বিয়ের আড়াই ঘন্টা আগেও উদয় চিঠি লিখলেন অমলাকে  

শঙ্কর সরণি - ৪৬
আগের পর্বে

দিজেন্দ্রলালের পুত্র সংগীতবিদ দিলীপকুমারের সূত্রে অমলার নাচ দেখতে চান স্বয়ং নেতাজি। মুগ্ধ সুভাষচন্দ্র অক্ষয় নন্দীকে শপথ করান, তিনি কখনও নাচ থেকে আলাদা করবেন না অমলাকে। সেইসঙ্গে অমলাকে আলমোড়া পাঠানোর নির্দেশও দিয়েছিলেন। আলমোড়ায় প্রথম দিন থেকেই উদয়ের প্রতি প্রেমানুভূতি টের পেয়েছিলেন অমলা। হয়তো বুঝেছিলেন, উদয়ও তাঁকে ভালোবেসেছেন। কিন্তু ঘর বাঁধার মানুষ নন উদয়শঙ্কর। তাই প্রেমের বিষয়টি এড়িয়েই গিয়েছেন অমলা। হঠাৎই উদয়শঙ্করের জন্মদিনের দিন তাঁর কাছ থেকে বিবাহ প্রস্তাব পেয়ে চমকে উঠেছিলেন অমলা। অবশ্য বিবাহের প্রস্তাবে খুশি হননি অক্ষয় নন্দী। তবু বাবাকে রাজি করিয়েছিলেন অমলা। আর এভাবেই শুরু হল দুজনের চিরন্তন দাম্পত্যের।

অমলা আর উদয়শঙ্করের বিবাহ বিষয়ে গোড়াতে অসন্তুষ্ট ছিলেন অমলার বাবা অক্ষয় কুমার নন্দী। ধীরে ধীরে খানিকটা বদল হল পরিস্থিতি। হয়তো উদয়কে নিয়ে অমলার বিশ্বাস এবং দৃষ্টিভঙ্গি খানিকটা প্রভাবিত করল তাঁকে। বিবাহের অনুষ্ঠান পরে হলেও বিবাহ কথাটিকে অনিশ্চিত করে রাখা, অক্ষয়ের মনে হল অনুচিত। তিনি প্রতীক্ষা করছিলেন পাকাকথার। কিন্তু উদয়ের তরফ থেকে সুনিশ্চিত সম্মতি আদায়ে বেগ পেতে হল তাঁকে। ১৯৪১-এর শেষের দিকে এক পত্রে উদয়শঙ্করকে লিখলেন তিনি, অমলার বিবাহ সম্পর্কে আলমোড়ায় তাঁর কাছে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করায় উদয় জানিয়েছিলেন, উত্তর দেবেন যথাসময়ে। কলকাতায় সে প্রস্তাব পুনরায় জানালে তাঁর উত্তর ছিল অভিন্ন। এবার পুজোয় আলমোড়ায় অমলার মা পেয়েছেন সেই উত্তর। যে-সংবাদে বিশেষ সুখী হয়েছেন তাঁরা। এখন তাঁদের বিশেষ সুবিধা হয় যদি অক্ষয়ের যথাকর্তব্য বিষয়ে উদয় জানান বিস্তারিত। এই পত্রে শুধু যে অমলা-উদয়ের বিয়ের অনুপুঙ্খটুকুই ধরা রয়েছে, এমনটা নয়। এর মধ্যে ছাপ রয়েছে একটা যুগ আর তার আচরণের নিজস্ব দার্ঢ্যেরও। যেহেতু উদয় তখনও সম্মত হননি স্পষ্টত, সেহেতু সম্পূর্ণ চিঠিতে অমলার বিবাহ বিষয়ে তাঁর মতামত জানতে চাওয়া হলেও, সমস্ত চিঠিতে অনুল্লিখিত রইল সে বিবাহে তাঁর ভূমিকাটি। সম্মতি প্রকাশ করলেন উদয়। স্থির হল বিবাহের দিন।

শঙ্করদের জীবনের বেশ কিছু দরকারি চিঠিপত্র আমাদের পড়বার সুযোগ করে দিয়েছিল ‘শঙ্করনামা’। সেখানেই রয়েছে মধুর এক চিঠি। আলমোড়া থেকে অমলাকে লিখছেন উদয়, ‘…এখানে ভীষণ একা লাগছে আর ভারি চমৎকার একটি মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে ছাড়া তেমন কোনও উত্তেজক ঘটনাও তো ঘটছে না। তুমি কি সেই মেয়েটিকে চেনো?’ পিতৃমাতৃহীন উদয় বিয়ের সমস্ত উদযোগ করলেন নিজের হাতে, যত্ন করে। এই ভূমিকাতেও অমলা তাঁকে চেয়ে দেখলেন একেবারে নতুন পরিচয়ে। ভাইদের মধ্যে সবার আগে বিয়ে হয়েছিল সেজো ভাই দেবেন্দ্রশঙ্করের। তারপর ছোটো রবি, তারপর মেজো রাজেন্দ্র সবশেষে হল বড়োভাই উদয়ের বিবাহ। দেবেন্দ্রশঙ্করের স্ত্রী কৃষ্ণাশঙ্কর ছিলেন অত্যন্ত স্নেহশীলা। বাড়ির সমস্ত ব্যাপারে দায়িত্ব-কর্মে তাঁকে ভরসা করতেন সকলে। আর ছিলেন মাতুল, ব্রজবিহারী বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমাঙ্গিনীর মামাতো ভাই। উদয়ের দলে ছিলেন, ছিলেন শঙ্করপরিবারের সুখদুঃখের সঙ্গী। তবু বিয়ের সকল খুঁটিনাটিতে কোন এক মাধুর্য যেন ঘিরে ধরল উদয়কে। বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্র আঁকলেন নিজের হাতে। নৃত্যশিল্পী উদয়শঙ্করের খ্যাতির ছায়ায় ঢাকা পড়ে ছিল সোনার মেডেল পাওয়া চিত্রকর উদয়শঙ্কর। আজ সেই শিল্পী আরো বড়ো আধারে ফুটিয়ে তুলতে চাইলেন রঙ আর রেখা। অন্তরস্থলে থাকা গভীর প্রেমানুভূতি জীবনের মধ্যে পেতে চাইল তার কাঙ্ক্ষিত চেহারা।

বিয়ের দিন স্থির করলেন উদয়। ৮ মার্চ, ১৯৪২। সেই কথা জানিয়ে উক্ত চিঠিতে অমলাকে লিখলেন, ‘ও অমলা, [বিয়ের ব্যাপারে] আমি প্রতিদিন ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে পড়ছি। আজ আমি বিয়ের তারিখ ঠিক করেছি ৮ই মার্চ, আর সব ছাত্রদের, দলের সমস্ত সদস্যদের, গুরুদের আর ওস্তাদকে আমন্ত্রণ জানাব। আজ সকালে আমাকে কী যে এক পাগলামিতে পেয়ে বসল, আমি নিমন্ত্রণ পত্রের জন্য ছোট্টো একটা ছবি এঁকে হরেনদাকে পাঠিয়ে দিয়েছি ৫০০টা ছাপাবার জন্য। আমি ৩০০ টাকাও পাঠিয়েছি গায়ে হলুদের জিনিসপত্র কেনার জন্য। আগে যেখানে আমি টাকা খরচ করতে চাইনি, এখন সেখানে আমাকে খরচের নেশায় পেয়ে বসেছে।’      

উদয়শঙ্করের হাতে আঁকা নিজের বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র

 উদয় চাইলেন বিয়ে হোক আলামোড়াতেই। বিয়ের আগে অমলা এলেন বাড়ির সকলের সঙ্গে। ছিয়াশি মাইল একা গাড়ি চালিয়ে উদয় পৌঁছলেন কাঠগোদাম, তাঁকে আনতে। সেন্টারে এসে অবাক হয়ে গেলেন অমলা। উদয়ের বাড়িরই ছোট্টো একটা ঘর নিজে হাতে, কী অপূর্ব সজ্জায়, তিনি সাজিয়ে রেখেছেন অমলার জন্য। ঘরে টাঙানো এক সুন্দর শামিয়ানা। সুন্দরী শ্রীধরণী জরুরি এক খবর এ প্রসঙ্গে দিয়েছিল হবু কনেকে। শামিয়ানার ব্যবস্থা হচ্ছে দেখে সুন্দরী উদয়কে জিজ্ঞাসা করে, দাদা, সেলাই আমি করে দিই? দাদা বললেন, না। তারপর নিজেই বসে, যত্ন করে, করলেন সমস্ত সেলাই।

আরও পড়ুন
অমলার অনুভূতিলোকে সেদিন নামল প্রথম আষাঢ়

বিয়ের ঠিক আগে-আগে দুজনেই আলমোড়ায়, চারিদিকে আত্মীয়স্বজন, গুরুজনেরা। মা বললেন অমলাকে, এখন যেন আর দেখাসাক্ষাৎ কোরো না। তাই কথা হত চিঠিতে, কারোর হাত মারফত চলত দূতিয়ালি। এমনকি ৮ মার্চ বিয়ের দিন সকালেও অমলা পেলেন উদয়ের চিঠি। বিয়ের তখন আড়াই ঘন্টা বাকি। উদয় লিখলেন, ‘আর আড়াই ঘন্টা পরে তুমি হবে আমার স্ত্রী আর আমি তোমার স্বামী।… তোমাকে কত যে ভালোবাসি। আর অপেক্ষা করতে পারছি না।’ বিয়ের অনুষ্ঠানের জায়গাটিকে সাজানো হয়েছিল সুচারুভাবে। বিয়ের তিনদিন আগে হল গায়ে হলুদ। অমলা বলেছিলেন, সেদিন খুব সুন্দর দেখিয়েছিল ওঁকে। হলুদ মাখা গা, পরনে কোঁচানো ধুতি। উদয়শঙ্কররা আদতে চট্টোপাধ্যায়, ব্রাহ্মণ। অমলা নন, তাই অসবর্ণ বিবাহ। রেজিস্ট্রি ম্যারেজের আয়োজন হল ৮-ই সকালে। সন্ধেবেলায় বরবেশে উদয় এলেন বিয়ের অনুষ্ঠানে। মাথায় টোপর, গলায় ফুলের মালা, ভারি সিল্কের পাঞ্জাবিতে, উদয় এলেন দোলায় চড়ে। যেন সাক্ষাৎ প্রেমের দেবতা। সেন্টারের ছেলেমেয়েরা সবাই তখন আলমোড়াতেই। রডোডেনড্রন আর মিমোসো ফুলের সাজে ওরা সুশোভিত করে তুললে বিবাহবাসরকে। সমস্তটা জুড়ে কী বাহার সেদিন। কী সাবেকি, নান্দনিক এক পরিবেশ। ভাশুরের বিয়েতে কৃষ্ণাশঙ্কর পালন করলেন শাশুড়ির অসম্পন্ন কর্তব্য। আত্মীয়স্বজন, লোকজন, বন্ধুবান্ধব, ছাত্র-ছাত্রী থই-থই আনন্দ চারিদিকে। বেনারসি শাড়িতে, এক গা গয়নায় চিরসুন্দর অমলা সেদিন প্রসাধিত হলেন প্রেমে। রূপের অমন বিভা সে সাজ তাঁর অন্তঃকরণের। বিবাহের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হল। অমলা  হলেন অমলাশঙ্কর।

বিয়ের দিন সকালে রেজিস্ট্রির সময়

বিবাহ হল, তবু আগামী বহুবছর উদয়শঙ্কর রইলেন সেই প্রেমিক সত্তাটিতেই। সম্পর্ককে নিয়ে উদয়ের প্রবল আবেগ, গার্হস্থ্যের প্রতি দুর্নিবার টান ঘিরে রইল অমলাকে। ভূমিকা বদলালো, অটুট রইল অনুভূতির রেশ। সেই সঙ্গে যোগ হল সন্তানের জন্য আনন্দময় প্রতীক্ষা। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সেন্টারের কাজকর্ম কম। সেই সময় জুড়ে চলছে ‘কল্পনা’ নির্মাণের ভাবনাচিন্তা। একেবারে আনকোরা এই কর্মদ্যোগে সকলে মেতে উঠলেন নতুন উদ্দীপনায়। উদয়শঙ্করের ভারি ইচ্ছা ছিল তাঁর সন্তান পৃথিবীতে আসুক, তাঁর জন্মের দিনটাতেই। ৮ ডিসেম্বর উদয়ের জন্মদিন। ৮ না হোক, তার আশেপাশেই জন্ম হল উদয়-অমলার প্রথম সন্তানের। ১১ ডিসেম্বর ১৯৪২ জন্ম নিলেন শঙ্করদের আরো এক যোগ্য উত্তরপ্রজন্ম। তাঁদের পুত্রসন্তান, আনন্দশঙ্কর। যতদিন নাম ঠিক হয়নি, উদয় ছেলেকে ডাকতেন ‘বেবি’। একদিন দাড়ি কামাচ্ছিলেন, হঠাৎ তড়িঘড়ি বেরিয়ে এসে বললেন, বুদ্ধের শিষ্য আনন্দ, ত্যাগের প্রতীক, দর্শনের খুব উচ্চস্তরের অনুভূতি। আনন্দ, সেই নামই বহাল রইল।

আরও পড়ুন
লক্ষ্মীশঙ্করের গান শুনে ঘুমিয়ে পড়লেন নেহরু

উদয়-অমলার বিয়ের অনুষ্ঠান

আনন্দের জন্মের পরপরই উদয়কে বেরোতে হল ভারতভ্রমণে। ‘কল্পনা’র জন্য তখন চলছে অর্থসংগ্রহের কাজ। চলছে স্টুডিও নির্বাচন। কিন্তু এই প্রথম, কাজের মধ্যেও উদয় টের পেলেন অসম্ভব এক পিছুটান। সারাদিন সদ্যোজাত আর অমলার চিন্তা যেন প্রতিপল বেঁধে রাখে তাঁকে।  ২৪ ডিসেম্বর ১৯৪২ আমেদাবাদ থেকে আলমোড়ায় অমলাকে চিঠি লিখলেন উদয়, ‘… কলকাতায় তিনবার বোমা পড়েছে… তুমি কি তোমার বাবার কাছ থেকে কোনও খবর পেয়েছ?... টেলিগ্রাফ, চিঠি, ট্রেন সবরকমের যোগাযোগই এখন ছিন্ন, শুধু লক্ষ লক্ষ মানুষ পালিয়ে যাচ্ছে শহর ছেড়ে। কোনও রকমের সঠিক খবর পাওয়া যাচ্ছে না। আমি তোমার বাবাকে একটা তার করে দিয়েছি যাতে উনি (আলমোড়ায়) চলে আসেন অথবা তোমাকে ওঁর খবরাখবর জানান। বাচ্চাকে ঠাণ্ডা থেকে খুব সাবধানে রেখো… আমি সব সময়ই বাচ্চার আর তোমার কথা চিন্তা করি… আমার কথা মাঝে মাঝে মনে কোরো… তোমাকে আর বেবিকে আমার সমস্ত ভালোবাসা… তোমাকে আমি খুব খুউব ভালোবাসি।’ জগৎবিখ্যাত এক মানুষ। জীবনের কুড়ি বছর বয়স থেকে আগামী বাইশ বছর কাজ ভিন্ন যিনি সময় ব্যয় করেননি একমুহূর্ত। বিবাহ, সংসারকে যিনি তীব্র অবিশ্বাস করেছেন আগাগোড়া, তার একটা উল্টো দৃশ্য ধরা পড়ে এই চিঠিতে। সাংসারিক উদ্বেগ, দূর থেকে গৃহকর্তার কর্তব্যপালন, স্ত্রী-সন্তানের জন্য স্নেহকাতরতা যেন মূর্ত করে তোলে মানুষ উদয়শঙ্করকে।

অমলাশঙ্কর

 ৩ মার্চ ১৯৪৩ বোম্বাই থেকে বিবাহ-বার্ষিকীর ঠিক আগে-আগে অন্য একটি চিঠিতে উদয় লিখলেন, ‘ … উফ্ অমলা, আমি সারাদিন তোমার সঙ্গে কথা বলে যাই (মনে মনে)। তুমি আর বেবি আমার সঙ্গে থাকলে আমার যে কত ভালো লাগত! আমি সারাদিন বেবির ছবির দিকে তাকিয়ে থাকি… এবং এক এক সময় কান্না পেয়ে যায়, জানি না কেন। অমলা, আমাদের বাচ্চাটি কী সুন্দর বলো তো! অনেক অনেক ধন্যবাদ, এ সবই হয়েছে শুধু তোমার জন্য কারণ তুমি এত ভালো, সুন্দর… আর আমার কী সৌভাগ্য!… আমি আলমোড়ায় ৭ই পৌঁছাব যেমন করেই হোক, আর ৮ই আমরা আবার বিয়ে করব…’।

আরও পড়ুন
লক্ষ্মীশঙ্কর: মায়ের আড়ালে গান শেখালেন নিজেকে

উদয় যেমন করে ভালোবেসেছিলেন, অমলাও তাঁকে ভরিয়ে রেখেছিলেন তেমন পরিপূর্ণ করেই। যে নতুন উদয় ধরা দিয়েছিল তাঁর কাছে অমলা গ্রহণ করেননি শুধু সেইটুকুই, গম্ভীর-পরিণত একটা মন নিয়ে গ্রহণ করেছিলেন উদয়ের অতীতকেও। নিজের অতীত থেকে স্নান সেরে উদয় এসেছিলেন অমলার কাছে। কিন্তু অতীত তাঁর সঙ্গ ছাড়েনি।  সে দুঃখ বহন করতে হল অমলাকে। 

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
মিছরি জ্যয়সি আওয়াজ থি উনকি