প্রেমে ব্যর্থ, তবু প্রেমিকার মৃতদেহ আঁকড়েই জীবন কাটিয়েছেন জার্মান চিকিৎসক

বেশ কয়েক বছর আগে যক্ষ্মা রোগে প্রাণ হারিয়েছেন এক বোন। অন্য বোনটিও একই রোগে ভুগছেন। তাঁরও দিন ফুরিয়ে এসেছে, জানেন তিনি। তবে তার আগে একবার বোনের মসোলিয়ামের ভিতর প্রবেশ করতে ইচ্ছে হল তাঁর। আসলে কিছুদিন থেকেই তাঁর মনে হচ্ছিল, বোনের মৃতদেহ আর মসোলিয়ামের মধ্যে নেই। এমন আশঙ্কার পিছনে কোনো যুক্তি অবশ্য ছিল না। কিন্তু দেখা গেল, সত্যিই মৃতদেহ নেই মসোলিয়ামে। আর এখান থেকেই রহস্যের জাল গুটিয়ে আসতে শুরু করল।

মেয়েটির নাম ছিল মারিয়া এলিনা মিলাগ্রো ডি হোয়োস। এলিনা নামেই ডাকতেন সবাই। বিশ শতকের শুরুতে যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন এলিনা। এই সময় তাঁর চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছিলেন কার্ল ট্যাঞ্জলার নামের এক জার্মান রেডিওলজিস্ট। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সেনানী কার্ল দীর্ঘদিন কাটিয়েছিলেন কনসেন্ট্রেসন ক্যাম্পে। সেখানে থাকতেই কিছুটা মানসিক বিকৃতি দেখা দিয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধের পর আমেরিকায় যখন তিনি ডাক্তারি করছিলেন, তখন তেমনটা আর খেয়াল করেননি কেউই। ভেবেছিলেন, কার্ল হয়তো সুস্থ হয়ে উঠেছেন। এর মধ্যে একটি বিবাহও করেন তিনি। দুই সন্তানেরও জন্ম হয়। কিন্তু এলিনাকে দেখার পরেই আবার তাঁর চরিত্র বদলে যেতে থাকে।

কার্ল দাবি করতে থাকেন, বহু বছর আগে স্বপ্নে তাঁর ঠাকুমা একটি মেয়ের ছবি দেখিয়ে বলেছিলেন এই মেয়েই কার্লের জীবনসঙ্গী হবে। আর সেই ছবির সঙ্গে হুবহু মিলে যায় এলিনার মুখ। এলিনার বয়স তখন মাত্র ২২। অন্যদিকে কার্লের বয়স ৫০ পেরিয়েছে। তাছাড়া তিনি বিবাহিত। কার্লের প্রতি কোনোরকম আকর্ষণই অনুভব করতেন না এলিনা। তবু তিনি বারবার প্রেমের প্রস্তাব এবং উপহার দিয়ে গিয়েছেন। অসুস্থ মেয়েটির পক্ষে ডাক্তারকে এড়িয়ে চলাও সম্ভব ছিল না। তাছাড়া এলিনাকে বাঁচিয়ে তুলতে সত্যিই নানা চেষ্টা করছিলেন কার্ল। সারাদিন কাটিয়ে দিতেন যক্ষ্মা সংক্রান্ত গবেষণায়। তবে বহু চেষ্টাতেও তাঁকে বাঁচানো গেল না।

এলিনার মৃত্যুর পর কার্ল স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই তাঁর জন্য একটি বিলাসবহুল মসোলিয়াম ভাড়া নেন। কার্লের এই কাজে খুশি হয়েছিল এলিনার পরিবারও। তবে কার্লের কাছে এটা নিছক পরপোকার ছিল না। কারণ এই মসোলিয়ামের একটি চাবি তিনি নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন। প্রথম প্রথম সেই মসোলিয়ামে দিনের একটা বড়ো সময় কাটাতেন কার্ল। এমনকি যদি কখনও সেখানে যেতে না পারেন, এই আশঙ্কায় মসোলিয়ামের মধ্যেই একটি টেলিফোন সেট বসিয়েছিলেন। যেন এলিনার মৃতদেহ উঠে এসে সেই ফোনে কথা বলবে।

আরও পড়ুন
প্রেমে প্রত্যাখ্যাত পুরুষদের জন্য কলকাতায় গড়ে উঠেছিল ‘জবাব ক্লাব’!

তবে এরপরেও মসোলিয়ামের দেয়ালের দূরত্ব অসহ্য লাগল কার্লের। তিনি হাসপাতালের পিছনে একটি পরিত্যক্ত যুদ্ধবিমান মেরামতির কাজ করছিলেন দীর্ঘদিন ধরে। একদিন সেই বিমানের মধ্যেই এনে তুললেন এলিনার দেহ। ততদিনে সেই দেহ ক্ষয়ে যেতে শুরু করেছে। কার্ল নানাভাবে দেহকে অবিকৃত রাখার চেষ্টা করলেন। প্লাস্টার অফ প্যারিস দিয়ে মুখ ঢেকে দিলেন। তার উপরে সিল্কের কাপড়ের চামড়া বসালেন। এলিনার নিজের চুল দিয়েই একটি উইগ বানিয়ে পরিয়ে দিলেন। এক সময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিমানটি সরাতে বলে। তখন এলিনার দেহটি নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন কার্ল।

আরও পড়ুন
প্রেমিককে বিবাহের জন্য রাজপরিবার ছাড়লেন জাপানের রাজকন্যা

এই ঘটনার বেশ কয়েক বছর পর এলিনার বোন নানার শরীরেও যক্ষ্মা ধরা পড়ে। আর তখনই শুরু হয় জটিলতা। শেষ পর্যন্ত নানাকে সব কথা জানাতে বাধ্য হন কার্ল। আর তারপরেই তাঁর বাড়িতে হানা দেয় পুলিশ। ঘর তল্লাশি করে এলিনার মৃতদেহও উদ্ধার করা হয়। সেটা ১৯৪০ সাল। বে-আইনিভাবে মৃতদেহ রেখে দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় কার্ল ট্যাঞ্জলারকে। ৭ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে বিচার প্রক্রিয়া। শেষ পর্যন্ত তাঁর মানসিক অবস্থার কথা ভেবেই বিচারক ৭ বছরের কারাদণ্ডের নির্দেশ দেন। যেহেতু ততদিনে তাঁর ৭ বছরের বেশি কারাবাস হয়ে গিয়েছে, তাই মুক্তি পান কার্ল। আর তারপর পাহাড়ি উপত্যকায় একটি বাড়ি কিনে একাই থাকতে শুরু করেন তিনি। প্রতিবেশীদের সঙ্গেও কথাবার্তা বলতেন না।

১৯৫২ সালে প্রতিবেশীরা হঠাৎ খেয়াল করলেন, তাঁরা অনেকদিন কার্লকে দেখতে পাননি। আবার তাঁর বাড়িতে পুলিশ হানা দিল। এবার তাঁরা আবিষ্কার করলেন খোদ কার্লের পচাগলা মৃতদেহ। আর সেইসঙ্গে একটি মোমের মূর্তি। কাঁচা হাতের তৈরি হলেও বেশ বোঝা যায়, সেই মূর্তি আসলে এলিনার। জীবনের শেষ দিনগুলোও এলিনার সঙ্গেই কাটিয়েছেন তিনি। আর টেবিলের উপর রাখা ছিল বেশ কয়েকটি নোটবুক। সেখানে নিজের জীবনী লিখে গিয়েছেন কার্ল। পরবর্তীকালে ডেভিড এল. স্যালোনের সম্পাদনায় সেই ডায়রি প্রকাশিত হয়।

কথায় বলে, প্রেমের কাছে মৃত্যুও বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। কার্ল ট্যাঞ্জলারের কাহিনি যেন সেই কথারই জলজ্যান্ত প্রমাণ।

Powered by Froala Editor

More From Author See More