মিছরি জ্যয়সি আওয়াজ থি উনকি

শঙ্কর সরণি - ৪২
আগের পর্বে

সুর শিখতে ত্রুটি হলে ভীষণ রেগে যেতেন আলাউদ্দিন। তাঁর তাণ্ডবের হাত থেকে রেহাই পেতেন না পুত্র আলি আকবরও। একমাত্র রবিশঙ্কর ছাড়া পেতেন। বরং তাঁর উপর রাগ হলে আলাউদ্দিনের মেজাজ গিয়ে পড়ত বাকিদের উপর। একদিন সত্যিই রবিশঙ্করের উপর রেগে গেলেন আলাউদ্দিন। রবিশঙ্করও অভিমানে মাইহার ছেড়ে যেতে চাইলেন। তাঁকে বাধা দিলেন আলি আকবর নিজেই। অন্যদিকে পরিবারের সবার জন্য আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন উদয়শঙ্কর। কিন্তু রবিশঙ্করের সহজ জীবন। তিনি দাদাকে মাসোহারা কমানোর অনুরোধ করলেন। রবিশঙ্করের প্রথম স্ত্রী অন্নপূর্ণা ছিলেন আলাউদ্দিন খাঁ-এর কন্যা। তাঁর তৃতীয় কন্যা জাহানারা বিয়ের পর গানবাজনার সুযোগ পাননি। সেই শোকে তিনি প্রাণত্যাগ করেছিলেন। তাই রোশনারা ওরফে অন্নপূর্ণাকে সঙ্গীতের থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলেন আলাউদ্দিন। তবু স্বরসম্রাটের রক্ত যে বইছে তাঁর শরীরেও। তাই সুরই হয়ে উঠল অন্নপূর্ণার কবচ।

আলি আকবর আর অন্নপূর্ণাকে বাবা আলাউদ্দিন প্রথমে শেখাতেন গান, ধ্রুপদ। তারপর অন্নপূর্ণা যখন সেতার শিখছেন তাঁর কাছে, একদিন বললেন আলাউদ্দিন, ‘তোকে আমি আমার গুরুর বিদ্যা দেবো, কারণ তোর লোভ নেই।... ও বিদ্যা শিখতে অসীম ধৈর্য আর শান্ত মন লাগে। তবে তোকে সেতার ছাড়তে হবে। সমঝদার থেকে সাধারণ মানুষ সকলেই সেতার ভালোবাসে কিন্তু সুরবাহার শুনবে শুধু বিদ্বান শ্রোতারাই— যাঁরা সংগীতের গভীরতা জানেন, তাকে বোঝেন অন্তরঙ্গভাবে। সাধারণ লোক কিন্তু টোমেটো ছুঁড়তে পারে’। এতদূর বলে বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ‘তা তুই কী চাস?’ আলাউদ্দিনের সন্তানরা বাবাকে ডাকতেন ‘আপনি’ সম্বোধনে। অন্নপূর্ণা উত্তর দিলেন, ‘যেমন আপনার আদেশ’। রাজসিক প্রতিভার অধিকারী ছিলেন অন্নপূর্ণা। অথচ চিরদিন মিতবাক। নৈঃশব্দ্যই তাঁর একমাত্র ভাষা। অন্তরালবর্তিনী শব্দটা বুঝি তাঁর সমনাম।

গুরুর গূঢ় বিদ্যা ওস্তাদ আলাউদ্দিন দিলেন তাঁর কন্যাকে। বাবা ছিলেন ধার্মিক, উদার। ধর্ম নিয়ে কোনো ধরনের সংকীর্ণতাকে, কোনোদিন প্রশ্রয় দেননি এতটুকু। রাজা তাঁর পৃষ্ঠপোষক, কিন্তু তাঁর জীবন ছিল সহজ, অনাড়ম্বর। ভারতীয় সংগীত ঐতিহ্যে তাবৎ শিষ্যদের জন্ম দিয়েছেন তিনি, শুধু শ্রদ্ধার বিনিময়ে। এক কানা-কড়ির হিসেবকে প্রবেশাধিকার দেননি তাঁর মর্জির সরহদ্দে। চাইতেন শিক্ষা গ্রহণের পর ন্যূনতম প্রয়োজনটুকু মিটিয়ে, আর সমস্ত অর্থের অভীপ্সা থেকে দূরে থাকুক তাঁর শিষ্যরা। সুর হোক তাঁদের অমলিন সাধনা। বাবা যেমন ছিলেন দৃঢ়চেতা, যেমন ছিলেন রাগী, তেমনই গভীর ছিল তাঁর রসবোধ। সেরকম মনোহারি একটা গল্প ফেরে সকলের মুখে মুখে। একদিন গায়ে গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে বাগান করছেন বাবা আলাউদ্দিন। মাইহারে ছিল চুনের আড়ত, তার ওপর লাইম কারখানা আর জলকষ্ট। ফুল ফুটবে তার সাধ্য কী? অথচ সুশোভিত বাহারি বাগান করে ছাড়লেন আলাউদ্দিন। একাই করতেন সব। ঘেমে নেয়ে একসা হতেন। এমনই একদিন, একজন গন্যিমান্যি এসে তাঁকে ঠাউরালেন মালি। নির্দেশ দিলেন, ওস্তাদ আলাউদ্দিনকে খবর দিতে তিনি এসেছেন। ঘাড় নেড়ে নির্দেশ পালনে ভেতরে চলে গেলেন আলাউদ্দিন। কয়েক মুহূর্ত পর ফিরে এসে দিলেন নিজের পরিচয়। মালির প্রতি তাঁর নির্দেশ আর আলাউদ্দিনের প্রতি তাঁর অনুরোধ দুটিকেই পালন করলেন, এর বেশি তো কিছু নয়! আগন্তুক তখন লজ্জায় লাল। 

রবিশঙ্কর আর অন্নপূর্ণাশঙ্কর

 

অন্নপূর্ণা সম্পর্কে তাঁর দাদা আলি আকবর জানিয়েছিলেন, ‘ও যে ঢঙে বাজায়, সেটাই বাবার শেখানো আসল ঢঙ। পাবলিকের জন্য অনেক সময় আমাদের বাজনার ঢঙ পালটাতে হয়, তবে তাতে রাগ-রাগিনী বদলায় না, কিন্তু অলঙ্কারগুলি পাল্টে যায়… আর সেই কারণে ও পাবলিকে বাজাতে চায় না।’ অন্নপূর্ণা সাধারণ জনমানুষের সামনে বাজিয়েছেন। স্বামীর সঙ্গে অথবা দাদা বা বাবার অনুরোধে। কিন্তু যৎসামান্য সেসব। তাঁর হাতেও তৈরি হয়েছে নিখিল ব্যানার্জি, হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া, নিত্যানন্দ হলদিপুর, বিনয় ভরত রাম প্রমুখ সব খ্যাতনামা শিল্পী। তাঁকে নিয়ে তাঁর শিষ্যদের আবেগ, শ্রদ্ধা ছিল চেয়ে দেখবার মতো। প্রত্যেকেই সুরের প্রতি তাঁর তিল-আনার আপোসহীনতার খবর দিয়েছেন। বলেছেন অনন্য কণ্ঠমাধুর্যের কথা। বিনয় ভরত রাম বলেছিলেন, মিছরি জ্যয়সি আওয়াজ থি উনকি। শিষ্যরা তাঁকে মা ডাকতেন। বাবার মতো রাগ তাঁরও ছিল, কিন্তু স্বভাব ছিল মায়ের মতোই। যত্ন করতেন, শিষ্যদের সুখ-দুঃখের খোঁজ রাখতেন গভীর বাৎসল্যে। বাবার মতো অন্নপূর্ণাও বিশ্বাস করতেন না গুরুদক্ষিণায়। সর্বার্থে নিষ্কাম ছিল তাঁর সাধনা। শেখানোতেও আপত্তি ছিল অটল। কিন্তু কয়েকজনের নাছোড় লগন দ্রবীভূত করেছিল তাঁর পণ। হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া যখন শিখছেন। ততদিনে ফিল্মের কাজেও যুক্ত হয়ে গিয়েছেন তিনি। নানা জীবনসংগ্রামে সময় বয়ে যেত তাঁর। সময় হত রাত একটা-দুটো। অন্নপূর্ণা তাঁকে বলেছিলেন, বেশ তখনই এসো, আমি অপেক্ষা করব। কর্মক্লান্ত হরিপ্রসাদ গিয়ে দেখতেন, তাঁর জন্য মিঠাই আগলে বসে আছেন মা। তারপর শুরু নিখাদ রিয়াজ। নিত্যানন্দ হলদিপুর, শেষ সময় পর্যন্ত, যিনি তাঁর কাছে ছিলেন সাক্ষাৎ পুত্রের মতো, তিনিও খোঁজ দিয়েছিলেন অন্নপূর্ণার এক অদ্ভুত জীবনবোধের। বলেছিলেন, অন্নপূর্ণা নিজের জীবনে সমস্ত প্রয়োজন থেকে দূরে রেখেছিলেন নিজেকে। কিন্তু সাধনার জন্য শিষ্যদের তেমন পরামর্শে বাধ্য করেননি কখনও। বরং চাকরি ছাড়তে নিষেধ করতেন। বলতেন কাজকর্ম করেই সাধনা করতে, তার জন্য সাধ্যমতো তিনি থাকবেন পাশে। রূপকথার চেয়েও বিস্ময়কর এসব গল্পকথা।

আরও পড়ুন
অন্নপূর্ণা: শঙ্করদের গল্পে চির উপেক্ষিত

তবু শ্রোতার মুগ্ধতা অগ্রাধিকার পায়নি তাঁর যাপনে। নিজেকে আর নিজের অতুল প্রতিভাকে আড়াল করে রাখাই ছিল তাঁর আজীবনের প্রয়াস। দীর্ঘ বিচ্ছেদ তখন তাঁদের, সম্পর্কের স্মৃতি ভিন্ন কিচ্ছুটি নেই কিন্তু অন্নপূর্ণা সম্পর্কে রবিশঙ্করও বললেন, সেই এক কথা। বাইরে ‘বাজায় না বলে ওর যেটা তালিম, যেটা শিখেছে, জীবনে সেটা বজায় রাখতে পারে। ঠিক তালিম বাজায়।... খুব সুরে, খুব মিষ্টি হাত… রসে-ভরা হাত। এবং বাবার যে অঙ্গটা ও বাজায় সেটা নিখুঁত বাজায়; কারণ লোকজনের সামনে বাজালে মানুষকে যে কম্প্রোমাইজ করতে হয় সেটা তো ওকে করতে হয়নি।... ওর সুরবাহারকে যে পিওর বা বিশুদ্ধ সুরবাহার বলা হয়, সেটা সত্যি। অম্তত আমি তো তাই বলব।’

আরও পড়ুন
ভারত-শিল্পের ইতিহাসে দৃষ্টান্ত হয়ে রইল আলমোড়া

রবিশঙ্কর, অন্নপূর্ণা ও মায়ের কোলে শুভেন্দ্রশঙ্কর

 

আরও পড়ুন
দেহ পট সনে নট সকলি হারায়

নিজের বাবা তথা গুরু সম্পর্কে এক অসামান্য পর্যবেক্ষণের কথা জানিয়েছিলেন অন্নপূর্ণাও। বাবা শুধু নির্বিশেষ শিক্ষাই দিতেন না, নজর দিতেন শিষ্যের প্রকৃতিকেও। এব্যাপারেও তিনি অনুসরণ করতেন বাবাকেই। বলেছিলেন, বাবা ‘শিষ্যদের শেখাতেন কীভাবে নিজের শৈলীটাকে তৈরি করতে হয় আর তারপর বাজনার মধ্যে আনতে হয় অনুভূতির বুনোট। তাইতেই একই স্বরবিন্যাস দাদার হাতে আর পণ্ডিত রবিশঙ্করের হাতে দুরকম শোনায়।’

আরও পড়ুন
রঙ আর রাঙতার সাজ খসে বেরিয়ে এল এক ছাঁচ-ভাঙা মূর্তি

মাইহারে থাকতে-থাকতেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠল কথাটা। রবিশঙ্কর আর অন্নপূর্ণার বিবাহ সম্বন্ধের কথাটা।  রবিশঙ্কর তখন হৃদয়সম্বন্ধে জুড়ে আছেন জোহরার বোন উজরার সঙ্গে। উজরা তাঁর থেকে বছর দুয়েকের বড়ো। দীর্ঘ উপবাস থেকে তিনি পৌঁছেছেন তাঁর কাছে। গাঢ় একটা ভালোলাগাকে তিনি অনুভব করতেন তাঁর সম্পর্কে। সে সময়ের অস্বস্তি, অপরাধবোধ, যন্ত্রণা নিয়ে অকপট ছিলেন রবিশঙ্কর। উল্টোদিকে অন্নপূর্ণা সম্পর্কে নিজের মনকে আগাগাড়া শাসনে রেখেছিলেন তিনি। গুরুগৃহ, গুরুকন্যা সে সম্ভ্রম থেকে কখনও বিস্মৃত হতে দেননি তাঁর বোধকে। লাজুক অন্নপূর্ণাকে তিনি প্রথম দেখেন, তখন অন্নপূর্ণা তেরো। বলেছিলেন, দুটো অপূর্ব চোখ নিয়ে খুব উজ্জ্বল আর আকর্ষণীয় ছিল তাঁর উপস্থিতি। তবু অন্নপূর্ণার সঙ্গে বিবাহ প্রসঙ্গটা তাঁর জীবনে এসে দাঁড়াল এক অন্য ভাবাবেগে।

দেবেন্দ্রশঙ্কর, তাঁর স্ত্রী কৃষ্ণা আর তাঁদের শিশুপুত্র অরুণশঙ্কর কখনও-কখনও যেতেন মাইহারে রবিশঙ্করের কাছে। রবিশঙ্কর তখন বাবারই বাড়ির পাশে থাকতেন, একটা বাড়ি ভাড়া করে। কিছুটা সময় কৃষ্ণা কাটাতেন বাবার বাড়িতেও। কৃষ্ণাশঙ্কর ভারি আমুদে। হাসিখুশি মানুষ। অবিবাহিত ঠাকুরপোকে নিয়ে সাধারণ বাঙালি বউদিদের যেমন ঠাট্টা কৌতুকের ধরন, তেমনভাবেই শুরু হয়েছিল কথাখানা। তাতে যোগ দিলেন মাতুল ব্রজবিহারী, শঙ্করদের সংসারের মধ্যমণি। তারপর আলমোড়া পর্যন্ত তা ছড়িয়ে গিয়ে পৌঁছল বাবার কানেও। এই বিয়ের গুরুত্ব নিয়ে তখনও ভাবেননি রবিশঙ্কর, কিন্তু বাবার প্রতি তাঁর অনুরাগ এসে দাঁড়াল এ সম্ভাবনায়। শ্যামশঙ্করকে না পাওয়ার তীব্র বেদনা প্রশমিত করেছিল বাবা আলাউদ্দিনের ভালোবাসা, বাৎসল্য। প্রগাঢ় এক কৃতজ্ঞতা এবং একটা সাংগীতিক মাহল সব মিলিয়ে সেটাই নিল মুখ্য ভূমিকা।

আনন্দশঙ্কর, শুভেন্দ্রশঙ্কর, অমলাশঙ্কর আর রবিশঙ্কর

 

তা বলে অন্নপূর্ণাকে  তিনি ভালোবাসেননি, তেমনটা নয়। দুজনে তো প্রায় বড়োই হলেন একসঙ্গে। বাবার কাছে তালিম পেলেন একত্র। মনে-প্রাণে অন্নপূর্ণার গড়ে ওঠবার নিখাদ মুহূর্তগুলো সুনিশ্চিত আকৃষ্ট করেছিল তাঁকে। সম্পর্কের তার ছিঁড়ে যাওয়ার কত পরেও মধুর সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করে বলেছিলেন রবিশঙ্কর, ‘…ওকে আমার শুরুর থেকেই খুব ভালো লাগত। একসঙ্গে থাকতে থাকতে যে ভালোলাগাটা দানা বাঁধে। এ ছাড়া ওর গুণও প্রচুর ছিল। আর ক্রমে ক্রমে সত্যিই ওকে খুব ভালোবেসেছিলাম’।

জাহানারার  বিবাহ হয়েছিল  তাঁদের নিজেদের ঘরে। মুসলিম পরিবারে, কিন্তু তাঁর অ-সুখ স্তব্ধ করে দিয়েছিল সকলকে। বাবা বললেন, বিয়ে হবে হিন্দু মতেই। বিয়ের দিন সকালে বাবার ইচ্ছাতেই অন্নপূর্ণা গ্রহণ করলেন হিন্দুধর্ম। তারপর হল বিয়ের অনুষ্ঠান। অন্নপূর্ণা তখন পনেরো। রবিশঙ্কর একুশ। রবিশঙ্করের মাইহার যাবার তিনবছর পর ১৫ মে, ১৯৪১-এ আলমোড়াতেই হল তাঁদের বিয়ে। চির নিশ্চুপ অন্নপূর্ণাকে বিবাহসূত্রে লাভ করলেন রবিশঙ্কর। বিয়ের পর যে-রাত্রে প্রথম একলা হতে পারলেন দুজনে, সে রাত্রে নববধূর কাছে রবি পেলেন এক অভাবিত সংবাদ। চমকে গিয়েছিলেন তিনি, ঘুণাক্ষরে টের পাননি কিছু। তিনি জানতেন এ বিবাহে গুরুজনদের সিদ্ধান্তকেই স্বীকার করেছেন অন্নপূর্ণা, এইমাত্র। কিন্তু আজ জানলেন, সেই কবে থেকেই অন্নপূর্ণা ভালোবেসেছে তাঁকে। নিজেকে, নিজের সমস্ত অনুভূতিকে আদ্যন্ত অন্তরালে রাখাই অন্নপূর্ণার আজন্মের বিশ্বাস। তবু সদ্য বিবাহ অতিক্রান্ত মধুর নির্জনতায় অন্তত একবারের জন্য তিনি প্রকাশ করেছিলেন নিজেকে।    

বিয়ের দুমাসের মাথায় অন্তঃসত্ত্বা হলেন অন্নপূর্ণা। ৩০ মার্চ ১৯৪২ জন্ম নিলেন রবিশঙ্কর আর অন্নপূর্ণার একমাত্র সন্তান শুভেন্দ্রশঙ্কর।

রুশিকুমার পাণ্ডে

 

তারপর একদিন ভেঙে গেল নীড়। সত্তরের দশকে শেষদিকে ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছিল রবিশঙ্করের কথা।  এপ্রিল ১৯৮০-তে সেইসব কথা জড়ো করে প্রকাশ পেল অসমান্য সেই বই ‘রাগ-অনুরাগ’। এসব সময় থেকে কত দূরে তখন দাঁড়িয়ে তিনি। তাও বললেন রবিশঙ্কর, ‘… আমি যতখানি ভালোবাসতে পেরেছিলাম অন্নপূর্ণাকে, তার চেয়ে অনেক বেশি ভালোবাসা ও আমাকে দিয়েছে।’ নিজের শতসহস্র ত্রুটি-বিচ্যুতি-সীমাবদ্ধতাকে উজাড় স্বীকার করে জানিয়েছিলেন, ‘ দোষ তো আমার আছেই। কিন্তু দুনিয়ার যাবতীয় দোষ কি কেবল একটা মানু্ষের ওপর বর্তায়?... নির্ভেজাল সাংসারিক সুখ তো আমিও চেয়েছিলাম। হাজার যশ, খ্যাতি, অর্থ দিয়েও সে সুখ আমি কিনতে পারিনি। মানুষ দেখে বাইরের রবিশঙ্করকে, দুঃখী রবিশঙ্করকে কে চেনে?’

শেষেরও বোধকরি শেষকথা থাকে, সেইটুকুও বলে নিই। ১৯৮২ সালে আইনত ডিভোর্স হল অন্নপূর্ণা আর রবিশঙ্করের। ওই বছরই অন্নপূর্ণা বিবাহ করলেন রুশিকুমার পাণ্ডেকে। শুভেন্দ্রশঙ্করের বন্ধু হাসিখুশি, আন্তরিক রুশি কাজ করেছেন রবিশঙ্করের সঙ্গেও। পেশা অন্য হলেও তালিম নিয়েছিলেন আলি আকবর আর অন্নপূর্ণার কাছেও। অন্নপূর্ণার থেকে তেরো বছরের ছোটো রুশি, কিন্তু এই বিবাহ তাঁর জীবনে নিয়ে এল গভীর শান্তি আর ভরপুর আনন্দ। সবচেয়ে বড় কথা অন্নপূর্ণা ফিরলেন তাঁর গুরুদায়িত্বে, স্বল্প হলেও দিতে শুরু করলেন তালিম। খবর পৌঁছল রবিশঙ্করের কাছে। তাঁর শেষলেখা জীবনীতে লিখলেন তিনি, ‘ After all our years of problems, I am happy for Annapurna now, and thank Rushi for bringing peace and happiness in her life.’। ১৮৮৯, ২৩ জানুয়ারি রবিশঙ্কর বিয়ে করলেন সুকন্যা রাজনকে। সুখী হলেন তিনিও। ১৯৯২, ১৫ সেপ্টেম্বর মারা গেলেন শুভেন্দ্রশঙ্কর। ছিঁড়ে গেল সম্বন্ধের যত তার।

এই কূলে এসে ভিড়ল সময়। কিন্তু আমরা তো পেছন ফিরে এক চলমান ছবিকে দেখতে চাইছি। নাই হোক সব অক্ষয়, অনড়। তবু যে এক-একটা ক্ষণ, এক-একটা লগ্ন, এক-একটা সম্বন্ধ জ্বলে উঠেছিল মণি-মাণিক্যের মতো, তাই-ই বা কম কী? সেতার হাতে রবিশঙ্কর, সরোদ নিয়ে আলি আকবর আর সুরবাহারে অন্নপূর্ণাকে স্মিতমুখে তালিম দিচ্ছেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন। ঐশ্বরিক সুর ভাসছে মাইহারের হাওয়ায়। মাইহার বিশ্বাস করত, সাঁঝবেলায় সরস্বতী স্বয়ং লুকিয়ে দাঁড়াতেন, এ বাড়ির খিলানের আড়ালে। কিছুক্ষণ না হয় আমরাও মাইহারেই থাকি।   

Powered by Froala Editor