ব্রজেন্দ্রকুমার লিখলেন 'বিদ্রোহী নজরুল', বিদ্রোহের রেশ পৌঁছল আদালত পর্যন্ত

‘না না না আজ রাতে আর যাত্রা শুনতে যাব না।’—শিল্পী মান্না দের এই অনবদ্য সৃষ্টির পরেও ষষ্ঠী টু জষ্ঠী যাত্রা এক অমোঘ আকর্ষণে ডাক দিয়ে যায় আমাদের। রথযাত্রার থেকে দুর্গাপূজা পর্যন্ত যেন দম ফেলার ফুরসত পায় না চিৎপুরের গদিঘরগুলো। প্রাচীনপন্থীরা 'যাত্রার সে দিন গেছে' বলে যতই দীর্ঘশ্বাস ফেলুন না কেন, নায়ক- নায়িকা, খলনায়কের আলোকচিত্র অথবা ভালবাসার ব্লো হট বিজ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে একে অন্যকে ছাপিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা আজও কিন্তু যাত্রাপাড়ায় একইরকম বিদ্যমান।

সালটা ১৯০৭। এই বছরই বাংলাদেশের গয়ঘর— গঙ্গানগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করলেন যাত্রা শিল্পের অন্যতম উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ব্রজেন্দ্রকুমার দে (Brajendra Kumar Dey)। শৈশব থেকেই সংসার সীমান্তে মা-বাবার এক অসম লড়াইয়ের সাক্ষী থাকত একরত্তি ব্রজেন্দ্র। অভাব তাদের নিত্যসঙ্গী। অর্থনীতিতে এম.এ ব্রজেন্দ্র যাত্রা দলে যোগদান যেন কিছুটা স্রোতের বিপরীতে ছুটে চলার মতোই। দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে দাড়ি টেনে যাত্রা দলে যোগ দিয়েছিলেন ব্রজেন্দ্রকুমার। যাত্রা দলে যোগদানের কিছুদিনের মধ্যেই ব্রজেন্দ্রকুমার প্রমাণ করে দিয়েছিলেন তিনি লম্বা রেসের ঘোড়া।'ব্রজনাভ' এবং 'চাঁদের মেয়ে' এই দুই পালার মধ্য দিয়ে যে জয়যাত্রার শুরু, সেই জয়যাত্রার ধারাকে ব্রজেন্দ্রকুমার বহমান রেখেছিলেন আজীবন।

এরপর আসা যাক আসল গল্পে। অবশ্য 'গল্প হলেও সত্যি' ঘটনা এটা। সালটা ১৯৭৫, ২৬ জানুয়ারি।মঞ্চে অভিনীত হল ব্রজেন্দ্রকুমার দে রচিত 'বিদ্রোহী নজরুল'। পালাটি অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল প্রবল বিতর্ক। 'বিদ্রোহী নজরুল' পালায় কবি মোহিতলাল মজুমদারের চরিত্রটি যেভাবে চিত্রিত হয়েছিল তা নিয়ে আপত্তি তোলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক অরুণ মুখোপাধ্যায়। আনন্দবাজার পত্রিকার মাধ্যমে ব্রজেন্দ্রকুমারকে তীব্র আক্রমণ করলেন তিনি। 'যাত্রায় মোহিতলাল ' শীর্ষক লেখার মধ্য দিয়ে অরুণবাবু অভিযোগ করেন— ‘মোহিতলাল মজুমদার চরিত্রটিকে এই পালায় হাস্যকর চরিত্র রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে।’

৩ মার্চ, ১৯৭৫— আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হল শিশির দে-র একটি লেখা। লেখাটির মধ্য দিয়ে তিনি অরুণ মুখোপাধ্যায়কে একপ্রকার সমর্থন করেন— “মোহিতলালের এই বিকৃত চরিত্র যাত্রার আসরে দেখে, যাত্রার আসর ছেড়ে চলে এসেছে অনেকে এমন খবরও কানে এসেছে। ‘বিদ্রোহী নজরুল’ পালায় কবি মোহিতলালের এই বিকৃত চরিত্র অঙ্কনের জন্য পালাকার ব্রজেন্দ্রবাবুর জবাবদিহি করা উচিত।”

এভাবে বিতর্কের বহ্নিশিখায় প্রায় প্রতিদিনই যখন ঘৃতাহুতি করা হচ্ছে, ঠিক সেই সময়ই ব্রজেন্দ্রকুমারের হয়ে কলম ধরলেন তৎকালীন সময়ের প্রখ্যাত সাংবাদিক প্রবোধবন্ধু অধিকারী। তিনি অরুণ মুখোপাধ্যায় এবং শিশির দে এই দুজনের অভিযোগকে আমলই দিতে চাননি। তাঁর মতে, সমগ্র যাত্রাপালায় কবি মোহিতলাল চরিত্রটি 'হাসি-কান্নার হীরা-পান্নার দ্যুতিতে উজ্জল।' তবে এতকিছুর পরেও বিতর্ক থেমে থাকেনি। অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের মধ্য দিয়ে যাত্রার মঞ্চ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে বারংবার। ব্রজেন্দ্রকুমারের বিরুদ্ধে কবি মোহিতলালকে হেয় করার অভিযোগ ভিন্নমাত্রা পায়, যখন মোহিতলালের পুত্র মনসিজ মজুমদার, অরুণ মুখোপাধ্যায় এবং শিশির দে— উভয়কে সমর্থন করে আনন্দবাজার পত্রিকায় লিখলেন— ‘আমার গভীর বিশ্বাস সুস্থ থাকলে আবেগপ্রবণ নজরুল ও বাবার শেষ জীবন তাদের প্রীতিপূর্ণ সম্পর্কের প্রতিষ্ঠায় প্রয়াসী হতেন এবং কোন অবস্থাতেই অগ্রজতুল্য বন্ধুর অবমাননা অনুমোদন করতেন না।’

এই পালাটি নিয়ে শেষ পর্যন্ত আদালতের দ্বারস্থ হন মৃন্ময় মজুমদার ( কেস নং সি ০২১৮,১৯৭৫)। আদালত যাঁদের অভিযুক্ত করেছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ব্রজেন্দ্রকুমার। যদিও মামলার নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই মৃত্যু হয় ব্রজেন্দ্রকুমারের।

আইনি জটিলতার পরেও 'বিদ্রোহী নজরুল 'পালাটি সাফল্যের সঙ্গে মঞ্চস্থ হয়। বর্তমান সময়ে যাত্রার সাফল্য, নায়ক-নায়িকার উজ্জ্বল আলোকচিত্র অথবা ভালোবাসার ব্লো-হট বিজ্ঞাপনের আড়ালে চলে গেছে নজরুল-মোহিতলালকে নিয়ে যাত্রার এই আইনি লড়াইয়ের ইতিহাসটি।

তথ্যসূত্র :- 'যাত্রার সঙ্গে বেড়ে ওঠা', প্রভাতকুমার দাস, কারিগর প্রকাশনী ( পৃষ্ঠা ২২৭-২৩৪)

Powered by Froala Editor

More From Author See More