিজয়া এবং লক্ষ্মীর পায়ের কাছে থাকা প্যাঁচা, সেই পেচকের একটি চোখ থাকলে আমার পিতৃদেব অমর নাথ রায় কিনে নিতেন না। আমি নিজে খড়দার রহড়া বাজার এবং বালি বাজার থেকে সত্তর দশকের প্রায় শেষবেলায়, চার আনা মানে পঁচিশ পয়সায় একটি লক্ষ্মীর সরা কিনেছি। সেই তিন পুতলা ছাড়াও দুর্গা-লক্ষ্মী, যে লক্ষ্মী সরায় দুর্গামূর্তিসহ লক্ষ্মী থাকেন, ওপরে দুর্গা, নিচে লক্ষ্মী, সেইসঙ্গে রাধাকৃষ্ণ ও লক্ষ্মী, লক্ষ্মী ও নারায়ণ— একই সঙ্গে, একই সরায়, নিচে লক্ষ্মী মূর্তি, ওপরে প্যানেলদার— সরু প্যানেলে, যেটুকু প্যানেল লক্ষ্মী সরায় আঁকা সম্ভব, তেমন প্যানেলে নারায়ণ ও লক্ষ্মী, নারায়ণ ও লক্ষ্মী, নিচে পেচক বাহনা লক্ষ্মী— এভাবেই সাজানো আছে একে একে। এছাড়াও দুই সখী জয়া-বিজয়া বিহীন শুধুমাত্র কমলাসনা লক্ষ্মী— সরাতে আঁকা, এরকম লক্ষ্মীও পাওয়া যায় বাজারে। পূর্ববঙ্গের বহু জেলায় ধান মাপা কুনকের ওপর লাল পাড় নতুন শাড়ি দিয়ে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো হয়। কুনকের ওপর লক্ষ্মীর আরাধনা এ বঙ্গেও— মানে অখণ্ড বঙ্গের পশ্চিম দিকেও চলে আসছে। ধান, কড়ি, ধানের ছড়া, সোনা ও রুপোর ধাতুমুদ্রা— সবই পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গে কম ফ্যাকটর। পূর্ববঙ্গের কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোয় কোথাও কোথাও আতসবাজি, পটকা ইত্যাদি ফাটানোর ব্যাপার ছিল। শব্দবাজি, আলো বাজি— দুই-ই। ফরিদপুরের কোঠাও কোথাও, বরিশালেও কোজাগরী পুজোর সময় শব্দমান আতসবাজি বাজানোর ব্যবস্থা। সেখানে কলাবউ ও দুর্গালক্ষ্মী সরা পুজোর প্রধান কেন্দ্র। এছাড়াও গোটা আখ, তাও কোজাগরী পুজোর সম্পদ। পশ্চিমবঙ্গে ভাদ্র লক্ষ্মী, পৌষ লক্ষ্মী, চৈত্র লক্ষ্মী, মহালক্ষ্মী পুজো কার্তিক মাসে। সেখানে গরুর গোবর দিয়ে তৈরি অলক্ষ্মী মূর্তির দুচোখ তৈরি হয় কড়ি দিয়ে। তাঁর ভুঁড়িও থাকে ঈষৎ। আতপ চাল ভিজিয়ে তারপর তাকে শিলে বেটে পিটুলি। তা দিয়ে অন্য মূর্তি। সেই পিটুলি দিয়ে তৈরি হয় লক্ষ্মী-নারায়ণ ও কুবের। কালীঘাটের কালী মন্দিরে দীপান্বিতা কালীপুজোয় মহালক্ষ্মী পুজো হয়, খুব ধুম করে। সেখানে মহালক্ষ্মীর জন্য আমিষ ভোগ। মৎস্য ভোগ। পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গ— অখণ্ড বঙ্গের যশোর-খুলনায় যে মহালক্ষ্মী পুজো হয়, তাও দিনের বেলাতেই। অথচ বাঙালদের সন্ধ্যা না লাগলে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো শুরুই হয় না। আমাদের বাল্যকালে কোজাগরী লক্ষ্মী আরাধনায় তালের ফোঁপর, ভাদ্র মাসে অলক্ষ্মীর তালের বড়া খাওয়ার পর যে তালের আঁটি থাকে, তা দিয়েই তো তালফোঁপর। পোক্ত বাঁশের ঝুড়ির ওপর তালের সরস আঁটি গুলে গুলে গুলে তালের রস বা ‘মাড়’ বের করে আনার পর সেই আঁটি ছাইগাদা বা উঠোনের মাটিতে। তা থেকেই গ্যাঁজ বেরিয়ে এসে তালফোঁপর। ঝুনো নারকেলে ফোঁপর— শিকড়-সম্ভাবনা তৈরি হলে তখন তাকেও লাগানো হয় পুজোয়। কোজাগরী অক্ষ্মীপুজোর আসন সাধারণভাবে কাঠের বড়ো জলচৌকিতে পিটুলি গোলা দিয়ে আলপনা দেওয়ার পর সেখানে লক্ষ্মীর সরা বসানো হয়। সরার দুপাশে দইয়ের ভাঁড়। একটি পাত্রে— ছোটো পানের ডাবর হলে সবচেয়ে ভালো হয়, তার ভেতর পান রাখা। সঙ্গে গুয়া— সুপুরি। পরিষ্কার পাত্রে ঝুনো নারকেল ফাটিয়ে তার জলে দেওয়া হয় চিঁড়ে। ‘কোজাগরী’ দেওয়া হল। তার সঙ্গে ক ছড়া— খান বারো পাকা কাঁঠালি কলা ওই আসনেই। এরপর কলার বাকল বা পেটকো দিয়ে তৈরি নৌকো। এখন একটি কলার পেটকো দিয়ে তৈরি সাজানো গোছানো নৌকোর দাম চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ টাকা। একটা বড়োসড় কলার পেটকো দশ টাকা। আমার পিতৃদেব অমরনাথ রায় চমৎকার নৌকো তৈরি করতে পারেন এই কলার বাকল দিয়ে। এই নৌকোয় ছই, গোলা, মাঝি— সবই থাকত। বাবা ছুরি দিয়ে কেটে কুটে বানিয়ে নিতেন নৌকো। তার সেলাইও হত কলা গাছের পেটকো থেকে বার করে আনা পোক্ত আঁশ দিয়ে। বেশ শক্ত এই সুতো সুতো আঁশ। 

বাবা ছুরি দিয়ে কলার খোলা কেটে কেটে বানাতেন পুজোতে লাগা নৌকোর মাঝি। ঘটের ডাবে যেমন তেল-সিঁদুরের দাগ-দাগালি দেওয়া হয়, কলার খোলায় তৈরি নৌকোর ছইয়ে, গায়ে টেনে দেওয়া হয় তেল-সিঁদুরের দাগ— লম্বা করে। সাধারণত ঝুনো নারকেলের জলে ভাজানো চিঁড়ে রাখা হয় কালোপাথরের বাটিতে, শ্বেত পাথর, অন্য রঙের পাথরে তৈরি বাটিতে কোজাগরী দেওয়ার নিয়মই প্রশস্ত। মাঘ মাসে সরস্বতী পুজোয় যেমন কদমা, বীরখণ্ডী— তিলুই বাধ্যতামূলক প্রায়, সরস্বতীর প্রসাদের ক্ষেত্রে, দোলে যেমন চিনিতে রঙিন মঠ, ফুটকড়াই আবশ্যিক ছিল তেমনভাবে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোয় নারকেল নাড়ু, তিলের নাড়ু, নারকেল ছাপা বা নারকেল ছাবা যেমন লাগেই, সেইসঙ্গে খইও খইয়ের মুড়কি— যাকে উপড়া বলেন বাঙালরা। যেমন উলু দেওয়া— উলুধ্বনিকে বলেন তাঁরা ‘জোকার’ দেওয়া, তেমনই এই বিশেষ উচ্চারণ ধানের খইকে ‘উপড়া’ বলা। 

ইলাহাবাদে দিওয়ালি বা দীপাবলিতে সারা রাত তাসের বা অন্যান্য জুয়া খেলা দেখেছি। যাঁরা বাইরে এসে জুয়া খেলতে পারেন না, তাঁরা নিজেদের ভেতর জুয়া খেলেন ঘরের মধ্যে। সংস্কার— দেওয়ালির রাতে জুয়া না খেললে নাকি পরজন্মে— আগলে জনম মে ছছুন্দর— ছুঁচো হয়ে জন্মাবেন। এই ধারণা থেকে ইলাহাবাদ সহ গোবলয় বা হিন্দি বলয়ের নানা জায়গায় এই জুয়া চলে আর সেই সঙ্গে লক্ষ লক্ষ টাকা ওড়ে বাজারে। সত্তর দশকের প্রায় শেষদিকে কালীঘাটের লেডিজ পার্কে একজন স্বঘোষিত তান্ত্রিক দশমহাবিদ্যার পুজো করতেন, পার্কে দশমহাবিদ্যা ও নওরাত্রির শ্রী শ্রী চণ্ডিকার যে রূপকল্পনা আছে, সেই আদলে মূর্তি সাজিয়ে নিজের ‘আরাধনা’ সারতেন। সেই ‘আরাধনা’ পদ্ধতিতে হরিণ বলি হতে দেখেছি। টালুমালু চোখের পুরুষ চিত্রল হরিণ, শিঙেল। এছাড়াও সেখানে বলির জন্য মেষ— ভেড়া, ছাগ, মহিষ ইত্যাদি থাকত। সেইসব বলিযোগ্য জীবন্ত চারপেয়েদের সাজিয়ে রাখা হত অনায়াসে, খাঁচার ভেতর। সেই তান্ত্রিক বা আওঘর— খুব লম্বা নন মোটেই। সামান্য ভুঁড়িও আছে। চেহারা দেখলেই তিনি যে বলশালী— যথেষ্ট বলশালী বোঝা যায়। সাধারণভাবে মালকোঁচা মারা ধুতি আর সুতির হাফশার্ট পরতেন তিনি। হাগ হাতা, হালকা ধারিদার— চেকদার কাপড়ের শার্ট। বুকে দুটি পকেট। দুটি সাইড পকেট। তার মুখটি গোল— বড়ো। সেই মুখে হালকা হালকা কালো দাড়ি, মাথার চুল পনিটেল। তাঁর কপাল প্রশস্ত— যথেষ্ট চওড়া। চেহারাটি মনে আছে পরিষ্কার।

আরও পড়ুন
লক্ষ্মীর পাঁচালি, তারকেশ্বর…

কালীঘাট লেডিজ পার্কে তাঁর ডেরা ছিল হয়তো কোথাও। কিংবা কোনো ভক্ত বা শিষ্যের বাড়ি ছিল তাঁর আস্তানা। আবার বিশেষ কোনো হোটেল ঠিকানায় থাকতে পারতেন তিনি, এমনও অনুমান, কল্পনা করতে পারি। সেই চন্দ্রঘণ্টা, কুষ্মাণ্ডা, শীলপুত্রী ইত্যাদি নওরাত্রির দেবীদের সঙ্গে সঙ্গে কালী, তারা, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, বগলা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ধূমাবতী, মাতঙ্গী, কমলা ইত্যাদি দশমহাবিদ্যার মূর্তি সহ আরাধনা ইত্যাদিও ছিল দেখার। ইলাহাবাদ কুম্ভে আমি এই আওঘর বা তান্ত্রিককে মূর্তি সহ দেখেছি। এভাবেই ঠাকুর— প্রতিমা সাজিয়ে তিনি ইলাহাবাদ কুম্ভমেলায় ছিলেন।

ইলাহাবাদে দেখেছি কালীপুজোর পরের রাত্রিতে দীপাবলি— আলোর উৎসব— দিয়া— পিদ্দিম ও মোমবাতি জ্বালানো। ইলাহাবাদ বা হিন্দি বলয়ে কোনো ভূত চতুর্দশীর অনুষ্ঠান— প্রদীপ জালানো ইত্যাদি দেখিনি। দীপান্বিতা কালীপুজোর আগের রাত্রে ভূত চতুর্দশী। সেদিন চৌদ্দ শাক বা চোদ্দ শাক খাওয়া, বাঙালি হিন্দুর ঘরে আবশ্যিক। শুধু এখন— এখন কেন, বহু বছরই তো চোদ্দ শাক হিসাবে বাজারে যা বিক্রি হয়, তাতে কতদূর চোদ্দ শাক, বিলক্ষণ সন্দেহ আছে। এ কুচনো শাকের বেশিরভাগটাই তো লাল শাক, নটে শাক, কলমি, পালং— ব্যস। বাকি সবই অচিন রাগিনী। চেনা যায় না, এমন শাক। থাকে কী আদৌ, জানা নেই। আমাদের বালির বাড়িতে ভূত চতুর্দশীর দিন আমি দেখেছি চোদ্দটি মাটির পিদিমে তেল দিয়ে, সলতে পাকিয়ে সলতে দিয়ে চোদ্দটি প্রদীপ রেডি। আমি দেখেছি স্টার— তারা মার্কা পোড়া মাটির প্রদীপ একটি দশ নয়া পয়সা। প্রথমে পাঁচ নয়া ছিল, পরে যেমন হয়, দাম বেড়ে বেড়ে এই ‘স্টার’ মার্কা প্রদীপ সত্তর দশকের শেষ দিয়ে চার আনা— পঁচিশ নয়া পয়সা, একটি এক পিসের দাম। পোড়া মাটির এই প্রদীপ যাতে সর্ষের তেল বেশি না টানে তার জন্য লোহার বালতির জলে তাকে ভিজিয়ে রাখা প্রায় বারো-চোদ্দ ঘণ্টা। মা কাঁচা মাটির প্রদীপ না শুকিয়েই ব্যবহার করতেন। ছোটো ছোটো— অতি ক্ষুদ্রই বলা যায় তাকে, সেই পিদ্দিম নিজে তৈরি করে ব্যবহার করতেন মায়ের হাতের তৈরি সামান্য কালচে, রোদে না শুকনো এঁটেল মাটির প্রদীপ। তাতে সর্ষের তেল। সেই তেলে মায়ের হাতেই তৈরি সলতে। 

আরও পড়ুন
পুজোর পার্টি, ভাতি অথবা চারদিনের প্রেম

আমার মা গায়ত্রী রায় তাঁর ফরসা হালকা রোমময় পায়ের গোছে সোডা-সাবানে কাচাও, পরিষ্কার কিন্তু প্রায় জীর্ণ ধুতিকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে সলিতা বা সলতে পাকাতেন। তখনও রেডিমেড তুলের তৈরি সলতে সেভাবে আসেনি। অথচ গোবলয় বা হিন্দি বলয়ে সেই তুলোর সলতে বা সুতো পাকানো মোটা সলতে, তাতে বনস্পতি ডালডা বা ঘি মাখানো। ঘি বলে সাধারণত ডালডাই— বনস্পতি। সাদাটে রং তাদের— সলতেদের। হরিদ্বারে হর কি পৌড়িতে এই রকম সলতেঅলা পিদ্দিমই ভাসানো হয় রাতে। আসলে সন্ধ্যার মুখে মুখে। পাতার তৈরি নৌকো, তাতে কুচো ফুল, পিদ্দিম দশ নয়া পয়সা, পঁচিশ নয়া পয়সা, পঞ্চাশ নয়া পয়সা, একশো পয়সা— এক টাকা— সব চেয়ে বড়ো নৌকোটি। শুনেছিলাম পলাশ পাতায় তৈরি হ্য এই নাও। যত বেশি পয়সা খরচ করা যাবে, তত বেশি বড়ো, সুন্দর নৌকো। তাতে ফুলের পরিমাপও অর্থের পরিমাণ কম, বেশি নির্ধারিত হয়। হরিদ্বারে হর কি পৌড়ির ঘাটে ভাসানো হত এই নৌকোদের। অনেকেই ভাসাতেন। কাশীর দশাশ্বমেধ ঘাটে গত কয়েক বছরে চালু হওয়া গঙ্গা আরতি, নৌকো ভাসানো এই তো সেই দিনের। ষাট, সত্তর দশকেও দশাশ্বমেধ ঘাট আর তার ঠিক পাশের ঘাটটিতে যে গঙ্গা আরতি, তা তো অতি নবীন। অথচ ষাট ও সত্তর দশকে হর কি পৌড়ির গঙ্গা পুজো ও গঙ্গায় পাতার নৌকো ভাসানো তো নিত্য ছবির মধ্যে পড়ে।

গঙ্গার স্রোতের মধ্যেই গঙ্গা মন্দির, হরিদ্বারে। তাকে ঘিরেই পূজন, আরতি। এখান থেকে নীলধারা অনেকটাই দূরে। এসব নিয়ে লিখেছি একটু আধটু। আবার লিখব। ইলাহাবাদে দেখেছি দীপাবলি— দেওয়ালির পুতুল। গুড়িয়াঘর— পুতুলের বাড়ি তৈরি হয়ে দেখেছি ইলাহাবাদে, সেই খেলনা— ঘরে পুতুল-পুতলি-পুতলা। গুড়িয়া-গুড্ডা-পুং পুতুল, গুড়িয়া-গুড্ডি কন্যে পুত্তলি। সেই সঙ্গে পোড়া মাটির হাঁড়ি, বাটলোই— তিজেল ধরনের, তিজেল আর হাঁড়ির মাঝামাঝি সে এক বর্তন— বাসন। এছাড়াও পরাত, তসলা, বালতি, পিতলের বালতি, লোহার কড়াই, খুন্তি, ছানতা, হাতা। যেমন হয় সাংসারিক খেলনাপাতি। গুড়িয়াঘর-এর ভেতরে পিদ্দিম— দিয়া পরে মোমবাতি। মোমবাতি। দিওয়ালি— দীপাবলি পুতুল দেখেছি বীরভূমে, অখণ্ড মেদিনীপুরে। কলকাতাতেও অবাঙালি এলাকায়। কলকাতায়, তার গা লাগোয়া মফঃস্বলে রথের মেলার পুতুল, রাসের মেলার পুতুল— এসব তৈরি হত কুমোর পাড়ায়, কুমোর পাড়ায় পাড়ায়। উত্তর কলকাতার কুমোরটুলি, দক্ষিণ কলকাতার কালীঘাটের পটুয়া পাড়া। টালিগঞ্জে বড়ো রাসের মেলা বসত। ইদানিং তা কমতে কমতে অনেকটাই ছোটো হয়ে গেছে। আর কোভিডের পর তো মেলা প্রায় বন্ধই। কিন্তু ক্লাবেদের টাকা দেওয়ার ব্যাপারে কোনো কার্পণ্য নেই। দীপান্বিতা কালীপুজো— শ্যামা কালীপুজোর পাশাপাশি দক্ষিণা কালিকা, বামা কালিকা সবই পূজিতা হন এই দিনে। গৃহস্থর আরাধনার জন্য আছে দক্ষিণা কালিকা। দক্ষিণা কালিকা— শ্যামাকালীর সঙ্গে রক্ষাকালীর পুজো প্রচলিত আছে আধা শহর ও গ্রাম দেশে। তিন মাথার মোড়ে রক্ষাকালী, এক রাতের পুজো। সেই সঙ্গে সঙ্গে জ্যৈষ্ঠমাসে ফলহারিণী কালীপুজো, আর মাঘ মাসে রটন্তী কালীপুজো। ফলহারিণী পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে শ্রী রামকৃষ্ণ ও সারদা মায়ের নাম। রটন্তী কালীপুজোর রীতি কিছু ভিন্ন। পূর্ববঙ্গের বাঙালরা এই সেদিনও বাড়িতে কোনো শুভ অনুষ্ঠান হওয়ার আগে একটা কালীপুজো দিতেন, সে তো আগেই লিখেছি। সেখানে ভাত, ডাল, খিচুড়ি, শুক্তো, বোয়ালমাছ, শোল মাছ, অম্বল, পায়েস।

আরও পড়ুন
মার্কনি সেট, রঘুবাবু ও মহালয়া

Powered by Froala Editor