ভারত-শিল্পের ইতিহাসে দৃষ্টান্ত হয়ে রইল আলমোড়া

শঙ্কর সরণি - ৪০
আগের পর্বে

১৯৩৬ সালে বাবা আলাউদ্দিনকে নিয়ে উদয়শঙ্কর উঠেছিলেন ইংল্যান্ডের ডার্টিংটন হলে। সেখানেই এক নতুন জীবন শুরু হয় তাঁর। ডার্টিংটন হল ছিল রবীন্দ্রনাথের মুক্ত চিন্তায় বিশ্বাসী শিল্পশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এখানে দাঁড়িয়েই উদয়ের মনে হল, তাঁর শিল্পের কোনো উত্তরসূরী নেই। সেই থেকেই শুরু হল আলমোড়ার প্রতিষ্ঠান তৈরির ভাবনা। যদিও প্রথমে কাশীতেই প্রতিষ্ঠান তৈরির কথা ভেবেছিলেন। পরে পাহাড়ি শহর আলমোড়াই পছন্দ হল তাঁর। এলমহার্স্টের কন্যা বিয়াত্রিচে এগিয়ে এলেন সাহায্য করতে। ধনী পরিবারের মেয়ে বিয়াত্রিচে ভালোবেসে ফেললেন উদয়কে। উদয়শঙ্করও ভালোবেসেছিলেন। কিন্তু বিবাহের জন্য তিনি প্রস্তুত হতে পারেননি। তার উপর দুজনের দেশ আলাদা, সংস্কৃতি আলাদা। বিয়াত্রিচে উদয়শঙ্করের জন্য অপেক্ষা করতে প্রস্তুত ছিলেন। এর মধ্যেই এসে পড়ল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। অমলাকেই বিবাহ করলেন উদয়। কিন্তু বিয়াত্রিচের সঙ্গে যোগাযোগ তাতে নষ্ট হয়নি। তিনিও আলমোড়ার প্রতিষ্ঠানের জন্য তাঁর যাবতীয় দায়িত্ব পালন করে গিয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন আর এলমহার্স্টের ডার্টিংটন হল-এর ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে উদয়শঙ্কর গড়ে তুললেন আলমোড়ার সেন্টার। ১৯৩৯-এ আলমোড়ার রানিধারায় প্রতিষ্ঠিত হল ‘উদয়শঙ্কর ইন্ডিয়া কালচারাল সেন্টার’। যদিও ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হতে শুরু করল ১৯৪০ থেকে। সহায়তায় এগিয়ে এসেছিল প্রাদেশিক সরকারও। এই প্রকল্পে সরকার দান করল অনেকখানি জমি। এই উদ্যোগে রবীন্দ্রনাথকে পুরোভাগে দেখতে চাইলেন উদয়শঙ্কর। সেই অনুনয়ে তাঁকে লিখলেন চিঠি। সম্মতি জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ পাঠালেন আন্তরিক শুভেচ্ছাবার্তা। এই পরিকল্পনাকে নিখুঁত করে তোলার ব্যাপারে এতটুকু অবহেলাকে প্রশ্রয় দিলেন না উদয়শঙ্কর। দলের মানুষজন, শঙ্কর-ভাইরা, যাঁরা নতুন যুক্ত হলেন এবং যাঁরা কর্মকাণ্ডের ভিতপ্রস্তর নির্মাণের হোতা সকলের মধ্যেই দেখা দিল প্রবল উৎসাহ আর উত্তেজনা। এই অভিনব প্রয়াস এবং বিভিন্ন প্রান্তের গুণিজনের সমাহার সকলের মধ্যে জাগিয়ে তুলল নতুনতর উদ্দীপনাকে। শিল্পচর্চা আর সুন্দর সামঞ্জস্যময় জীবনচর্যা, এই ছিল প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য। উদয়শঙ্করের আমন্ত্রণে এই কলাকেন্দ্রে এসে ধীরে ধীরে যোগ দিলেন দেশের বিভিন্নপ্রান্তের তাবৎ গুণিজন। এলেন গুরু শঙ্করণ নাম্বুদ্রি, বাবা আলাউদ্দিন খান সাহেব, বালা সরস্বতীর গুরু ভরতনাট্যম শিল্পী কণ্ডাপ্পা পিল্লাই, মণিপুরি নৃত্যশিল্পী গুরু অমোবি সিং। সৃজনশীলতার তুঙ্গমুহূর্তে তখন উদয়শঙ্কর। এক অন্য মাত্রা নিল আলমোড়ার পরিবেশ। শুধুমাত্র কলাকেন্দ্রের শিল্পচর্চা ও নিরীক্ষার কারণেই নয়, নানা ওস্তাদ, তাঁদের নানা ধর্মবিশ্বাস, নানা প্রকৃতি তবু সহজ মেলামেশায়, তাঁদের আন্তরিক জীবন যাপনের উজ্জ্বল সব মুহূর্ত হয়ে উঠল আরো উঁচুদরের শিক্ষা।

স্বর্গীয় আলমোড়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। পাহাড় ঘেরা চারপাশ, পথে-পথে ঝরনা। সৌন্দর্যের চমক-লাগা পাকদণ্ডী। যে প্রান্তেই তাকাও, প্রকৃতি বিস্তৃততর হয়েছে বিপুল মহিমায়। সেন্টারের পাশেও বইত একটা ঝরনা। গ্রামের মেয়ে-বউরা এসে জড়ো হত সেখানে জল নিতে। জল নিয়ে কাজ মিটিয়ে তড়িঘড়ি সইত না তাদের। একটু জিরোতো। চাতালের কাছটিতে বসে গুনগুন করে গাইত গান। বসে থাকা দায় হত কারো-কারো, তারা উঠত নেচে। গান-নাচ তাদের বাইরের জিনিস নয়, ও তাদের জীবনধারারই অঙ্গ। সুর-তালের রঙ্গি-বিরঙ্গিতে ওস্তাদ আলাউদ্দিন চিরশিশু। যেই-না তাঁর কানে গিয়েছে সুর, দেখলেন পথের ধারে মেয়েরা গাইছে, নাচছে অমনি তিনি ছুটলেন ভেতরপানে, তাঁর ঢোলের খোঁজে। ঢোল নিয়ে ঝরনার কাছে এসে বাজাতে শুরু করলেন সেই দেশওয়ালি মেয়েদের সুরে তাল মিলিয়ে। মেয়েরা একেবারে তাজ্জব বনে গেল। বাপরে, বোল ধরে কোন ভিনদেশের মানুষ গো? তাদের শরম লাগে, হাসতে-হাসতে পালিয়ে যায় সব। আলাউদ্দিনের ভেতরের শিশুটি হয়ে পড়ে ভগ্নমনোরথ। নালিশ করেন উদয়শঙ্করকে, বাবা অরা আমারে দ্যাখ্যে লজ্জা পায়, নাসে না।

রবীন্দ্রনাথের শুভেচ্ছাবার্তা।

 

ধর্ম-সংস্কার, আচার-বিচার তুচ্ছ সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে আলমোড়া দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছিল এক ধর্ম-নিরপেক্ষ ভারতবর্ষের। কী নয়নাভিরাম সেই দৃশ্য, যেখানে আরাধনা, উপচার, মন্ত্র-তন্ত্র শুধু আবিষ্ট করে আছে সুর-তাল আর লয়কে। যেমন অপার্থিব সে সাধনা, তেমনই পবিত্র তার যাচ্ঞা। নাম্বুদ্রি এসেছিলেন যে পরিবেশ থেকে, কঠিন ব্রাহ্মণ্যের প্রাচীর তোলা ছিল তার অবস্থান। শূদ্রের সংস্পর্শে এলে, এমনকি তাদের ছায়া মাড়ালেও শুচিস্নানে পুনরায় পবিত্র করতে হত নিজেকে। আলমোড়ায় সরস্বতী পুজো হল, ছেলেমেয়েদের মনে সত্যিকারের উৎসবের ঢেউ তুলে দিল সে আয়োজন। অমলা আর জোহরা সকলের সঙ্গে মিলে করলে পুজোর আয়োজন। নাম্বুদ্রি পাঠ করলেন পুজোর মন্ত্র, সেই নাদধ্বনির সঙ্গে আলাউদ্দিন বাজালেন সরোদ। কোন ঐহিক শান্তির বারি বরিষন, চিত্তমুক্তির সাধনায়, চিত্তজাগরণের উপাসনায়।

আরও পড়ুন
দেহ পট সনে নট সকলি হারায়

এইসব ওস্তাদদের অহং-এর ভাবলেশহীন, বিনয়ী জীবনচর্যা ছিল আরো এক শিক্ষণীয় বিষয়। মাটিতে ফরাস বিছিয়ে রাখা, সেখানেই বসতেন সবাই। কিন্তু উদয়শঙ্কর সেখানে থাকলে গুরু অমোবি সিং বসতেন মাটিতে। এমন বাতাবরণ ছিল শ্রদ্ধার। তাঁকে প্রণাম করতে গেলে নিরস্ত করতেন, বলতেন, আমি এখানে শিখতে এসেছি। কেমন করে শেখাতে হয়, সেটাই তো শিখব। জ্ঞানলাভ আর বিদ্যাদানের মধ্যে যে মেরুসমান দুস্তর ব্যবধান, এমন সব সহজ কথায় ভাবনার প্রলয় ঘটিয়ে দিতেন তাঁরা। বাবা আলাউদ্দিনের ‘আমার কথা’য় আছে এমন একখানা গল্প। তানসেন ঘরানার ওস্তাদ আলাউদ্দিন, বলতেন, মধ্যরাত্রে রাজা বিক্রমাদিত্য দীপক রাগিনী ধরলে জ্বলে উঠত প্রদীপ। ওস্তাদদের রাগ-রাগিনীতে ধরাধামে এসে নামত ঋতু। হাজির হত শীত-বসন্ত-বর্ষা। আমাদের সংগীতে ছিল তেমন শক্তি। দুঃখ করে বলতেন, তাঁর বাজনায় আলোও জ্বলে না, বসন্তও আসে না। এমন অসম্পূর্ণ  বিদ্যাতেই সকলে আদর করেছে তাঁকে। নিসর্গ প্রকৃতির ডালপালা কেমন করে উতলা হত তাঁর বাজনায় কে জানে, কিন্তু তাঁর বাজনা যে সত্যি সত্যি অন্তর্প্রকৃতিতে জ্বেলে দিত প্রদীপ, সে কথা তাঁকে কে বোঝাবে?

আরও পড়ুন
রঙ আর রাঙতার সাজ খসে বেরিয়ে এল এক ছাঁচ-ভাঙা মূর্তি

উদয়শঙ্কর, গুরু নাম্বুদ্রি, বাবা আলাউদ্দিন এবং কণ্ডাপ্পা পিল্লাই।

 

আরও পড়ুন
শঙ্করদের জীবনে এসে দাঁড়াল প্রবল শোক

গুরু শঙ্করণ নাম্বুদ্রি যে-বাড়িটাতে থাকতেন, সবাই তাকে ডাকত ‘টেম্পল’। কেরল থেকে আসার সময় উনি এনেছিলেন ছ-ফুট সমান এক পিতলের পিলসুজ আর প্রদীপ। তার আলো যাতে কখনও না নেভে উদয়শঙ্কর সেজন্য বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন প্রয়োজনমতো ঘি। গুরুর জন্য গঙ্গাজল আসত বেনারস থেকে। রাত তিনটের সময় স্তোত্র পড়তেন নাম্বুদ্রি, ঘি ঢালতেন অনির্বাণ প্রদীপের আলোয়। কী অপূর্ব ছিল জীবনধারা।

আরও পড়ুন
গাড়িতে উঠে চমকে গেলেন, ভেতরে বসে আছেন রবীন্দ্রনাথ

সেন্টারে সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে মিটে যেত সকালের জলখাবারের পর্ব। তারপর শুরু হত ক্লাস। সদস্য, ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে এই ক্লাসটা নিতেন উদয়শঙ্কর। প্রশিক্ষণ শুরু হত হাঁটা দিয়ে। হাঁটা-চলার মধ্যে দিয়ে গেঁথে দিতেন নাচের গোড়ার ভিতটি। চলার ভঙ্গির সামান্য অদল-বদল প্রভাবিত করে  জীবনের ছন্দকেও, অসামান্য উদাহরণে পড়াতেন সেইসব। খুব জনপ্রিয় ছিল এই ক্লাস। কী বিস্তারিত এই ক্লাসের কথা জানিয়েছিলেন অনন্য স্মৃতিধর রবিশঙ্কর। বলেছিলেন, এই ক্লাসে  অসামান্য কিছু ব্যয়ামের অনুশীলন করাতেন উদয়শঙ্কর। যেমন, ছাত্র-ছাত্রীদের তিনি বলতেন চোখ বন্ধ করে মাটিতে বসতে। তারপর স্পর্শ করতে হবে মাটিটা। মনে মনে অনুভব করতে বলতেন, যে, তুমি যেন হাত রেখেছ কোনো বরফশীতল জলে। পরমুহূর্তে বলতেন, কল্পনা করো হাত রয়েছে উষ্ণ জলে। এরপর উষ্ণ জলকে ভাবতে বলতেন উত্তপ্ত বালুকা। উষ্ণ মরুভূমির বালি থেকে আরামদায়ক সমুদ্রতীরে, আবার সেখান থেকে হিমকঠিন বরফের স্পর্শের তারতম্যকে অনুভব করতে বলতেন। কল্পনা, অনুভূতি, স্পর্শ আর স্পর্শের তরতম কী করে নির্মাণ করে মুদ্রা, সম্ভবত সেই জটিল বুননকে ধরিয়ে দিতে চাইতেন শিক্ষার্থীদের।

আলমোড়ায় উদয়শঙ্কর।

 

সামার স্কুল বা গ্রীষ্মকালীন কর্মশালায় শেখাতেন বিশেষ এক হাঁটা। একটা বড়ো স্টুডিও, তাতে একশো ছাত্রছাত্রীর ঠাসাঠাসি ভিড়। বলতেন, পিঁপড়ের সারির কথা মনে করো, সারবন্দি, ব্যস্ত সবাই হেঁটে চলেছে। অথচ কারোর সঙ্গে কারোর ধাক্কা লাগছে না এতটুকু। হাঁটো সেইভাবে, সারিবদ্ধ, সংঘাতবিহীন।

এই ক্লাসের ছাত্র হওয়ার বাধা ছিল না কোনো। উকিল-ডাক্তার-গায়ক-অভিনেতা যুক্ত হতে পারতেন যে কেউ। তেমন-তেমন এসেওছিলেন অনেকে। একবার পঞ্জাবের এক বৃদ্ধা এসেছিলেন নাতনিকে ভর্তি করতে। নানা কাজে যুক্ত হয়ে থেকে গিয়েছিলেন প্রায় দু বছর। এই থেকে-যাওয়া নিয়ে কেউ জানতে চাইলে, উদয়শঙ্করকে দেখিয়ে বলতেন, বেটা জাদু জানে। সকালে হত মুভমেন্টের ক্লাস, সন্ধেবেলায় ইমপ্রোভাইজেশনের। সন্ধেবেলায় হত বিষ্ণুদাস শিরালির গানের ক্লাস। সেই ক্লাসে গান শিখতেন সিমকিও। সকালের পরের দুটো ক্লাস হত ধ্রুপদি নৃত্যের। শেখানো হত মণিপুরি, ভরতনাট্যম আর কথাকলি। কথাকলির ক্লাস গুরু নাম্বুদ্রিই নিতেন। ছেলে-মেয়েরা একটু ছুটি পেত এই ক্লাসশেষে। ব্যাডমিন্টন, টেনিস প্রভৃতির ব্যবস্থা ছিল অবসর সময়ের জন্য। বাকি সদস্যরা তখন অনুষ্ঠানের মহড়া দিতেন। শীতের ছুটিতে দল ছুটত নানা দেশ থেকে আসা অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণে।

আলমোড়ার ক্লাস।

 

পাঁচ বছরের জন্য পরিকল্পনা করা হয়েছিল একটি ডিপ্লোমা কোর্সের। আর দুমাসের জন্য ছিল সামার কোর্স। এইটির খ্যাতি ছিল বেশি। দেশ-বিদেশ থেকে আগ্রহীরা আসতেন এই কোর্সের জন্য। সেসময় ছাত্র ছিলেন গুরু দত্ত, কামেশ্বর সেহগাল, শচীনশঙ্কর, প্রভাত গাঙ্গুলি, নরেন্দ্র শর্মা, সুন্দরী শ্রীধরনি প্রভৃতি। বিভিন্ন সময়ে সেন্টারে কোর্সের জন্য যুক্ত হয়েছিলেন, ডি সি এম পরিবারের ভরতরাম, শীলা ভরতরাম, বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতের মেজোমেয়ে নয়নতারা সেহগাল। আলমোড়ায় যাঁরা যুক্ত হলেন পরবর্তীকালে তাঁদের বহুজনই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন নানান ক্ষেত্রে। সিমকি, জোহরা আর জোহরার বোন উজরা তো ছিলেন আগে থেকেই।

এই সময় আলমোড়ায় মেট্রন হয়ে এলেন আরো এক বিশেষ মানুষ, শ্রীমতী শাস্ত্রী। ‘শঙ্করনামা’ বইতে অমলাশঙ্করের স্মৃতিচারণে এই ঘরোয়া আলমোড়ার গল্পগাছা আমাদের বড়ো সঞ্চয়। শ্রীমতী শাস্ত্রী সমাজসেবা করতেন। সম্ভবত তামিলে তিনি অনুবাদ করেছিলেন শরৎচন্দ্রের সাহিত্য। তিনি এলেন তাঁর দুই কন্যাকে নিয়ে। লক্ষ্মী ও কমলা শাস্ত্রী। লক্ষ্মী ছোটোবেলায় ভরতনাট্যম শিখেছিলেন। কিন্তু কে না জানে, কণ্ঠে কী অপার সুরমাধুর্য নিয়ে জন্মেছিলেন তিনি। এই লক্ষ্মী শাস্ত্রীকেই পরে বিবাহ করবেন রাজেন্দ্রশঙ্কর।  ধ্রুপদি সংগীতে অসামান্য পরিচিতি লাভ করেন এই শঙ্কর-বধূ। রবিশঙ্কর তাঁর নিজের নানা কাজে চিরস্থায়ী করে রেখেছেন ভ্রাতৃবধূ লক্ষ্মীশঙ্করের সুর। লক্ষ্মীশঙ্করের বোন কমলা। সুর আর লয়ের তালিম ছিল তাঁরও। অল্পবয়সে অপরূপ লাবণ্য ছিল চেহারায়। ভারতীয়-ধারায় অশ্রুতপূর্ব এক প্রেমবন্ধনে দীর্ঘদিন আবদ্ধ ছিলেন রবিশঙ্করের সঙ্গে।

শ্যাডো প্লে, বুদ্ধের জীবনী।

 

অমলাশঙ্কর জানিয়েছিলেন, সেন্টারের প্রধান অবদান ছিল পূর্ণাঙ্গ নৃত্যনাটিকা রচনায়। আগে উদয়শঙ্কর তৈরি করতেন ছোটো-ছোটো নৃত্যাংশ। আয়োজনের পরিপূর্ণতায় তাঁর নির্দেশনায় এবার নির্মিত হল সম্পূর্ণ ব্যালে। ধীরে ধীরে সৃষ্ট হয়ে উঠল আনকোরা একটি সংরূপও, আলমোড়াতেই উদয়শঙ্কর প্রথম তৈরি করলেন ছায়া-নাটিকা বা শ্যাডো প্লে। জাভা, বালি-তে এইধরনের শো হত, কিন্তু তার সম্পূর্ণ বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা ছিল না বলে বড়ো সাদা পর্দা টাঙিয়েই শুরু হল কাজ। কলাকুশলী রইলেন পর্দার পেছনে। অঙ্গভঙ্গি-অভিনয় সবই ঘটল পর্দার আড়ালে। সামনে এমনভাবে ফেলা হল আলো যাতে পর্দা জুড়ে ছড়িয়ে থাকে অতিকায় ছায়া। নাটকীয়তায় যোগ হত একেবারে স্বতন্ত্র এক মাত্রা। ‘রামলীলা’ এবং ‘বুদ্ধের জীবনী’ শিল্পবোধের গুরুত্বে শুধু যে গুণিজনকেই মুগ্ধ করেছিল তাই-ই নয়, মন্ত্রমুগ্ধ করে তুলেছিল আলমোড়ার আমজনতাকেও। অভিনয় চলাকালীন নিজেদের পার্ট না-থাকা সামান্য বিরতিতে অভিনেতারা বিশ্রাম করতেন একটা খাটানো তাঁবুতে, গ্রামবাসীরা সেইখানে এসে, ভগবান জ্ঞানে ভক্তিভরে চরিত্রদের দিকে ছুড়তেন ফুল। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি চৌ এন লাই উদয়শঙ্করের পুরো দলটিকে নিয়ে গিয়েছিলেন চিনে। এই অভিনব প্রযোজনা সম্পর্কে তাঁদের দেশকে অবহিত করতে চেয়েছিলেন তাঁরা।

কী অভূতপূর্ব সমন্বয়ে গড়ে উঠল এই প্রতিষ্ঠান। ভারত-শিল্পের ইতিহাসে দৃষ্টান্ত হয়ে রইল আলমোড়া। গুণী, ওস্তাদ, শিল্প, উদার ধর্মবোধ, মনন, মেধা, শৃঙ্খলা, ঐতিহ্যবোধের সমাহারে সেজে উঠল আলমোড়া। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাটল সময়। কিন্তু কতদিন?  ১৯৪৪-এ বন্ধ হয়ে গেল সেন্টার। এই গভীর অনুপম জীবনধারা থেকে ক্রমে-ক্রমে সরে এল ‘উদয়শঙ্কর ইন্ডিয়া কালচারাল সেন্টার’। কারুবাসনার পরিবর্তে সেন্টারে জায়গা করে নিল তর্ক-বিবাদ, কলহ-কাজিয়া, ক্ষোভ-অসন্তোষ, সন্দেহ-অবিশ্বাস, অধিকারবোধ-অহং, ঈর্ষা-দুর্ব্যবহার, পারস্পরিক দোষারোপ। এর সঙ্গে জুড়ল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাত। উন্নত জীবনচর্যার আদর্শ বয়ে গেল মানবজীবনের গতানুগতিক সেই গড্ডলিকায়।   

Powered by Froala Editor