প্রেমিকের অন্যত্র বিবাহ, ১৪ বছর অপেক্ষার শেষে কলকাতায় মিলন সুচারু-রামচন্দ্রের

দার্জিলিং শহরের বুকে হঠাৎ দেখা এক সদ্য যুবক ও এক কিশোরীর। একজন তো রাজপুত্র। আর অন্যজনও আভিজাত্যে সমানে টেক্কা দিতে পারেন। কিন্তু বংশের মানরক্ষার প্রতিযোগিতায় না গিয়ে দুজনেই দুজনকে ভালোবেসে ফেললেন। কয়েক সপ্তাহ থাকার পর দুজনেই ফিরে গেলেন নিজেদের ঠিকানায়। ছেলেটি তার বাবাকে জানাল তার বিয়ের ইচ্ছার কথা। রাজপরিবারে পাত্র স্বয়ং নিজের জন্য পাত্রী খুঁজে নেবে, এটা তেমন আশ্চর্যের কিছু নয়। কিন্তু বাধা হয়ে আছে দুজনের সম্প্রদায়। কেশবচন্দ্র সেনের মেয়ে সুচারু (Sucharu Devi)? সে যে ব্রাহ্ম! হিন্দু রাজপরিবারের সন্তান শ্রীরামচন্দ্র ভঞ্জ দেওয়ের (Sriram Chandra Bhanj Deo) সঙ্গে কী করে তাঁর বিয়ে হতে পারে?

হ্যাঁ, ব্রাহ্ম সমাজের কিংবদন্তি নেতা কেশবচন্দ্র সেনেরই কন্যা সুচারু দেবী। আর শ্রীরামচন্দ্র ভঞ্জ দেও ওড়িশার বিখ্যাত ভঞ্জ রাজপরিবারের ভাবী উত্তরাধিকারী। বিগত ১০ প্রজন্ম ধরে তাঁরা ওড়িশার শাসনভার সামলাচ্ছেন। এই বংশের নামেই নামকরণ ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলার। কেশবচন্দ্র সেন বিবাহে রাজি ছিলেন কিনা জানা যায়নি। তবে রামচন্দ্রের পরিবার রাজি হয়নি। পরিবারের কথা অগ্রাহ্য করে কলকাতায় ফিরেছিলেন রামচন্দ্র। কিন্তু হঠাৎই তাঁর মনের মধ্যে নানা দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয়। শেষ পর্যন্ত পরিবারের মত মেনে নিয়ে বিহারের এক রাজপরিবারের মেয়েকেই বিবাহ করেছিলেন তিনি। তবে রামচন্দ্র এবং সুচারুর প্রেমকাহিনি ইতিহাসে আরেকটা ব্যর্থ প্রেমের ইতিবৃত্ত হয়ে থাকেনি। নানা অজানা পথ ধরে প্রেম কীভাবে জায়গা করে নেয়, তার সন্ধান কতজনই বা রাখতে পারেন?

বিবাহের পর বেশ সুখেই দিন কাটছিল রামচন্দ্রের। একটি কন্যাসন্তানেরও জন্ম হয়। কিন্তু ১০ বছরের মাথায় স্ত্রী এবং কন্যা দুজনেই মারা যান। এই সময় একাকিত্ব আরো বেশি করে পেয়ে বসে রামচন্দ্রকে। আবারও মনের মধ্যে ফিরে আসে দার্জিলিং শহরের সেই দিনগুলি। প্রায় ১৪ বছর পর সুচারুর টানেই কলকাতায় পা রাখলেন রামচন্দ্র। একটি পার্টিতে দুজনের দেখাও হল আবার। রামচন্দ্র শুনলেন, সুচারু এখনও অবিবাহিত। ২৯ বছর বয়স তখন সুচারুর। উনিশ শতকের কলকাতায় এই বয়সে কোনো মেয়ের অবিবাহিত থাকা রীতিমতো আলোচনার বিষয় হয়ে উঠত। সুচারুর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। কিন্তু তিনি স্পষ্ট জানান, রামচন্দ্র ছাড়া আর কাউকেই বিয়ে করতে পারবেন না।

অন্যদিকে ছোটো মেয়ে সুনীতি দেবীর বিয়ে দিয়ে আরও নিন্দার মুখে পড়েছিলেন কেশবচন্দ্র। ব্রাহ্ম সমাজের নিয়ম অনুযায়ী ১৪ বছরের আগে কোনো মেয়ের বিয়ে দেওয়া যেত না। হিন্দু সমাজের মধ্যে বাল্যবিবাহের বাড়বাড়ন্ত বন্ধ করতেই এই নিয়ম চালু করেছিল ব্রাহ্ম সমাজ। কিন্তু সুনীতি দেবীর সঙ্গে যখন কোচবিহারের রাজার বিবাহ হয়, তখন তাঁর ১৪ বছর বয়স হতে মাত্র কয়েক মাস বাকি। স্বাভাবিকভাবেই ব্রাহ্ম সমাজ ছাড়তে হয় কেশবচন্দ্র সেনকে। পরে তিনি তৈরি করেছিলেন ‘নববিধান ব্রাহ্মসমাজ’। তবে সেই কাহিনি স্বতন্ত্র। কলকাতাতেই বিবাহ হল রামচন্দ্র এবং সুচারুদেবীর। কিন্তু তাঁকে কোনোদিন রাজবাড়িতে নিয়ে যেতে পারেননি রামচন্দ্র। হয়তো চাননি। কলকাতার উপকণ্ঠে রাজবাগ প্যালেস তৈরি করে সেখানেই থাকতেন তাঁরা। তবে নববধূর জন্য ময়ূরভঞ্জে নতুন একটি প্রাসাদও তৈরি করেছিলেন রামচন্দ্র। 

আরও পড়ুন
প্রেমের কাছে নতিস্বীকার বিশপের, ছাড়লেন গির্জাও

রাজবাড়ি ত্যাগ করলেও ময়ূরভঞ্জের রাজত্বের দায়িত্ব ছিল রামচন্দ্রের উপরেই। প্রজাবৎসল রাজাকে সম্মান করতেন সাধারণ মানুষও। আর রাজা নিজে কৃষকদের থেকে শুরু করে সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষদের উন্নতির কথা ভাবতেন সবসময়। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েই বিদেশে পরিচিত হয়েছিল ছৌ শিল্প। এছাড়া জামশেদজি টাটার সঙ্গে মিলে ময়ূরভঞ্জে একটি স্টিল-প্ল্যান্টও তৈরি করেছিলেন রামচন্দ্র। তিনি বুঝেছিলেন, স্বদেশি শিল্পায়ন ছাড়া এদেশের উন্নতি সম্ভব নয়।

আরও পড়ুন
পরীক্ষায় ফেল, ঘুরে দাঁড়িয়ে ঋতুজয়— বুদ্ধদেবের প্রেমকাহিনি হার মানায় উপন্যাসকেও

তবে রামচন্দ্র এবং সুচারুর দাম্পত্যের আয়ুও বেশিদিন ছিল না। বিয়ের মাত্র ১২ বছরের মাথায়, ১৯১২ সালে একদিন শিকারে গিয়ে হঠাৎই গুলিবিদ্ধ হন রামচন্দ্র। তবে কে গুলি করেছিল, সেটা জানা যায়নি। অনেকে সন্দেহ করেছিলেন সুচারুর ভাই নিজেই সম্পত্তি আত্মসাৎ করার লোভে গুলি চালিয়েছিল। প্রাথমিকভাবে শরীর থেকে গুলি বের করা হলেও কিছুদিনের মধ্যেই রক্তে বিষক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে। কলকাতায় যখন তাঁকে আনা হল, তখন সেপটিসেমিয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। তবে রামচন্দ্রের মৃত্যুর পরেও রাজপরিবারের যাবতীয় দায়িত্ব একা হাতে সামলেছিলেন সুচারু দেবী। সঙ্গে একমাত্র সন্তান প্রতাপকে প্রতিপালনের দায়িত্বও তাঁর উপর। সবটাই দক্ষ হাতে সামলেছিলেন সুচারু দেবী। বিশ শতকের প্রথমভাগে একজন বাঙালি নারীর এই ব্যক্তিত্ব যে মুগ্ধ করেছিল খোদ রবীন্দ্রনাথকেও।

আরও পড়ুন
প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ১৩০ জনকে খুন করেছেন এই সিরিয়াল কিলার!

তথ্যসূত্রঃ
১. A Royal Story of Love and Second Chances, Live History India
২. The romantic story behind Odisha's Belgadia Palace, The Telegraph

Powered by Froala Editor

More From Author See More