স্মৃতি থেকে মোছেনি জীবনের একটি মুহূর্তও; বিরল ক্ষমতা, নাকি অসুস্থতা?

/১০

১৯৪২ সালে হোর্হে লুইস বোর্হেস লিখেছিলেন ‘ফিউনেস দ্য মেমোরিয়াস’। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রটি হঠাৎ এক দুর্ঘটনায় মাথায় আঘাত পায়। এরপরেই তার মনে পড়ে যেতে থাকে ছেলেবেলার সমস্ত ঘটনা। জীবনের একটি মুহূর্তও যেন ভুলে যায়নি সে। কিন্তু এ তো গল্প কথা। বাস্তবে আবার এমন হয় নাকি? সেই সময় মানুষ বিশ্বাস না করলেও বর্তমানে অনেকেই জানেন, এমনটা সম্ভব। ব্যতিক্রমী হলেও সম্ভব।

/১০

ধরা যাক জিল প্রিসের কথাই। ২০০৬ সালে এই মার্কিন মহিলার কথা প্রথম জানা যায়। সেইসময় তাঁর বয়স ৪১ বছর। অথচ সেই ১৪ বছর বয়স থেকে প্রতিটা মুহূর্তের স্মৃতি তাঁর কাছে জীবন্ত। তিনি কবে কোন সময়ে কী খাবার খেয়েছিলেন, কবে বাবা-মায়ের উপর রাগ হয়েছিল, কবে রাগ করে খেতে চাননি – এমন ছোটোখাটো সমস্ত তথ্যই।

/১০

জিলের ঘটনাটিকে ধরেই প্রথম জানা যায় নতুন একটি রোগের কথা। তাঁর তিন ডাক্তার – এলিজাবেথ পার্কার, ল্যারি কাহিলস এবং জেমস ম্যাকগঘ একসঙ্গে আবিষ্কার করেছিলেন সেই রোগ। যার নাম হাইপারথাইমেসিয়া। কিন্তু ঠিক কী কারণে এমন রোগ দেখা যায়, সেই বিষয়ে একমত হতে পারেননি তাঁরা।

/১০

পার্কার এবং কাহিলস মনে করেছিলেন, জিল আসলে অবিশ্বাস্য স্মৃতিশক্তির অধিকারী। তাঁর মস্তিষ্কের গঠনে এমন কোনো কারণ লুকিয়ে আছে। কিন্তু এই ব্যাখ্যা মানতে চাননি ম্যাকগঘ। তিনি জিলের সিটি স্ক্যান করে দেখান, তাঁর মস্তিষ্কের প্রতিটা অংশের গঠন নিতান্তই স্বাভাবিক। শুধু তাই নয়, তাঁর অন্যান্য নানা ব্যবহারের ভিত্তিতে ম্যাকগঘ দাবি করেন জিল আসলে অবসেসিভ কমপালসিভ ডিস-অর্ডার বা ওসিডি আক্রান্ত। এবং তাঁর অবসেসন আসলে নিজের স্মৃতি নিয়েই। তাই সবসময়ই নিজের স্মৃতিতে ডুবে থাকেন তিনি।

/১০

এই ব্যাখ্যাকে প্রমাণ করার জন্য আরও একটি পরীক্ষা করেন ম্যাকগঘ। তিনি কয়েকজন অপরিচিত মানুষকে নিয়ে জিলের ইন্টারভিউ নিতে বসেন। বেশ কয়েক ঘণ্টা ইন্টারভিউ চলার পর সেই দুজন ব্যক্তি চলে যান। এরপর ম্যাকগঘ প্রশ্ন করেন, তাঁরা কী রঙের পোশাক পরে এসেছিলেন। এই সামান্য প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি জিল। তবে ম্যাকগঘ তাঁর স্মৃতিকে অবসেসন বলায় রীতিমতো ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন জিল। যদিও এখনও পর্যন্ত হাইপারথাইমেসিয়া সংক্রান্ত গবেষণায় ম্যাকগঘের কাজকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন চিকিৎসকরা।

/১০

জিল প্রিসের ঘটনা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতেই বহু মানুষ দেখা করতে আসেন ম্যাকগঘের সঙ্গে। অন্তত ২০০ জন ব্যাক্তি দাবি করেন, তাঁরাও একইরকম রোগে ভোগেন। বলা বাহুল্য, বেশিরভাগেরই স্মৃতি ছিল নিতান্ত স্বাভাবিক। তবে ম্যাকগঘ এখান থেকেই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন, স্মৃতি নিয়ে মানুষের অবসেসন খুবই সাধারণ। কারোর কারোর ক্ষেত্রে তা মারাত্মক হয়ে ওঠে মাত্র।

/১০

২০১০ সালের মধ্যে আরও ৪ জন ব্যক্তির মধ্যে একই রোগের সন্ধান পাওয়া যায়। এর মধ্যে একজন মার্কিন অভিনেত্রী মারিলু হেনার। তিনি ততদিনে তাঁর আত্মজীবনী লিখতে শুরু করেছেন। আর তখনই উপলব্ধি করেন, শৈশব থেকে শুরু করে প্রতিটা মুহূর্তের ঘটনাই তাঁর স্পষ্ট মনে আছে।

/১০

২০১২ সালে এইচকে ডেরিবেরি নামের এক যুবকের হাইপারথাইমেসিয়া ধরা পড়ে। এই কেসটিকে একটু পৃথকভাবে দেখারই পক্ষপাতী চিকিৎসকরা। কারণ ডেরিবেরি একজন দৃষ্টিহীন যুবক। তাঁর স্মৃতির ধারনাও অন্যরকম। আর তাই সেই স্মৃতি নিয়ে অবসেসনের ধরনও আলাদা। ডেরিবেরির কেসটি নিয়েও গবেষণা করেছেন ম্যাকগঘ।

/১০

সেই বছরই আমেরিকার বাইরে প্রথম হাইপারথাইমেসিয়া ধরা পড়ে। অরেলিয়ান হেম্যান নামের এই যুবকটি ডুরহাম ইউনিভার্সিটির পড়ুয়া ছিলেন। ইংল্যান্ডের বছর কুড়ির যুবকটির অন্তত ১০ বছরের স্মৃতি সমস্ত মনে উজ্জ্বল। তাঁকে নিয়ে একটি ১ ঘণ্টার তথ্যচিত্রও তৈরি হয়।

১০/১০

এখনও পর্যন্ত মোট ৬০ জন হাইপারথাইমেসিয়া রোগীর সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। প্রত্যেকেরই মস্তিষ্কের গঠন মোটের উপর স্বাভাবিক। তবে সবার ক্ষেত্রেই যে জিলের মতো পারিপার্শ্বিক স্মৃতির দুর্বলতা লক্ষ করা গিয়েছে, এমনটা নয়। তাই পুরোটাকে অবসেসন বলতে এখন খানিকটা দ্বিধা বোধ করেন ম্যাকগঘ নিজেও। কিন্তু এই রোগের পিছনে প্রকৃত রহস্য যে কী, তা আজও অস্পষ্ট।

Powered by Froala Editor