উদয়শঙ্করের প্রশাসনিক ব্যর্থতার খবর পৌঁছল বিদেশে

শঙ্কর সরণি - ৪৮
আগের পর্বে

উদয়শঙ্করের নৃত্যের যাত্রার শুরু থেকেই ছিলেন সিমকি। তখনও উদয়ের দল তৈরি হয়নি। এরপর দল তৈরি হয়। আলমোড়ায় অ্যাকাডেমি তৈরি হয়। শারীরিক অসুস্থতার জন্য আলমোড়ায় আসতে পারেননি সিমকি। এদিকে ইউরোপে তখন বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে। প্যারিসে এডি নামে একজনকে বিয়ে করলেন সিমকি। আলমোড়ায় আসতে চাইলেন। কিন্তু উদয় যথেষ্ট আগ্রহী হলেন না। এই সময় থেকেই শুরু হল নানারকম অশান্তি। এমনকি হাসিখুশি সিমকি একসময় সহ্য করতে পারলেন না অমলাকেও। একদিন সকলের সামনে অমলার গায়ে হাত তুললেন। অন্যদিকে এডির নেশাসক্তির কারণে তাঁদের সম্পর্ক ভেঙে গিয়েছে। আলমোড়ার অ্যাকাডেমির প্রভাত গাঙ্গুলিকে বিয়ে করেছেন সিমকি। একদিন উদয়ের অ্যাকাডেমি ছেড়ে বম্বে চলে গেলেন সিমকি এবং প্রভাত। অবশ্য পরে সমস্তকিছু থেকেই বিদায় নিয়েছিলেন সিমকি। এমনকি নৃত্যের টানেও ফিরে আসেননি।

‘উদয়শঙ্কর ইন্ডিয়া কালচারাল সেন্টার’ কেন ভেঙে গেল, এ প্রশ্নটা দুরূহ। ভারতবর্ষের তাবৎ ওস্তাদরা এসে জড়ো হলেন আলমোড়ায়, এলেন প্রতিভাবান, গুণী, দক্ষ, উৎসাহী সব ছেলেমেয়েরাও। আছেন স্বয়ং ভুবনবিখ্যাত দলপতি, প্রতিষ্ঠাতা উদয়শঙ্কর। তবু ভেঙে গেল সব। সংঘবদ্ধভাবে শিল্পসৃষ্টির তাগিদ, ভরপুর উদ্দীপনা, নিয়মানুবর্তিতা, জীবনচর্চা, সম্পর্ক-পালন অল্প সময়ের ভেতরেই ক্ষয়ে এল সব। অভ্যন্তরিণ সমস্যা আর বাহ্যিক সংকট যেন মাথা চাড়া দিল পাল্লা দিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে বিদেশের অনুদান কমে এল। যুদ্ধে সরকার সমস্ত গাড়ি অধিকার করে নিল সেন্টারের। কাঠগোদাম আলমোড়া থেকে পঁচানব্বুই মাইল দূরে। এই পরিস্থিতিতে খাবার এসে পৌঁছত না প্রয়োজনমতো। মূল লোকালয় থেকে বহুদূরে সেন্টার হওয়ার কারণে এসে পৌঁছতে পারত না, ছেলেমেয়েরাও। আরো একটা সমস্যা তৈরি হয়েছিল আগেই। সেন্টারে যেহেতু প্রথাগত পড়াশোনার কোনো বন্দোবস্ত ছিল না, বা বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে যুক্ত করা হয়নি কোনো স্কুলকেও, সেহেতু কমবয়সী ছেলেমেয়েরা চাইলেও, ভাবতে পারত না সেন্টারে যোগ দেওয়ার কথা। এইসব কারণেই সেন্টার সরিয়ে দেশের অন্য কোনো জায়গায় গড়ে তোলা যায় কি না, পরিকল্পনা  চলছিল তারও, সফল হয়নি সেসব উদ্যোগ।

তবে এইসব সমস্যার নিগূঢ় দিকটির হদিশ পাওয়া যায়, ২৯ মার্চ ১৯৪৪-এ, বিয়াত্রিচেকে লেখা উদয়শঙ্করের একটি চিঠিতে। এই চিঠি  ব্যক্তিগত নয়, বরং কর্তৃপক্ষ বা ট্রাস্টি বা অনুদানকারীর কাছে তাঁর জবাব পেশ। এই চিঠির কপি পাঠানো হয়েছিল এলমহার্স্টকেও। উদয়শঙ্করের প্রশাসনিক ব্যর্থতা, পক্ষপাতিত্ব, সেন্টারের নিয়ম-উল্লঙ্ঘন প্রভৃতি নানা বিষয়ে এলমহার্স্টদের কাছে পৌঁছেছিল অভিযোগ। বার্তা এসেছিল, এরপর তাঁদের তরফ থেকে আলমোড়ার সেন্টার পাবে না কোনোরকম অনুদান। আত্মপক্ষ সমর্থনে বাধ্যত উদয়শঙ্করকে ধরতে হল কলম। তবে এই তির্যক পরিস্থিতিতেও চিঠিতে উদয়ের শান্ত আচরণ, কৃতজ্ঞতাবোধ মুগ্ধ করে পাঠককে। চিঠি শেষ করার আগে অকৃত্রিমচিত্তে তিনি স্বীকার করলেন তাঁর কলাকেন্দ্রের জন্য এলমহার্স্টদের মহৎ অবদানের কথা। জানালেন, কী পরিস্থিতিতে তাঁরা টাকা পাঠাতে না-পারার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা অনুভব করেন তিনি। 

বশি সেন ও গার্টরুট এমার্সন।

 

বিশিষ্ট কৃষিতত্ত্ববিদ বশীশ্বর সেন (১৮৮৭- ১৯৭১) অধিক পরিচিত ছিলেন বশি সেন নামেই। ভারতের সবুজ বিপ্লবের অন্যতম কাণ্ডারী এই মানুষটিকে পঞ্চাশের মন্বন্তর স্পর্শ করেছিল গভীরভাবে। তিনি বিবাহ করেন মার্কিন লেখক ও এশিয়া- বিশেষজ্ঞ গার্টরুট এমার্সনকে (১৮৮০- ১৯৮২)। ‘এশিয়া’ পত্রিকা সম্পাদনা করতেন গার্টরুট। ভারতবর্ষ আর তার সংস্কৃতি বিষয়ে তিনি চিন্তা করেছিলেন গভীরভাবে। এই দেশ সম্পর্কিত তাঁর দুটি উল্লেখযোগ্য বই ‘Voiceless India’(১৯৩০), ‘Pageant of India’s History’ (১৯৪৮)। বশি ছিলেন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর অত্যন্ত প্রিয় ছাত্র। ছিলেন বিবেকানন্দেরও অনুগামী। আলমোড়ায় তিনি বিবেকানন্দ গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করেন। রবীন্দ্রনাথেরও অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন বশি। ১৯৫৭ সালে তাঁকে সম্মানিত করা হয় ‘পদ্মভূষণ’-এ। বশি-গার্টরুট দুজনেই বন্ধু ছিলেন এলমহার্স্ট পরিবারের। উদয়শঙ্করের আলমোড়া সেন্টারের পরিচালন সমিতিতেও যুক্ত ছিলেন তাঁরা। ফলত সেন্টার সংক্রান্ত খবরাখবর সেন-দম্পতি মারফতও পৌঁছত বিয়াত্রিচে, ডরোথি এবং এলমহার্স্টের কাছে। বশি বা গার্টরুট এমার্সনের সঙ্গে উদয়শঙ্করের সম্পর্ক সহজ ও অমলিন ছিল না।  

আরও পড়ুন
অমলার গায়ে হাত তুললেন সিমকি

৯ অগাস্ট ১৯৩৯-এ জোহরাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি চিঠি লেখেন বিয়াত্রিচে। নিজের জীবনের এক শঙ্খিল সময়ে তখন দাঁড়িয়ে তিনি। উদয়ের সঙ্গে নিজের সম্বন্ধ নিয়ে তীব্র সংশয়াপন্ন। উদয় রয়েছেন ভিন দেশে। শুধু স্থানগত দূরত্বেই নয়, প্রেমের স্বীকরণেও উদয় দাঁড়িয়ে রয়েছেন অলঙ্ঘনীয় এক ব্যবধানে। সেইসময়  স্যামি এলেন তাঁর জীবনে। প্রথম-প্রথম স্যামির কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে চাইলেন বিয়াত্রিচে। কিন্তু পরে নিলেন এক ভিন্নতর সিদ্ধান্ত। একজনের সঙ্গে মুহূর্তযাপনের সময় যদি অন্যজন বিধৃত হয়ে থাকে বোধ আর স্মৃতির ভেতর, তবে কী ভীষণ অন্যায় তা উভয়ের প্রতিই। বিয়াত্রিচে স্থির করলেন, উদয় এবং স্যামি, সমান্তরালভাবে সূদূরবর্তী আর অদূরবর্তী দুটি পুরুষের সঙ্গে সম্বন্ধ-চারণে তিনি পরখ করবেন তাঁর গভীর আর প্রগাঢ় প্রেমটিকে। ভারতীয়-বিন্যাসে অদ্ভুত ঠেকতে পারে এমন নিরীক্ষা। কিন্তু নিজের সামাজিক আরোপিত মূল্যবোধের চেয়েও নিজের সুগভীর অন্তস্থলে যিনি থাকতে চান সৎ এবং স্বচ্ছ, সেই অ-কপটতা আমাদের আশ্চর্য করে বই কি? 

আরও পড়ুন
বিয়ের আড়াই ঘন্টা আগেও উদয় চিঠি লিখলেন অমলাকে  

ডরোথি ও লেনার্ড এলমহার্স্ট

 

আরও পড়ুন
অমলার অনুভূতিলোকে সেদিন নামল প্রথম আষাঢ়

সেই চিঠিতেই কথাসূত্রে জানিয়েছিলেন বিয়াত্রিচে, ‘আমি আবার ভারতে যেতে চাই, আর যদিও উদয় হয়তো আমাকে আর চায় না বা ভালোবাসে না, তবুও আমি জানতে পারব আমার হৃদয়ের কথা…’। অতঃপর শুরু হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ভারতে আসা সম্ভব হল না তাঁর পক্ষে। ১৯৪২-এ উদয় বিবাহ করলেন অমলাকে। অমলাশঙ্কর জানিয়েছিলেন, বিয়াত্রিচের সঙ্গে উদয়ের সম্পর্ক যে লাভ করতে পারেনি সুনির্দিষ্ট পরিণতি, তাতে নিরাশ হয়েছিলেন সেন দম্পতি। এমনকি বিয়াত্রিচের সঙ্গে বিবাহসম্বন্ধ হলে, বিষয়টা কেমন যথাযথ মাত্রা পেত এবং বিঘ্নিত হত না উদয়ের আর্থিক সাচ্ছল্য, সেই বিষয়েও গোপন করতেন না নিজেদের মনোভাব। উল্টোদিকে উদয়ের জীবনে অমলার প্রবেশ যে কী প্রকার হতাশাজনক, সংকোচবোধ করতেন না সেই ধারণা পোষণেও। দুঃখ পেয়ে অমলা একবার নিভৃতে জানতে চেয়েছিলেন তাঁর স্বামীর কাছে, এত সব ভালো, সুন্দর মেয়ে থাকতে কোথাকার একটা কালো, গেঁয়ো মেয়েকে কী করে পছন্দ করলেন তিনি? স্ত্রীর দুঃখের কারণ অজ্ঞাত ছিল না উদয়ের কাছে। ভালোবেসে স্ত্রীর মনকে ফেরাতেন শুশ্রূষায়, বলতেন, সাত সমুদ্র তেরো নদীর জল খেয়েছি, আমার গঙ্গাজলই ভালো।

আরও পড়ুন
লক্ষ্মীশঙ্করের গান শুনে ঘুমিয়ে পড়লেন নেহরু

২৯ মার্চ ১৯৪৪-এ বিয়াত্রিচেকে লেখা উদয়ের চিঠিতেও ধরা পড়ল সেন দম্পতির সঙ্গে এই সম্পর্কের অস্বস্তি। এক জায়গায় লিখলেন উদয়শঙ্কর, ‘বশি এবং গার্টরুটকে এই নিয়ে অনেকবার আমরা বলেওছি, আর ওদের সম্বন্ধে তোমাকে কিছু লিখতেও আমি চাইনি। ওরা তো তোমার বন্ধু, এমনকি আমারও। কিন্তু ওরা যদি তোমাকে আমার বিষয়ে লিখে থাকে, তা হলে আমারই বা তোমাকে সব কিছু খোলাখুলি জানাতে আপত্তি কোথায়…’। সেন্টার বন্ধের কারণের সাপেক্ষে উদয়শঙ্করের বক্তব্যকে বুঝতে চেয়ে এই দীর্ঘ চিঠিকেই আমরা পড়তে চাইব সবিস্তার।

সিমকি

 

চিঠির শুরুতেই  উদয়শঙ্কর জানালেন, এইসময় তাঁর শেষ ট্যুর অর্জন করেছে প্রভূত সাফল্য। সাড়া জাগিয়েছে তাঁর শ্যাডো প্লে। অল ইন্ডিয়া রেকর্ড করেছে বম্বেতে তাঁদের অনুষ্ঠানের আয় । কিন্তু তাতেও সঞ্চয় হল সামান্য, মাত্র পঁচিশ হাজার টাকা। চুয়াল্লিশ জনের গ্রুপে, আঠারো জন ছাত্র। ব্যয়ভার তো ছিলই, লাঘব হয়নি ট্রেনভাড়াও। প্রসঙ্গসূত্রে উদয় ব্যাখ্যা করলেন ছাত্রদের নিয়ে ট্যুর করার বিষয়ে একটি দরকারি পর্যবেক্ষণে। ট্যুরের সময়েই ছাত্ররা, জীবনে প্রথম সম্মুখীন হয় দর্শকদের বিপুল উচ্ছ্বাসের। আর আকস্মিক সেই প্রাপ্তি, নাড়িয়ে দেয় তাদের ভেতরের সামঞ্জস্যকে। উদয়ের দেওয়া স্বাধীনতা আর দর্শকের অপরিমেয় প্রশংসায় অবিলম্বে তারা হয়ে ওঠে অবাধ্য। তাই ভ্রমণের পর সকলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা সমীচীন বোধ করেননি তিনি।

চিঠির পরবর্তী ধাপে উদয় লিখলেন নিজের কথা। বললেন, বিয়াত্রিচের কাছ থেকে পাওয়া শেষ চিঠি থেকে তিনি অনুমান করতে পারেন উদয় সম্পর্কিত কোন ধারণা পৌঁছেছে তাঁর কাছে। ‘স্বৈরাচারী’, ‘তুচ্ছ-বিষয়ে-মাথা-ঘামানো’, ‘গোষ্ঠীর সদস্যদের এবং ছাত্রদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলা’, উদয়শঙ্কর লিখলেন, ‘এ সব অভিযোগের সঙ্গে আমি সুপরিচিত এবং তা বশি ও গার্টরুট বহুবার ব্যবহার করেছে। অতএব অন্য কিছু বলার আগে এর কৈফিয়তটাই দিই।’ জোহরা এবং সিমকির সেন্টার ত্যাগের বিষয়টি নিয়েও উদয় জানালেন বশি দোষী সাব্যস্ত করেন তাঁকে। সেই অভিযোগের নিরিখে উদয় পেশ করলেন তাঁর বক্তব্য। জানালেন, একসময় জোহরার হাবভাব অত্যন্ত দৃষ্টিকটু হয়ে ওঠে, তা নিয়ে কেলেঙ্কারিও হয়। শেষে সেন্টারের এক ছাত্রকে [কামেশ্বর সেহগল] বিয়ে করে জোহরা। ক্রমে সেই ছাত্র এতই অবাধ্য হয়ে ওঠে যে, অসম্ভব হয়ে পড়ে তাকে সেন্টারে রাখা। বাধ্যত সেন্টার ছেড়ে চলে যেতে হয় জোহরাকেও। সিমকি প্রসঙ্গে উদয় জানালেন অন্যতর এক সংকটের কথা। সিমকির দীর্ঘ অসুস্থতা, দেশের চরম দুর্দশায় নিয়মিত মায়ের খবর এসে না পৌঁছনোর দুশ্চিন্তা তাঁকে ভেঙে দিয়েছিল মানসিকভাবে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল অন্য অ-সুখও। তাঁকে ভর করেছিল তীব্র ঈর্ষাকাতরতা।  

বিয়াত্রিচে

 

দীর্ঘদিন উদয়ের সঙ্গে একা শিল্পভ্রমণে অভ্যস্ত হওয়ায়, পরে ট্রুপে কারোর কোনওরকম সম্ভাবনা থাকলে অসন্তুষ্ট হতেন সিমকি। ভুগতেন হীনমন্যতায়। ইয়োরোপে থাকতে জোহরার প্রতি এবং উদয়ের বিবাহের পর অমলার প্রতি প্রকাশ পেত সেই ক্রোধ। একথা জানিয়ে উদয় লিখলেন, উদয়ের বিবাহের অল্পদিন পরেই বিবাহ করেন সিমকি। কিন্তু অত্যন্ত ভদ্র ও কাজের সেই ছেলেটি [প্রভাত গাঙ্গুলি] বদলে গেল বিয়ের পর। এই দুর্বিপাক উদয় যথাসাধ্য এড়াতে চাইলেও সেন্টারে ইস্তফা দেয় সিমকি ও তাঁর স্বামী। উদয় আরো লিখলেন, অনুষ্ঠানে একটি নতুন ব্যালেতে নেওয়া হয় সিমকিকে। অন্য একটি পরিবেশনায় দ্বৈত নৃত্যাংশে ছিলেন অমলা আর উদয়। অথচ তাও অসন্তুষ্ট হলেন সিমকি। কী করুণভাবে উদয় জানালেন, ‘কিন্তু আমি যে ইচ্ছে করে সিমকে আড়ালে ঠেলে দিতে চাইনি সেটা তুমি বুঝতেই পারবে কারণ এই এত বছরে আমি নিজের জন্য একটিও একক নৃত্য রচনা করিনি…’। হায় রে মানবজীবন! কোন উচ্চাঙ্গে বাঁধা হয়েছিল আলমোড়ায় জীবনচর্যার তার, আর কোন ক্লিন্ন ধারায় বইল সেই অববাহিকা!

চিঠিতে এবার উদয় এলেন, ‘তুচ্ছ- বিষয়ে-মাথা-ঘামানোর’ প্রসঙ্গটিতে। জানালেন, কাজে ও প্রশাসনে তিনি পছন্দ করেন নিয়মানুবর্তিতা। সেই অভ্যাসই নির্মাণ করে একটি প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ। সেন্টারে সদস্য ও ছাত্রদের জীবনযাত্রা, শহরে পরিচিতদের কাছে যাতায়াত, ঘরদোর পরিষ্কার রাখা, পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ, মেস-এ আচরণবিধি ইত্যাদি সবকিছুই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তাঁর কাছে। অথচ এগুলিকেই চিহ্নিত করার চেষ্টা হচ্ছে ‘তুচ্ছ ব্যাপার’ বলে। উদয় এলেন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গে। বললেন, আগে ট্যুরে যেসব সদস্যরা অনেক স্বাধীনভাবে থেকেছেন, এই নিয়মানুবর্তিতা তাঁদের কাছে কষ্টকর ঠেকছে। এখন সেন্টারের আদর্শের সঙ্গে তাঁদের চিন্তাধারা আর দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের বিষয়টি প্রয়োগ করতে গেলে তাঁদের কাছে বিরক্তিকর হয়ে উঠছে সবটা। শুধু সমস্যা ব্যক্ত করাই নয়, সমস্যার সম্ভাব্য কারণগুলিও খুঁজতে চেয়েছিলেন উদয়। আলমোড়ার জীবন মূলসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন সর্বতোভাবে, সমস্ত রকম বিনোদন-বর্জিত এক জীবন। মনস্তাত্ত্বিক প্রেক্ষিতে দেখলে, তাই, এ আচরণ হয়তো ততটা অস্বাভাবিক নয়। সেই কারণেই তিনি মনে করেন সেন্টার সরিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত অন্যত্র।

কামেশ্বর সেহগাল ও জোহরা সেহগাল

 

উদয় লিখলেন, এতদসত্ত্বেও উদয় উপভোগ করছেন এ সময়ের যাবতীয় কাজ। অর্জন করছেন অভিজ্ঞতা। অতি উৎসাহে স্থানকালের সীমা বিবেচনা  করেননি তিনি। যতটা সম্ভব তার থেকেও বড়ো কাজে হাত দিয়ে ভুলও করেছেন অনেক। কত সময়ে তিনি উত্তেজিত হয়েছেন। কখনও তাঁকে ভুল বোঝা হয়েছে। সমস্ত সুযোগ-সুবিধা আদায় করছেন তাঁর স্ত্রী, এই দোষারোপ করা হয়েছে অমলাকে। দুশ্চিন্তায় রাতের পর রাত জেগে থেকেছেন তিনি। সিমকির প্রভাবে অমলার সহজ মানিয়ে নেওয়ার ইচ্ছেটিকেও ব্যাখ্যা করা হয়েছে তির্যকভাবে। একবার অবিশ্বাসের বীজ চারিয়ে গেলে অসম্ভব হয়ে পড়ে সব কিছু। তবুও দলপতির ভূমিকায় নিরাসক্ত দূরত্ব থেকেও সবটা ভাবতে চাইলেন তিনি। বললেন, ‘বহির্জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এত কাছাকাছি থাকাটাই এই সমস্যার জন্য অনেকটা দায়ী’। সেন্টার যদি বম্বের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়, শিল্পীরা যাপন করতে পারবেন নিজেদের পৃথক ব্যক্তিগত জীবন। তাহলে ‘তুচ্ছ’ বিষয়গুলি নিয়েও ভাবনাচিন্তার অবসর থাকবে না আর। শেষ বাক্যে এবার অভিমানী শোনায় উদয়ের গলা।

এইসব অভাব-অভিযোগের ভেতরও উদয় রয়েছেন  শান্ত, ভরপুর স্নেহমাধুর্যে পরিপূর্ণ এক পারিবারিক জীবনে। তার ছাপ রইল শেষকথায়। অমলা ও তাঁর তরফ থেকে বিয়াত্রিচে আর তাঁর তখনকার সঙ্গী লুইকে পাঠালেন ভালোবাসা। চিঠির সঙ্গে বিয়াত্রিচেকে আগের ট্যুরের কাটিং প্রভৃতির সঙ্গে পাঠালেন তাঁর পুত্র আনন্দর একটি ছবিও। তারপর লিখলেন, ভারি মিষ্টি হয়েছে... ‘ও সারাক্ষণ খেলে বেড়াতে ভালোবাসে, আর মাঝে মাঝে হাত ঘুরিয়ে নাচার ইচ্ছে প্রকাশ করে’। তারপর কী করুণ শোনাল ভারতীয় আধুনিক নৃত্যের জনক উদয়শঙ্করের কণ্ঠস্বর। বললেন, ‘কিন্তু আমি চাই না যে ও নৃত্যশিল্পী হয়— নাচের জীবনটা ঠিক তেমন সুখকর নয়!’

Powered by Froala Editor