মৃত্যুতেও একই কবরে শুয়ে তাঁরা; বিশ্বযুদ্ধ ও দুই পুরুষের রূপকথার প্রেম

রোমানিয়ার ভেতর চলতে চলতে হঠাৎই এসে পড়া ট্রানসিলভ্যানিয়ায়। এই সেই শহর, যেখানে নাকি বাস করত ভয়ংকর ‘ড্রাকুলা’। তার ভেতরেই সিঘিসোয়ারায় রয়েছে একটি কবরস্থান। সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছোটো ছোটো পাথরের স্তূপ। বরফ, বৃষ্টি আর স্মৃতির ভারে খানিক কালো হয়ে গেছে সেসব। সেই মৃতদের স্তূপের ভেতর ঘুরতে ঘুরতে সামনে এল একটি বিশেষ পাথর। বাকিদের থেকে কোনো অংশে আলাদা নয়। কিন্তু ফলকটির দিকে চোখ রাখলেই বিস্ময়! ওর নিচে যে সমাধিটি রয়েছে, সেখানে একজন নয়; দু’জন মানুষ শেষ স্বপ্নের অপেক্ষায় শুয়ে আছেন। দুজনেই পুরুষ, দুজনেই সৈন্য— দুজনেই প্রেমিক…

গুইলেম ক্লুয়া নামের এক স্প্যানিশ লেখকের হাত ধরেই উঠে এসেছে এই অদ্ভুত আখ্যান। ট্রানসিলভ্যানিয়ার কবরস্থানে, একই কবরে, নীরবে শুয়ে আছেন দুই মানুষ। একসময় পরস্পরের হাত ধরতে চেয়েছিলেন, সমস্ত বিপদের ঊর্ধ্বে উঠে স্বপ্ন দেখতে চেয়েছিলেন। সমাজ মেনে নেবে না দুই পুরুষের ভালোবাসা; কিন্তু তাঁরা কি থেমে থাকবেন? এইভাবেই যুদ্ধক্ষেত্রের ভেতরেই বেড়ে উঠছিল গোলাপ। বেড়ে উঠছিল এক অন্য রকম প্রেমের গল্প। মৃত্যুর পরও যে ঢেউ তাঁদের ছেড়ে যায়নি। একই মাটির নিচে স্বপ্নের বিছানা বুনছেন এমিল মুলার এবং জেভার সুমের… 

সময়টা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। মানবসভ্যতা মুখোমুখি হল এক বিশাল ধ্বংসলীলার। বিশ্বের তাবড় দেশগুলো সমস্ত অস্ত্র নিয়ে নামল রণাঙ্গনে। এমন মারণযুদ্ধ এর আগে কেউ দেখেনি। হাজার হাজার মানুষের দেহ পড়ে রয়েছে মাটির ওপর। বাড়ি পুড়ছে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে নালা। তারই মাঝে হাজির হলেন এমিল মুলার এবং জেভার সুমের। দুজনের হাতেই বন্দুক, পরনে সমর পোশাক। রণাঙ্গনে এসেই পরস্পরের সঙ্গে হয়তো আলাপ হয়েছিল। তারপর সেই আগুনের মধ্যেই তৈরি হল বন্ধুত্ব। একটা সময় পর এমিল আর জেভার কিছু একটা অনুভব করলেন। এই অনুভব কেবল বন্ধুত্বের গণ্ডিতেই আটকে নেই। বরং ঢেউ ছাপিয়ে নৌকা এগিয়ে চলল অনন্তের দিকে। একে অপরের দিকে চোখ রেখে, হাতে হাত রাখলেন এমিল আর জেভার। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বুকেই জন্ম নিল ‘অন্য প্রেমের গল্প’। 

পঞ্চাশের দশকে সমকামী হওয়ার ‘অপরাধে শাস্তি’ দেওয়া হয়েছিল বিজ্ঞানী অ্যালান টুরিং-কে। তখন বিশ্ব ভুলেই গেল তাঁর অবদানের কথা। এই কাহিনি তো আরও বেশ কয়েক বছর আগের। বাধানিষেধ তখনও বেশ তীব্র। সমকামী মানুষদের প্রতি এক বৈষম্যমূলক আচরণ করা হচ্ছে সব জায়গায়। কিন্তু ভালোবাসা কি এত গণ্ডি মানে? এমিল আর জেভারের মনেও কি সংশয় আসেনি? হয়তো এসেছিল। কিন্তু সবকিছু এড়িয়ে ভালোবাসার সেই সুন্দর রাস্তাই বেছে নিয়েছিলেন। যুদ্ধ করার ফাঁকে জেভার একটি ছবিও এঁকেছিলেন— ‘এমিল’স রুম’। ওই যে দূরে দেখা যাচ্ছে হলুদ ঘরটি, পাশে বিমর্ষ জানলা। মনের ভেতরে সেই জানলার ধারেই এসে বসতেন দুজনে… 

এই কাহিনির ভেতর দিয়ে হাঁটার সময় অনেক তথ্য খোঁজার চেষ্টা করছিলেন গুইলেম ক্লুয়া। এমিল আর জেভারের ব্যাপারে আরেকটু যদি জানা যেত! কেমন ছিল যুদ্ধক্ষেত্রের দিনগুলো? না, সেরকম কিছুই পাওয়া যায়নি। কবরস্থানের ফলকের শরীর থেকে পাওয়া গেছে শেষের দিনটি। এমিল মুলারই আগে চলে গিয়েছিলেন, ১৯১৬ সালে। তার এক বছর পরেই, ১৯১৭ সালে যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুপক্ষের আঘাতে নিহত হন জেভার সুমের। পরে যুদ্ধক্ষেত্র থেকেই উদ্ধার করা হয় ক্ষতবিক্ষত দেহদুটি। তাঁদের সঙ্গী যোদ্ধারা কি দুজনের ভালোবাসার কথা জানত? না, সেই খবর কেউ রাখেনি… 

বহু বছর পর ট্রানসিলভ্যানিয়ার কবরস্থানে, পড়ে থাকা বাদামি পাতা আর বরফের ভিড়ে তাঁদের খুঁজে পাওয়া গেল। মৃত্যুর পরও দুই প্রেমিক একসঙ্গে, এক মঞ্চে। পাশাপাশি শুয়ে নতুন, সুন্দর এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখছেন এমিল-জেভার। বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গন দেখেছিল এক রামধনুর অধ্যায়, এক নিভে যাওয়া প্রেমের গল্প। আর আজ, একান্ত নীরবে দিন কাটছে তাঁদের… 

আরও পড়ুন
রণক্ষেত্রে মুখোমুখি আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজান, প্রবল হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা

তথ্যসূত্র-
১) ‘Untold love story of two World War I soldiers buried together is beautiful’, Anya Crittenton, Gay Star News
২) ‘This love story between two gay World War I soldiers will end you’, Rachel Kiley, Pride        

Powered by Froala Editor

More From Author See More