অসম্মানিত অমলা ছেড়ে দিতে চাইলেন নাচ

উদয়শঙ্কর ইন্ডিয়া কালচারাল সেন্টার যখন ভাঙছে, অমলা তখন নিমগ্ন নিজের নতুন সংসার আর সদ্যোজাত মাতৃত্বের আবর্তে। স্বামী আর সন্তানকে নিয়ে পরিতৃপ্ত এক জীবন। উদয়ের কাজের সহচরী তিনি, অংশগ্রহণ করতেন দলের নৃত্যেও--- কিন্তু এইটুকুই। দলের প্রশাসনিক কার্যকারণ থেকে তিনি নিজেকে রাখতেন বহুদূর। প্রশাসনিক দায়িত্বে সেসময়ে ছিলেন যাঁরা, তাঁদের তুলনায় অমলা তখন নেহাতই অপরিণত আর অর্বাচীনও। তবু এই বক্র-বাতাবরণ রেহাই দিল না তাঁকে। লাগাতার অভাব-অভিযোগ, নিন্দা-মন্দে ধূলিমলিন হয়ে উঠল আলমোড়ার হাওয়া। সেন্টারে তখন নানান মানুষ, নানান বক্তব্য, নানান সংকট মাথা তুলছে ধীরে-ধীরে। সেইসময় অভ্যন্তরিণ বৃহৎ পরিবর্তন বলতে সেন্টারে সদ্য ঘটেছে উদয়ের বিবাহ। ফলে উদয়ের যাবতীয় মতামত, সিদ্ধান্ত, ব্যর্থতা, স্ববিরোধ, অসহিষ্ণুতার দায় যেন অমলার, ক্রমশ নিঃসন্দিগ্ধ হয়ে উঠল এই ভাবখানা। প্রতিদিনের উনকোটি সমস্যার কুল না পেয়ে, সমস্যাকে এইভাবে একটা মূর্তি বানিয়ে দেখতে যেন স্বস্তি পেলেন অনেকে। চক্রব্যূহের মধ্যে দাঁড়িয়ে বিষোদ্গারের পথেই নিজেকে প্রশমিত করতে চাইল ব্যর্থ ক্রোধ। একসময় পিঠ ঠেকল অমলার।

২৭ জুলাই ১৯৪৪-এ উদয়শঙ্করকে লেখা অমলার একটি চিঠিতে ধরা পড়েছে সেই সময়কাল। চিঠিতে অমলা খোঁজ নিয়েছেন পূর্বে তাঁর রেজিস্ট্রি চিঠিতে বিয়াত্রিচে আর জোহরার চিঠির কপি পাঠিয়েছিলেন, উদয় তা পেয়েছেন কি না। অনুমান করা যায়, চাপান-উতোর পর্ব অব্যাহত তখনও। তারপর লিখেছেন, ‘জেরির [এলমহার্স্টকে উদয় ডাকতেন, জেরি] সঙ্গে আজকেই বোধহয় আপনার দেখা হবে। আমি সব কিছু জানার জন্য আকুল হয়ে অপেক্ষা করছি— কারণ এর ওপর নির্ভর করছে আপনার ভবিষ্যৎ এবং মানসিক শান্তি। আমি আগে কখনও এ কথা আপনাকে বলিনি কিন্তু আপনাকে সবসময় অত চিন্তিত আর উদ্বিগ্ন দেখে আমার ভীষণ খারাপ লাগত। ব্যাপারটা আমার হাতে থাকলে আমি আপনার জন্য সব কিছু করতে রাজি ছিলাম।’ দুর্দিনে  স্বামীর পাশটিতে এসে স্ত্রী জোগাতে চান বলভরসা, এ চিঠি বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারে না সেই সহজতায়। ধীরে ধীরে জটিল হয়ে ওঠে চিঠির বয়ান। বোঝা যায়, কী অসহনীয়, অমার্জিত কটূক্তি আর গঞ্জনার ভেতর দিয়ে নিরবিচ্ছিন্ন যেতে হয়েছে অমলাকে। সহজ একটি প্রণয়কে দাঁড় করানো হয়েছে জবাবদিহির এজলাসে। মানুষের জীবনে অনুরাগের আকস্মিকতা যে নিয়তই স্বতঃ স্বাভাবিক, অগ্রাহ্য করা হয়েছে সেই ব্যাপারটিকে। উদয়ের জীবনে অমলার প্রেম, বিবাহ নামক যৌথ যাপনটিকে করে তুলতে পেরেছে বিশ্বাসযোগ্য। তাঁর আদ্যন্ত উৎকেন্দ্রিকতা থেকে তাঁকে করে তুলেছে আত্যন্তিক গৃহী। তিনি তখন তাঁর জীবনের কেন্দ্রে আর পরিধিতে, গৃহরচনায় আর কর্মরচনায় ব্যাপৃত। তখন তিনি রয়েছেন সৃজনশীলতার তুঙ্গ মুহূর্তে। অথচ অমলার প্রতি কটাক্ষে গুরুত্ব পায়নি এই বিষয়গুলি। বরং এ বিবাহ যে ব্যর্থ হয়েছে উদয়শঙ্করের নতুনতর কৌলীন্য নির্মাণে, মন-গড়া সেই ভাবনাটিতেই ক্রমাগত অসহিষ্ণু হয়ে উঠছিল পরিবেশ। অমলাকে দাঁড়াতে হল সেই অগ্নিপরীক্ষায়।

অমলাশঙ্কর ও আনন্দশঙ্কর

 

চিঠির পরবর্তী অংশে অমলা লিখলেন, ‘কত সময় মনে হয় যে আপনার জীবনসঙ্গিনী হিসেবে আমি একেবারেই ব্যর্থ। আপনাকে কতটুকুই বা সাহায্য করতে পারি আমি?’ অমলার দুঃখের আড়ালটুকু সরে যায়। ‘বিয়্যাট্রিসের মতো একজন মেয়ে যে আপনার জীবনে সহায়তা করতে পারত, যার ব্যক্তিত্ব আপনার কীর্তির পথ সুগম করে দিত, তাকে ফেলে আপনি আমাকে বিয়ে করেছেন আপনার মহানুভবতার জন্য।’ আলমোড়ার দুর্যোগের মেঘ এসে দাঁড়ায় তাঁদের দাম্পত্যের চৌকাঠে। এ বেদনার সঙ্গে প্রতিনিয়ত তাঁকে যুঝতে না-হলে এ সকল কথা ঠাঁই পেত না তাঁদের নিজস্ব, একান্ত পরিসরটিতে। উদয়শঙ্করের জীবনে অমলার পদচারণা নিঃশব্দ। কোনোদিন উচ্চকিত নয় তাঁর প্রকাশ। উদয়শঙ্করের বর্তমানে অথবা অবর্তমানে, একত্র অথবা একলা পথ চলায় তিনি চিরদিন ধারণ করেছেন উদয়শঙ্করকেই। উদয়শঙ্করের ইচ্ছে আর আকাঙ্ক্ষার আধারটিকেই তিনি বহন করেছেন আমৃত্যু। তাঁদের দাম্পত্যের সূচনাতেও ছড়িয়ে ছিল সেই চিহ্ন। আসন্ন সময়ে উদয়শঙ্করের ঘরানায় তাঁর অবদানটি ক্রমে হয়ে উঠছিল নিরঙ্কুশ। দুর্ভাগ্য, অবিশ্বাসের দুর্ভেদ্য ধোঁয়াশায় ধরা পড়েনি সেই অমলাশঙ্কর।

আরও পড়ুন
উদয়শঙ্করের প্রশাসনিক ব্যর্থতার খবর পৌঁছল বিদেশে

উদয়শঙ্কর ও সিমকি

 

আরও পড়ুন
অমলার গায়ে হাত তুললেন সিমকি

চিঠির পরবর্তী অংশ চিনিয়ে দেয় তাঁর অসম্মানের সূচিতীক্ষ্ণ প্রকরণগুলিকে। অমলার ধৈর্য, দুঃখবোধ এবার জন্ম দেয় ক্ষোভ। চিঠি শেষ করার আগে তিনি জানালেন তাঁর স্বামীকে, ‘তবে আপনাকে নিশ্চিতভাবে এ কথা অন্তত বলতে পারি যে আমি জানি আপনি কত মহৎ, আপনার প্রতিভা কী মহান, এবং এ জগতে আপনার অবদান কী অসীম হতে পারে। কিন্তু যদি বলি বা বিয়্যাট্রিসরা ভেবে থাকে যে আপনি এমন একটি মেয়েকে বিয়ে করেছেন যে আপনাকে শুধু স্বামী হিসেবেই জানে, আপনার সরল শিশুসুলভ মনের সুযোগ নেয়, এবং আপনাকে দিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করাবার চেষ্টা করে, তাহলে তারা খুব ভুল করেছে। আমি কি এতই বোকা যে আপনার মহান কীর্তির পথ রোধ করে দাঁড়াব?’

আরও পড়ুন
বিয়ের আড়াই ঘন্টা আগেও উদয় চিঠি লিখলেন অমলাকে  

একদিকে বিধ্বস্ত কলাকেন্দ্র অন্যদিকে আনন্দময় গার্হস্থ্যের মাঝখানে দ্বিধাদীর্ণ দাঁড়িয়ে থাকেন অমলা। সেই কোন বাল্যকালে, তাঁর জীবনে উদয় আসারও আগে, নৃত্যের সঙ্গে তাঁর যোগ। আর সেই নাচের সূত্রেই উদয়ের সঙ্গে তাঁর সংযোগ। তারপর আদিনমান এক শিল্পবাস। তবু, সেই নৃত্যের আবহ থেকেই নিজেকে সরিয়ে নিতে চাইলেন অমলা। লিখলেন, ‘হয়তো আপনাকে সেন্টার খুলতে সাহায্য করার মতো ক্ষমতা আমার নেই… (কিন্তু) আমি জানি যে এ পর্যন্ত নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য আমি কিছু করিনি বা বলিনি। আমার নাচের জন্য যদি সিম-এর(সিমকি) অসুবিধে হয়ে থাকে, তা হলে আমি চিরকালের জন্য নাচ ছেড়ে দিতে রাজি আছি…’।

আরও পড়ুন
অমলার অনুভূতিলোকে সেদিন নামল প্রথম আষাঢ়

উদয়শঙ্কর ও জোহরা

 

এই সংকটাপন্ন সময়েও কী সুন্দরভাবে উদয় দখল রাখলেন পরিস্থিতির ওপর। শুধু বহিরঙ্গে নয়, ধাতুচরিত্রেই তিনি দলপতি। বিয়াত্রিচে অথবা সিমকি, বশি অথবা গার্টরুট সম্পর্কে স্মৃতিকেও সাধ্যমতো ধূসর-মলিন হতে দেননি তিনি। চিঠিতে অন্যের প্রতি প্রকাশ পেল না কোনো বিরূপতা। কথার দার্ঢ্য বুননে বিষয়কে উদয় মেলে দিলেন সদর্থক নির্লিপ্তিতে। অমলার চিঠির প্রত্যুত্তরে লিখলেন, ‘সিম-এর ব্যাপারে যে তুমি এত বিচলিত হয়েছ তা জেনে আমার খুব কষ্ট হল। মন থেকে এসব জিনিস একেবারে ফেলে দাও। আমাদের ছবির (কল্পনা) জন্যে তোমাকে নাচতে হবে, গাইতে হবে, অভিনয় করতে হবে…’। স্ত্রীর অসম্মান, তাঁর গহন দুঃখের দিনগুলিতে আশ্রয় হলেন তাঁর স্বামী। বিদ্রুপ-কুৎসার আঁচ থেকে আগলে রাখলেন অমলার প্রতিভাকেও। তবে এ চিঠির গুরুত্ব বহুমাত্রিক। চিঠির উল্লিখিত ওই পঙক্তির একদিকে অন্তর্লীন রইল একখানা প্রেমানুভূতি। সাধারণ মেয়ের তকমা দিয়ে যে অমলাকে করা হয়েছে ব্রাত্য তাঁর গুণের খবর রাখেন তাঁর স্বামী। অমলাকে আশ্বস্ত করলেন তিনি। তবে উদয়শঙ্কর শুধু অমলার স্বামীই নন, তাঁর গুরুও। তাই ওই বাক্যেই প্রতীয়মান হয়ে থাকে এক শিল্পহোতার দূরদৃষ্টিও। ‘তোমাকে নাচতে হবে, গাইতে হবে, অভিনয় করতে হবে’ এই কথায় দেখি এক প্রতীক্ষমান উদয়শঙ্করকে, যিনি অমলার প্রতিভাকে দেখতে চান জগৎসভার বৃহত্তর আসনটিতে। নাচ ছেড়ে দেওয়ার প্রসঙ্গে শান্ত উদয়শঙ্কর তাই স্ত্রী-কে লিখলেন,  ‘আর আমাকে ওভাবে কখনও লিখবে না, বা নাচ ছেড়ে দেবার কথাও বলবে না। বরং তুমি যে নাচে এবং সবকিছুতেই কত ভালো সেটাই প্রমাণ করতে হবে। এ নিয়ে আর চিন্তা কোরো না লক্ষ্মীটি…’। পৃথিবীর মানুষ যাই বলুক, উদয়ের কাছে অমলার মূল্যটিকে স্মরণ করিয়ে, ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পৃথিবীর দিকে পিঠ করে, উদয় দাঁড়ালেন তাঁদের দুজনের ভালোবাসার-ভুবনটিতে, শেষ করলেন চিঠি, ‘উফ্‌, তোমাকে ছাড়া থাকতে যে আমার কী কষ্ট হয়!’

অ্যালিস বোনার, উদয়শঙ্কর, বিয়াত্রিচে, উজরা ও জোহরা

 

১ অগাস্ট ১৯৪৪-এ উদয়কে আবার চিঠি লিখলেন অমলা। সেই চিঠিতে দেখা মিলল চিরদিনের শান্ত, হাসিখুশি অমলার। স্নিগ্ধ প্রেমময় সে চিঠি। লিখলেন, ‘আপনাকে ছাড়া এতদিন থাকতে হবে ভেবেই আমার যে কী খারাপ লাগছে তা আপনি জানেন না। একেবারে অসহ্য! তাড়াতাড়ি ফিরে আসুন।’ প্রাত্যহিক সমস্যার খোঁজ নিয়ে লিখলেন, ‘তবে একথা জেনে ভালো লাগল যে আপনাদের ট্রাস্টি মিটিং হচ্ছে, এবং বশির সামনেই আপনি জেরিকে সব কথা খুলে বলবেন। ছবির [কল্পনা] ব্যবস্থা কেমন চলছে?’ অমলা এবার প্রকাশ করলেন নিজের বিরহকে, ‘আমি জানি না কী করে সময় কাটাব… আপনার সঙ্গে থাকার যে কী পরম আনন্দ— শুধু যে বাড়িতে কাছে কোথাও আছেন সেই অনুভূতিটাই যথেষ্ট।’

চিঠির শেষে কী অপরূপ, উদার, ইন্দ্রিয়ঋদ্ধ এক অনুভূতিকে ব্যক্ত করলেন অমলা। যে অসন্তোষ, যে অসহিষ্ণুতা বিপন্ন করেছিল তাঁর জীবন, তাকেও বুঝতে চাইলেন প্রগাঢ় প্রেমের কষ্ঠিপাথরেই। স্ত্রী হয়ে যে কথা লেখা ভারি সহজ কথা নয়, অমলা লিখলেন তাও। লিখলেন,  ‘বিয়্যাট্রিস, সিম আর জোহরার অবস্থা আমি (এখন) বেশ বুঝতে পারি। ওই পরিস্থিতিতে পড়লে আমি যে কী করতাম জানি না— সত্যিই খুব কষ্টকর! আপনার থেকে আলাদা থাকা যে এক ধরনের শাস্তি। তাড়াতাড়ি ফিরে আসুন।’ উদয়শঙ্করের প্রতি নিজের দুর্নিবার আকর্ষণটির সাপেক্ষেই তিনি অনুভব করতে চাইলেন এই সংকটকে। তীব্র এই প্রতিকূলতাকে দেখতে চাইলেন এক ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে। এ চিঠি ব্যক্ত করল কী অনুপম এক প্রেমকাহিনি, আর অব্যক্ত রাখল আরো দুর্লভ, নিঃশব্দ সব অনুভূতিগাথা।

Powered by Froala Editor