লক্ষ্মীশঙ্করের গান শুনে ঘুমিয়ে পড়লেন নেহরু

শঙ্কর সরণি - ৪৪
আগের পর্বে

শঙ্কর পরিবারের গল্পে প্রায়ই অনালোচিত থেকে যায় লক্ষ্মীশঙ্করের নাম। তিনি রাজেন্দ্রশঙ্করের স্ত্রী। অসাধারণ রূপের সঙ্গে ছিল অনবদ্য কণ্ঠ। আর সেইসঙ্গে পেয়েছিলেন ধ্রুপদী নাচের তালিমও। মা বিশালাক্ষী চাইতেন, নাচ শিখুক লক্ষ্মী। কিন্তু মাকে লুকিয়েই শুরু হয়েছিল সঙ্গীতের চর্চাও। পরে উদয়শঙ্করের কাছে নৃত্যের তালিম পেয়েছেন, সঙ্গীতের তালিম পেয়েছেন রবিশঙ্করের কাছে। আলমোড়ায় উদয়শঙ্করের দলে যুক্ত হয়েছিলেন লক্ষ্মী। এখানেই একদিন শুনলেন, রাজেন্দ্রশঙ্কর তাঁকে বিবাহ করতে চান। দুজনের বয়সের তফাৎ ২১ বছর। তাই কিছুটা দ্বিধা ছিলই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁদের সম্পর্ক পূর্ণাঙ্গ রূপ পেয়েছিল। উদয় এবং রবিশঙ্করের দাম্পত্য জীবনে মেঘ ঘনিয়ে এলেও লক্ষ্মী আর রাজেন্দ্রর দাম্পত্যে কখনও চির ধরেনি।

IPTA-এর ওপরেও ধীরে ধীরে চেপে বসছিল পার্টির নির্দেশ। IPTA ছেড়ে বেরিয়ে এলেন রবিশঙ্কর। শান্তি বর্ধন, অবনী দাশগুপ্ত, শচীনশঙ্কর, নরেন্দ্র শর্মা, প্রভাত গাঙ্গুলিরা। এঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন উদয়শঙ্কর সেন্টারে, রবিশঙ্করের সঙ্গে তাঁরা যোগ দিলেন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল থিয়েটারে। এর পশ্চাদপটে ছিল জাতীয় কংগ্রেস। রবিশঙ্কর এইবার গ্রহণ করলেন একটি স্বতন্ত্র পরিকল্পনা। পণ্ডিত নেহরুর অনুমতি নিয়ে তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’কে তাঁরা করতে চাইলেন মঞ্চস্থ। রূপ দিতে চাইলেন একটা ব্যালে এবং অপেরার। সম্মতি মিলল।ভারতবর্ষের  গৌরবোজ্জ্বল  ইতিহাসের পুনর্নিমাণের  মধ্য দিয়ে জাতীয়  কংগ্রেস সংহত করতে চাইছিল অন্যান্য এশীয় দেশগুলিকেও সাম্রাজ্যবাদের শাসন থেকে মুক্ত করে  জাগ্রত করতে চাইছিল এক ঐক্যবদ্ধ চেতনা। ইতিহাস তৈরি করেছিল এই প্রযোজনা।

রাজেন্দ্রশঙ্কর আর লক্ষ্মীশঙ্কর  তখন প্রতিষ্ঠিত। বোম্বাইয়ের বোরিভেলিতে তাঁরা কিনেছেন বিশাল বড়ো বাংলো। ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’র প্রস্তুতিতে সকলে এসে উঠলেন সেখানেই। স্ত্রী আর দুই সন্তান নিয়ে এলেন দেবেন্দ্রশঙ্কর। যোগ দিলেন মাতুল ব্রজবিহারী। মাইহার থেকে শুভকে নিয়ে এসে পৌঁছলেন অন্নপূর্ণাও। ‘রাগমালা’-তে লিখেছিলেন রবিশঙ্কর, ‘…It would be the first time that I experienced the joy that can be found in a full family life…’। সারাদিন ধরে চলত রিহার্সাল। কোর্টইয়ার্ডের একটা অংশে ত্রিপলের ছাউনি করে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ জন মিলে চলত কাজ। হঠাৎ বৃষ্টি এসে মাঝে-মাঝে ভন্ডুল করে দিত সব। জল জমে অস্থায়ী এক পুকুর হয়ে উঠত কাজের জায়গা। লাঞ্চের জন্য কখনও-সখনও সেখান থেকে চলত মাছধরাও। বিরামহীন ছিল এর মহড়া। কিন্তু তারই ফাঁকে-ফাঁকে লক্ষ্মী, অন্নপূর্ণা আর কৃষ্ণাশঙ্কর তিন জা-য়ে মিলে সানন্দে সামলাতেন হেঁশেল। রাঁধতেন ওই ত্রিশ-পঁয়ত্রিশজনের খাবার। এমন সুখপর্ব খুব কম এসেছে শঙ্করদের জীবনে।

১৯৪৭ সালের মার্চে ‘এশিয়ান রিলেসন্স কনফারেন্সে’-এ পরিবেশিত হল ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, বল্লভভাই প্যাটেল, রাজাজি, সর্বেপল্লী রাধাকৃষ্ণণ প্রমুখ। ভারতীয় খাসমহল থেকে আপামর দেশকে মুগ্ধ করেছিল এই পরিকল্পনা। কিন্তু সময় লাগল না এর পটপরিবর্তনেও। দেশ স্বাধীন হল। ৩০ জানুয়ারি ১৯৪৮-এ নিহত হলেন মহাত্মা গান্ধী। স্বাধীনতার পরে জাতীয় কংগ্রেস ব্যস্ত হয়ে পড়ল স্বদেশগঠনের অন্যান্য প্রকল্পে। বাধ্যত শঙ্কররা এবং শঙ্কর-বন্ধুরা সরে এলেন সংগঠন থেকে। স্বাধীনভাবে এবার তাঁরা খুললেন নিজস্ব দল। নাম দিলেন ‘ইন্ডিয়া রেনেসাঁস আর্টিস্টস’। ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ ব্যালেটিই আবার প্রস্তুত করা হল। কিন্তু স্বাধীন দেশে তখন নতুন রাজনৈতিক পালাবদল, এবার তা ব্যর্থ হল চূড়ান্তভাবে। শঙ্কররা এতে লগ্নি করেছিলেন প্রায় সর্বস্বান্ত হয়ে। দল, পরিকল্পনা, অর্থ ভেসে গেল সব।

রাজেন্দ্রশঙ্কর ও লক্ষ্মীশঙ্কর

 আকাশ ভেঙে পড়ল লক্ষ্মীর জীবনে। স্বামী, সন্তান, নৃত্য, বিচিত্র কর্মোদ্যোগ— ধীরে ধীরে এক অনন্য গভীরতায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠছিল তাঁর জীবন। ঠিক সেই সময়েই তাঁর শরীরে ধরা পড়ল প্লুরিসি। চিকিৎসা চলাকালীনই ডাক্তাররা জানিয়ে দিলেন আর কোনোদিন নাচে ফেরা সম্ভব হবে না লক্ষ্মীর পক্ষে। কণ্ডাপ্পা পিল্লাই, উদয়শঙ্কর তথা আলমোড়ায় তাঁর নৃত্যশিক্ষা। আশৈশব উচ্চাঙ্গ শিল্পচর্চায় তাঁর বাস। হঠাৎ একদিন রুদ্ধ হয়ে গেল সব। নৃত্যই তাঁর প্রকাশ, তাঁর যাপন। সেই সম্পদটুকু কেড়ে নিয়ে কে যেন নিঃস্ব করে দিল তাঁর অস্তিত্বকে। তদুপরি দলের ব্যর্থতা, অর্থাভাব। রাজেন্দ্র বিক্রি করে দিলেন তাঁদের বাংলো। কত যত্নে গড়ে তোলা তাঁদের সেই কারু-ঘর। একটা ছোট্টো বাসায় লক্ষ্মী ফিরলেন। শিল্প-প্রতিপত্তি সমস্ত কিছুর থেকে দূরে রাজেন্দ্র আর লক্ষ্মী দাঁড়ালেন প্রকাণ্ড শূন্যতায়। 


'মেলোডি অ্যান্ড রিদম' অনুষ্ঠানে জওহরলাল নেহরু ও রবিশঙ্করের সেই বিশেষ মুহূর্ত

 ছোটো থেকে গানের  প্রতি লক্ষ্মীর প্রীতি ছিল অপ্রতিরোধ্য। মায়ের অগোচরে নিজেকে গান শিখিয়েছিলেন তিনি। সুর ছিল তাঁর আজন্মকালের সই। সেই সুরের কাছেই ফিরলেন লক্ষ্মী। গানকে নিজের আত্যন্তিক জীবনচর্যার অঙ্গ করে তুলতে পারেননি, এ আক্ষেপ ছিল তাঁর। কিন্তু গান এমন রাজকীয় গরিমায় কখন এসে ঠাঁই নিয়েছে তাঁর কণ্ঠে, বুঝি টের পাননি তিনি নিজেও। লক্ষ্মী এবার ধীরে-ধীরে পদার্পণ করলেন গানের জগতে। ১৯৫২-য় চেতন আনন্দের ছবি ‘আঁধিয়া’তে নিজের শারীরিক প্রতিকূলতা নিয়েই লক্ষ্মী সামলালেন নৃত্য নির্দেশকের ভূমিকা। এমনকি  লতা মঙ্গেশকর আর আশা ভোঁসলের সঙ্গে সেই ছবিতে গাইলেন গানও। ১৯৫২-তে জন্ম নিলেন রাজেন্দ্র আর লক্ষ্মীর দ্বিতীয় সন্তান বিজয়শ্রী শঙ্কর। শঙ্করদের আরো এক প্রতিভাধর উত্তরসূরী। ভিজি সুব্রহ্মনিয়ম নামেই যিনি বেশি পরিচিত।


ভিজি, রবিশঙ্কর, এল. সুব্রহ্মনিয়ম ও অন্যান্যদের সঙ্গে লক্ষ্মীশঙ্কর

 ১৯৫৪-য় ফিল্ম  ‘মস্তানা’-তে ‘ঝুম ঝুম কে দো দিওয়ানে’ গানটি লক্ষ্মীশঙ্কর ডুয়েট গাইলেন মহম্মদ রফির সঙ্গে। সেই ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন প্রখ্যাত মদন মোহন। লক্ষ্মীর গায়কি সম্পর্কে অবহিত হয়ে তিনিই যোগাযোগ করিয়ে দিলেন পাতিয়ালা ঘরানার ওস্তাদ আবদুল রেহমান খানের সঙ্গে। তিন বছর তাঁর কাছে শিক্ষাগ্রহণ করলেন লক্ষ্মী। যত্ন করে নিজে তাঁকে গান শেখালেন তাঁর দেওর রবিশঙ্করও। শোক তাঁকে  বিস্রস্ত করেনি। শোকের অভিযাত্রায় তিনি খুঁজেছেন জীবনকেই। যাত্রা বদলেছে কিন্তু লক্ষ্মীশঙ্কর পুনরুদ্ধার করলেন তাঁর সিংহাসন, তাঁর অধিষ্ঠান।


অন্যান্যদের সঙ্গে লক্ষ্মীশঙ্কর, জর্জ হ্যারিসন ও রবিশঙ্কর

 ১৯৫৭-য় কলকাতার ‘এন্টালি মিউজিক ফেস্টিভালে’ ধ্রুপদি সংগীতের তালিমপ্রাপ্ত সংগীতশিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন  লক্ষ্মীশঙ্কর। শিষ্যকে উৎসাহ দিতে গুরু আবদুল রহমান জানালেন এই অনুষ্ঠানে তিনি স্বয়ং বাজাবেন হারমোনিয়ম। এরপর তাঁকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি কখনও। দর্শক-শ্রোতার কাছে নৃত্যশিল্পী লক্ষ্মী এবার প্রতিষ্ঠালাভ করলেন অপরূপ কণ্ঠের অধিকারী সংগীতশিল্পী হিসেবে। জীবনশিল্পীর কী চমৎকৃত এক রচনা। কিন্তু লক্ষ্মীর জীবনের নকসা ভারি অদ্ভুত, ভারি করুণ। সুখ চৌকাঠটুকু পেরিয়ে জিরোবে দুদণ্ড, তার আগেই কোন অশনি সংকেতে যেন লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় সব। ঈর্ষাকাতররা বোঝালেন আবদুল রহমানকে, এই অনুষ্ঠানে লক্ষ্মী পেলেন প্রতিষ্ঠা, সেই গুমরে আপনাকে কি বাজনদার ঠাউরালো সে? গুরু বিমুখ হলেন। জানালেন, আর কখনও তিনি শিক্ষাদান করবেন না লক্ষ্মীকে।

লক্ষ্মীর জীবনের এইসব বহুতর সংকটে শক্ত করে হাল ধরলেন রাজেন্দ্রশঙ্কর। সংসার, সন্তানপালন সমস্তকিছুর দায়িত্ব নিলেন তিনি। সঙ্গে রইলেন লক্ষ্মীর মা বিশালাক্ষী। স্ত্রীর সাংগীতিক জীবনকে তাঁর কাঙ্ক্ষিত আকৃতিটি দিতে চেয়ে সাগ্রহে নিজেকে উজাড় করলেন তিনি। দাম্পত্যের-আখ্যানে ভারতবর্ষের কটা গল্পে আছে, অনুরাগের এমন উলটপুরাণ? লক্ষ্মী এবার এলেন গুরু বি.আর.দেওধরের কাছে। বিষ্ণু দিগম্বর পালুস্করের শিষ্য তিনি। একদিন তাঁর গানের আসরে কেউ বললেন, এই গানখানা গাও। লক্ষ্মী চেয়ে দেখলেন তাঁকে নির্দেশ দিচ্ছেন ওস্তাদ আবদুল রহমান খান। তাঁর জীবনে ফিরে এলেন তাঁর গুরু।   

এল. সুব্রহ্মনিয়ম ও ভিজি শঙ্কর

 প্রসঙ্গসূত্রে মনে পড়ছে একটা গল্প। সুন্দরী শ্রীধরণী উদয়শঙ্করের সেন্টারে ছিলেন, পরে দিল্লিতে একটা দল গড়েন ত্রিবেণী কলাসংগম নামে। ১৯৫৮-তে সেখানে একটি অনুষ্ঠান করেন রবিশঙ্কর। ‘মেলোডি অ্যান্ড রিদম’ নামে। খুবই অভিনব ছিল সেই অনুষ্ঠানের সজ্জা। এর আগে কখনও তেমনটা হয়নি এদেশে। ধ্রুপদ, ধামার থেকে শুরু করে খেয়াল, ঠুংরি, পল্লীসংগীত সব মিলিয়ে আড়াই ঘন্টার একটা অর্কেস্ট্রেশন। সেই অনুষ্ঠান দেখতে এসেছিলেন স্বয়ং পণ্ডিত নেহরু। অনুষ্ঠানে লোরি অঙ্গের একটা গান রেখেছিলেন রবি। স্টেজে বাচ্চা কোলে নিয়ে একটি মেয়ে লিপ দিচ্ছে সেই লোরি গানে, ‘শো যা রে ললনা, তারে বিছৌনা চন্দন কে পালনা’। নিদ্রার পরিবেশকে গড়ে তুলতে আলো বাঁধা হয়েছিল মেদুর করে। গানটি আসলে গাইছিলেন লক্ষ্মী, তাঁর মায়াভরা কণ্ঠে। প্রত্যেকটি অংশের পরপরই তুমুল হাততালিতে ফেটে পড়ছিল প্রেক্ষাগৃহ। অথচ এই গানটির পর নিস্তব্ধ চারপাশ। কী হল? ঔৎসুক্য বোধ করলেন আর্টিস্টরা। সারাদিনের প্রবল পরিশ্রমের পর এসেছিলেন পণ্ডিতজি। দেখেওছিলেন সবটা। তারপর ওই আবহে, লক্ষ্মীর ঘুমপাড়ানি গানে কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন তিনি। সকলে দেখলেন সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে নেহরুর মাথা, নাক ডাকছেন মৃদু। ছোট্টো থিয়েটার-হল। এই দৃশ্যে এমন মায়া হল সকলের, শব্দ করে কেউ জাগিয়ে দিতে চায়নি তাঁকে। ঘুম যখন ভাঙল নেহরু এসে জাপটে ধরলেন রবিশঙ্করকে। সেই ক্ষণটি বাঁধা আছে এক দুর্লভ চিত্রে।

১৯৬১-তে উদয়শঙ্কর রবীন্দ্রনাথের ‘সামান্য ক্ষতি’-কে রূপান্তরিত করলেন সংগীতময় ব্যালেতে। আমেরিকা আর ইউরোপ ট্যুরের সময় রবিশঙ্কর ব্যস্ত হয়ে পড়লে ভাসুর উদয় তাঁকে দিলেন সংগীতদল পরিচালনার গুরুদায়িত্ব। শঙ্করদের সাফল্যে এক অভূতপূর্ব সংযোজন এই পরিকল্পনা। ১৯৬৬-তে এইচ.এম.ভি থেকে ডুয়েট রেকর্ড প্রকাশিত হল বিখ্যাত গায়িকা নির্মলা দেবীর ( হিন্দি চলচ্চিত্রাভিনেতা গোবিন্দা-র মা) সঙ্গে। রেকর্ডটি  উচ্চপ্রশংসিত হয় আর লাভ করে জনপ্রিয়তাও।

লক্ষ্মীশঙ্কর, অনুষ্কাশঙ্কর ও রবিশঙ্কর

 ইতিমধ্যে অসংখ্য জনপ্রিয় হিন্দি ছবিতে প্লে ব্যাক করলেন লক্ষ্মীশঙ্কর। ১৯৭৪-এ ঘটল এক ইতিহাস। ১৯৭০-এ ভেঙে গেছে ‘বিটলস’। ১৯৭৪-এ কানাডার ভাঙ্কুভারে আয়োজিত হল এক ফিউশন অনুষ্ঠান। ‘ইন্ডিয়ান মিউজিক’ ও ‘রক অ্যান্ড রোল’ এই দুটি বিষয়ে গাঁটছড়া বাঁধলেন দুই লেজেন্ড রবিশঙ্কর আর জর্জ হ্যারিসন। মায়ের মতোই সুর পেয়েছিলেন ভিজিও। অনুষ্ঠানে গাইলেন তিনি। কুমারশঙ্কর বাজালেন তম্বুরা। বিরাট মার্কিন শ্রোতার সামনে জর্জকে পাশে নিয়ে হিন্দুস্থানি সংগীতে মাতিয়ে দিলেন লক্ষ্মীশঙ্কর। কৃষ্ণের ভজন-সংগীতে সেদিন বেজেছিল পশ্চিমি বাদ্যযন্ত্র। দেশের বেড়াভাঙা সুরের ঐশ্বর্যময় অনির্বচনীয়তাকে সেদিন অনুভব করেছে মানুষ।  

১৯৭৪-এর পর্বেই  রবিশঙ্কর এবং  জর্জ হ্যারিসনের উদ্যোগে তৈরি হল অ্যালবাম  ‘শঙ্কর ফ্যামিলি এন্ড ফ্রেন্ডস’। এই কাজে যুক্ত হলেন দিকপালরা। ‘বিটলস’-এর রিঙ্গো স্টার, বিল প্রেস্টন অন্যদিকে আল্লারাখা, হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া, শিবকুমার শর্মা, এল সুব্রহ্মনিয়ম প্রমুখ। রইলেন শুভশঙ্কর আর লক্ষ্মীর বোন কমলা-ও। লক্ষ্মী গাইলেন রবিশঙ্করের লেখা গান ‘I am missing you, Oh Krishna, where are you?’ সে গানের অনুরণন আজও অব্যাহত। তারপর আরো এক ইতিহাস। ১৯৮২-তে রিলিজ করল রিচার্ড অ্যাটেনবরোর দিগদর্শী ছবি ‘গান্ধী’। রবিশঙ্কর আর জর্জ ফেনটোন-এর সংগীত পরিচালনায় লক্ষ্মী গাইলেন, ‘বৈষ্ণবজন তো তেনে কহিয়ে জে, পীড় পরায়ি জানে রে।’  এত এত কাণ্ড তবু কী আশ্চর্য, সাধারণ জনমানসে তেমন করে আমলই পেল না লক্ষ্মীশঙ্করের জীবন।

পুনরাবৃত্ত দুর্ভাগ্যও যে হতে পারে কতটা নির্মম, নিষ্ঠুর আর ভয়ংকর লক্ষ্মীর জীবন এবার এসে ঠেকল সেইখানে। ১৯৮২-তে লক্ষ্মী, তাঁদের সন্তানরা তখন দেশে নেই কেউই। ঠিক সেইসময় রাজেন্দ্রশঙ্কর আকস্মিক চলে গেলেন ব্রেন হ্যামারেজে।

লক্ষ্মীপ্রতিমার মতো চেহারা ছিল রাজেন্দ্র আর লক্ষ্মীর কন্যা বিজয়শ্রীর। মায়ের মতোই পারঙ্গম ছিলেন সুরে। প্রখ্যাত এল. সুব্রহ্মনিয়ম বহুদিনই ছিলেন এই শঙ্কর পরিবারের সুরের আবর্তে। কর্নাটকি ভায়োলিনে অবিসংবাদী তাঁর বিচরণ। ১৯৭৬-এ ভিজির সঙ্গে সম্পন্ন হল তাঁর বিবাহ। ১৯৯২-তে ভিজির শরীরে দেখা দিল ক্যানসার। অত্যন্ত যন্ত্রণাকাতর ছিল তাঁর ব্যাধির দিনগুলো। ভিজি চলে গেলেন ১৯৯৫-তে। সময়ের কাছে স্তব্ধ দাঁড়ালেন লক্ষ্মীশঙ্কর। ১৯৯৯ সালে সুব্রহ্মনিয়ম বিয়ে করলেন প্রখ্যাত গায়িকা কবিতা কৃষ্ণমূর্তিকে। কবিতা আপন করে নিলেন ভিজির চার সন্তানকে।

২০০৮-এ বেস্ট ট্র্যাডিশনাল ওয়ার্ল্ড মিউজিক অ্যালবামের জন্য লক্ষ্মী পেলেন গ্র্যামির নমিনেশন। আর ১২ সেপ্টেম্বর ২০০৮-এই লস এঞ্জেলসে কুমারশঙ্কর আহত হলেন ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায়। উনিশ দিন টানা ইনটেনসিভ কেয়ারে রাখা হল তাঁকে। মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ফিরলেন কুমার। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা বিধ্বস্ত করে তুলল তাঁর জীবনকে। ধীরে ধীরে সুস্থ হলেন কুমারশঙ্কর। এইসব হৃদয়ের রক্তক্ষরণে কত বেসুর বাজল তাঁর জীবন, তবু সুর থেকে লক্ষ্মী শেষদিন পর্যন্ত বিচ্যুত হলেন না একরত্তি।

Powered by Froala Editor