৩০০ পুরুষের হত্যার পিছনে এক নারী, হাঙ্গেরির সুজানার সঙ্গে জড়িয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধও

হাঙ্গেরি। দানিউব নদী তীরবর্তী এক দেশ। এই দেশেরই ছোট্ট এক গ্রাম নাগিরেভ। গ্রামের পুরুষরা সারাদিন পরিশ্রম করে ফসল ফলায়। কেউ গম কেউ বা সূর্যমুখী ফুল। মহিলাদের নিস্তরঙ্গ জীবন। আপাত দৃষ্টিতে বিশ্বের আর পাঁচটা গ্রামের সঙ্গে কোনো তফাত খুঁজে পাওয়া যাবে না এই গ্রামটির। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই দেখা যাবে হাঙ্গেরির নিতান্ত অখ্যাত এই গ্রামের প্রতিটি পায়ে পায়ে জড়িয়ে আছে ইতিহাস। যদিও সেই ইতিহাস নিঃশব্দ মৃত্যুর ইতিহাস, চরম কলঙ্কের ইতিহাস।

সালটা ১৯১৮। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগুন তখনও এদিকওদিক ধিকিধিকি জ্বলছে। বাতাসে বারুদের গন্ধ তখনও পুরোপুরি মিলিয়ে যায়নি। ১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই অস্ট্রিয়া, রাজকুমার ফার্দিনান্দকে হত্যার অভিযোগে সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল, তারপর থেকে পরবর্তী চার বছরে হাজার হাজার গ্যালন জল বয়ে গেছে দানিউব নদীর উপর দিয়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আঁচ এসে পড়েছে হাঙ্গেরির ছোট্ট গ্রাম নাগিরেভেও। 

নাগিরেভে মূলত পরাজিত সৈনিকের যুদ্ধবন্দি হিসেবে আটকে রাখত হাঙ্গেরির সেনাবাহিনী। একসময় যুদ্ধে কেন্দ্রীয় শক্তির অবস্থা ক্রমাগত খারাপ হতে থাকে। অধিকৃত অঞ্চলগুলো হাতছাড়া হতে লাগল তাদের। জরুরি অবস্থায় হাঙ্গেরির সমস্ত পুরুষদের সৈন্যবাহিনীতে যোগদান বাধ্যতামূলক করল। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই হাঙ্গেরির অন্যান্য অঞ্চলের পুরুষদের মতোই নাগেরিভ গ্রামের পুরুষ অধিবাসীদের চিরাচরিত কৃষিকাজ ছেড়ে যোগ দিতে হল সৈন্যবাহিনীতে। নাগেরিভ হয়ে পড়ল পুরুষশূন্য। অন্যদিকে ভৌগোলিকভাবে অবস্থানগত সুবিধা থাকায় কিছুদিনের মধ্যেই নাগেরিভ গ্রামে ঘাঁটি তৈরি করল হাঙ্গেরির সৈন্যবাহিনী। নাগেরিভের প্রায় প্রত্যেকটি পুরুষ তখন হাঙ্গেরির হয়ে সীমান্তে যুদ্ধরত। পুরুষদের অনুপস্থিতির সুযোগে নাগেরিভ গ্রামের অধিকাংশ মহিলার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠল হাঙ্গেরির সৈন্যবাহিনীর বেশ কিছু সদস্যের। যার ফলশ্রুতি ছিল মারাত্মক। কিছুদিনের মধ্যেই গর্ভবতী হয়ে পড়লেন গ্রামের বেশ কিছু মহিলা। 

সুজানা ফাজেকাস - নামটির সঙ্গে আমরা হয়তো তেমনভাবে কেউই তেমন পরিচিত নই। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন হাঙ্গেরির নাগেরিভ গ্রামের সমস্ত পুরুষদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে উঠেছিলেন এই মহিলা।  সুজানা ফাজেকাস এবং জুলিয়াস ফাজেকাস ছিলেন সুখী দম্পতি।  সুজানাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন জুলিয়াস। প্রেমের প্রথম দিনটি থেকে সুজানা ছিলেন আগাগোড়া রহস্যে মোড়া। আর সুজানার এই অপার রহস্যময়তায় আরও আকৃষ্ট করে ফেলত জুলিয়াসকে। বিবাহিত জীবনের প্রথম কয়েকটা বছর খুব ভালোই কেটেছিল ফাজেকাস দম্পতির। এরপর ১৯১১ সালে নাগিরেভ গ্রামে চলে আসেন তাঁরা। আর এর পরেই ঘটতে শুরু করে একের পর এক বিপর্যয়। নাগিরেভে আসার কিছুদিনের মধ্যেই হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যান সুজানার স্বামী জুলিয়াস। গ্রামের লোক সন্দেহ করতে শুরু করে, জুলিয়াসের এই হঠাৎ হারিয়ে যাওয়ার পেছনে সুজানা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। 

আরও পড়ুন
বিশ্বযুদ্ধের শেষতম বিচারে কারাদণ্ড ৯৩ বছরের নাৎসি বৃদ্ধের; জড়িয়ে ছিলেন ইহুদি হত্যায়

না, নাগিরেভের বিপর্যয় এখানেই থেমে থাকেনি। ইতিমধ্যে নাগিরেভের অধিবাসী যুদ্ধে যোগদানকারী প্রায় সকল পুরুষ গ্রামে ফিরে আসতে থাকে। আর গ্রামে ফিরে আসা অধিকাংশ পুরুষেরই মৃত্যু ঘটে আকস্মিকভাবে। হাজার চেষ্টার পরেও এই মৃত্যুর রহস্যের কিনারা হয় না। হাঙ্গেরির দুঁদে গোয়েন্দারা পর্যন্ত হতাশ করলেন। যদিও বহু চেষ্টার পর শেষপর্যন্ত অপরাধী পুলিশের জালে ধরা পড়ল। তদন্ত শেষে পুলিশের হাতে উঠে আসে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য।  নাগিরেভের পুরুষ হত্যার পিছনে হাত রয়েছে এক নারীর। তিনি আর কেউ নন।  সুজানা ফাজেকাস। নাগেরিভ গ্রামের যে সমস্ত মহিলা পুরুষদের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে অবৈধ প্রণয়ে জড়িয়ে পড়ে গর্ভবতী হয়ে পড়েন, তাঁদের অধিকাংশ শরণাপন্ন হন সুজানা ফাজেকাসের। না, শুধুমাত্র মহিলাদের গর্ভপাত করিয়ে থেমে থাকেননি সুজানা। আর্সেনিক প্রয়োগে পুরুষদের হত্যার পরামর্শ দেন সুজানা। তদন্ত শেষে পুলিশ অবশ্য দাবি করেছিল নাগেরিভ গ্রামের হত্যায় প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত সুজানা। কারণ হত্যায় ব্যবহৃত আর্সেনিকের যোগান দিয়েছিল সুজানা ফাজেকাস নিজেই, যার মাধ্যমে নাগেরিভের প্রায় তিনশো পুরুষকে হত্যা করা হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে এরকম হাজারো নৃশংসতা অমানবিকতার ইতিহাস। আর এই সব ইতিহাসের মাঝেই চাপা পড়ে যায় ছোট্ট গ্রাম নাগিরেভের এই কলঙ্কজনক অধ্যায়। কে জানে আমাদের অজান্তেই হয়তো আরও অনেক নাগিরেভ আজও রয়ে গেছে অন্তরালে। সেখানে মৃত্যুর ইতিহাস ব্যর্থ কান্নার শব্দ গুমরে মরে আজও।

আরও পড়ুন
খেলা দেখাতে দেখাতেই ‘বন্ধু’কে হত্যা, ডলফিন ও তার ট্রেনারের করুণ গল্প

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More