নিজের আঁকা ছবিকে চালালেন ‘অরিজিনাল ভেরমিয়ার’ বলে; শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ প্রবঞ্চক মীগরে?

 দক্ষিণ ফ্রান্সের রোকেনব্রুন শহর। উত্তাল সফেন সমুদ্র যেন প্রতি মুহূর্তে চুম্বন এঁকে দিচ্ছে  শহরের ওষ্ঠে। শান্ত সমাহিত অথচ প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর দক্ষিণ ফ্রান্সের এই শহর। সালটা ১৯৩২। রোকেনব্রুন শহরের একপ্রান্তে প্রিমেভেরা নামক একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতে এলেন হ্যান ভা মীগরে নামের এক ব্যক্তি, আর তারপরেই রহস্যের জাল ঘনীভূত হয়ে উঠল প্রিমেভারা-কে নিয়ে। কিন্তু কে এই হ্যান ভা মীগরে? চিনতে না পারারই কথা, কারণ তখনও মিডিয়ার স্পটলাইট মীগরেকে নজরবন্দি করতে পারেনি। সেই সময় তিনি আপাত অখ্যাত এক চিত্রশিল্পী। যদিও পরবর্তীতে এই মীগরেই হয়ে উঠেছিলেন আমস্টারডামের ধনকুবেরদের মধ্যে অন্যতম। তবে শুধু এটুকু বললে মীগরে সম্পর্কে অনেককিছুই না বলা থেকে যায়। 

রং তুলি স্কেচবুক পেন্সিল এই ছিল মীগরের ছোট্ট বেলার সঙ্গী। প্রথাগত শিক্ষালাভের চিরদিনই বিরোধী তিনি। আঠেরো বছর বয়সে দেলফত বিশ্ববিদ্যালয়ে পদধূলি অঙ্কিত হল মীগরের। এখানেই শিল্পী জীবনের সফলতার প্রথম স্বাদ গ্রহণ মীগরের। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর দেলফত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে আয়োজিত হত একটি প্রতিযোগিতা, সেখানেই প্রথম পুরস্কার লাভ করেন মীগরে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা চলাকালীন প্রথম প্রেম, বসন্তদিনের আনাগোনা। যে দুটি নীল চোখের প্রেমে পড়েছিলেন মীগরে, তার হাতে হাত রেখে সারাটি জীবন অতিবাহিত করতে পারেননি তিনি। ঘটেছিল বিবাহবিচ্ছেদ। কারণ মীগরে তখন মত্ত জোহানার প্রেমে। অথচ তার প্রথম স্ত্রী অ্যানা তাকে ভালোবেসে এক কাপড়ে বাড়ি ছেড়েছিল। বিয়ের আগেই মীগরের ঔরসে গর্ভবতী হয়ে পড়ে তার প্রথম প্রেমিকা  অ্যানা, তারপর নিজের সমস্ত সুখ - স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে মীগরেকে সঙ্গে নিয়ে সংসার - সীমান্তে একের পর এক লড়াই করেছে কিশোরী মেয়েটি, হেরেছে বারংবার কিন্তু লড়াই ছাড়েনি। 

এই ঘটনাটার শুরু হচ্ছে একটি চিত্র প্রদর্শনী থেকে, পরবর্তীতে যার সঙ্গে জড়িয়ে যান এক অবিস্মরণীয় শিল্পী, ভেরমিয়ার। তবে তার কথা পরে, আগে শোনা যাক এই চিত্র প্রদর্শনীর গল্প। হ্যাঁ, প্রদর্শনীটির আয়োজক আর কেউ নয়। হান ভ্যা মীগরে, তবে তিনি নিজে প্রদর্শনী নিয়ে যতটা না উৎসাহিত, তার থেকেও বেশি উৎসাহিত তাঁর স্ত্রী অ্যানা। তার আশা কোনো একদিন বিশ্ব ললিতকলার সমঝদাররা বুঝবে তার স্বামী মীগরে একটি ক্ষণজন্মা প্রতিভা, লাখে একটা মেলে। এই আশায় সে বন্ধক দিয়ে বসেছে নিজের গহনাগুলো। প্রদর্শনী আয়োজন করতে যে অনেক টাকার দরকার। যদিও মীগরের ভাগ্যে শিকে ছেড়েনি শেষ পর্যন্ত। প্রদর্শনীর শেষ দিনে মীগরে ডেকে এনেছিলেন ডক্টর ব্রেডিউসকে। যিনি ছিলেন তৎকালীন শিল্প বোদ্ধাদের অন্যতম। কিন্তু বিধি বাম। সান্ত্বনা বাক্য তো দূরের কথা ব্রেডিউস মীগরের মুখের উপর বলেন ছবি আঁকা তার জন্য নয়, সে বরং অন্য কোনো কাজে হাত দিক। ব্রেডিউস কি জানতেন, তার এই অপমানই জন্ম দেবে পরবর্তীকালের এক  প্রবঞ্চকের? যে নির্দ্বিধায় ছেলেখেলা করতে পারে বিশ্ব ললিতকলার অন্যতম উৎকৃষ্ট সম্পদ ভেরমিয়ার নিয়ে? অথবা যার তুখোড় বুদ্ধিমত্তার কাছে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হন সেই সময়ের ধুরন্ধর সব শিল্প সমালোচক?

না, মীগরে এই অপমান ভোলেননি। তবে শুধু একবারই নন, এর পরেও একইভাবে বারংবার মীগরেকে ডক্টর ব্রেডিউসের চক্ষুশূল হতে হয়েছে। মীগরে উপযুক্ত প্রত্যুত্তর খুঁজে ফিরেছেন বারংবার, কিন্তু উপযুক্ত জবাব আর দেওয়া হচ্ছিল না তাঁর। অবশ্য বেশিদিন হাত গুটিয়ে বসে থাকার পাত্র নন মীগরে। সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। আর সেই সুযোগ মিলেও গেল একেবারে অভাবিতভাবে। ততদিনে মীগরের জীবনের একটা যুগ অতিবাহিত হয়ে গেছে। তাকে ছেড়ে গেছে তার প্রথম স্ত্রী অ্যানা, মীগরে নতুন ভাবে প্রেমে পড়েছেন জোহানার। মীগরে তখন জোহানার সঙ্গে প্রমোদ ভ্রমণে মত্ত। ঘুরতে ঘুরতে একসময় তারা এসে পড়লেন রোমে। সেখানেই মীগরে মুখোমুখি হলেন কারাভাগগোর ছবির। আর এই ছবির হাত ধরেই জন্ম নিল এক প্রবঞ্চক, যে পরবর্তীকালে অবলীলায় থাপ্পড় মেরেছিল একের পর এক আর্ট কৌনসারের গালে। 

অন্যদিকে ডক্টর ব্রেডিউস ততদিনে ভেরমিয়ার সম্পর্কে একজন অথরিটি। সুতরাং এই তো সুবর্ণ সুযোগ ব্রেডিউসকে নাস্তানাবুদ করার, সমস্ত অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার। যেমন ভাবা তেমন কাজ। মীগরেকে এবার দেখা গেল রোকেনব্রুন শহরের সেই বাড়ি অর্থ্যাৎ প্রিমেভেরাই। না প্রবঞ্চনার এই অধ্যায়ে নিজের স্ত্রী জোহানাকেও কাছে রাখেননি মীগরে। অর্থ্যাৎ প্রিম্ভেরায় প্রবঞ্চনার একান্ত অনুশীলনে নামনেল মীগরে। যার ফলশ্রুতি, মাস ছয়েক পরে মীগরের হাত ধরে আবিষ্কৃত হল একটি অরজিনাল ভেরমিয়ার। হ্যাঁ অরজিনালই বটে। সে ছবি দেখে আসল-নকলের ফারাক করে কার সাধ্য! ছবি নিয়ে মীগরে এবার গেলেন ডক্টর বুনের কাছে। তার কাছে সুকৌশলে একটি আষাঢ়ে গপ্পো ফেঁদে বসলেন মীগরে। ডক্টর বুনকে জানানো হল, মাভরোক নামের মীগরের এক প্রেয়সী এই অরজিনাল ভেরমিয়ারটি খুঁজে এনেছেন। ডক্টর বুন জানালেন, ছবিটি খরিদ করার আগে তিনি ব্রেডিউসকে দিয়ে একবার যাচাই করিয়ে নিতে চান। না, মীগরে আপত্তি করেনি। কিন্তু আশ্চর্যের কথা স্বয়ং ডক্টর ব্রেডিউসও বুঝতে পারেননি ছবিটি অরজিনাল ভেরমিয়ার নয়, ছবিটি আসলে নকল। অবশ্য ব্রেডিউস-কে নাস্তানাবুদ করতে কম কাঠ খড় পোড়াতে হয়নি মীগরেকে। দীর্ঘ ছ মাস ধরে তিনি বুনেছিলেন সেই প্রবঞ্চনার জাল, যার নাগপাশ থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব ছিল ব্রেডিয়াসের কাছে। 

এরপর একের পর এক ছবি এঁকে সেগুলিকে ভেরমিয়ারের নামে বিক্রি করেছেন মীগরে। সেগুলি স্থান পেয়েছে বিশ্বের নানা আর্ট গ্যালারিতে। কিন্তু ব্রেডিউস দূরের কথা অন্যান্য আর্ট কৌনশারও মীগরের এই চক্রান্তের বিন্দুমাত্র হদিশ পাননি। মীগরে ততদিনে প্রতিশোধের নেশায় পাগল, একের পর এক দুঁদে শিল্প - বোদ্ধাদের নাকের ডগা দিয়ে নকল ছবিকে আসল বলে চালিয়েছেন তিনি। কিন্তু একসময় এই মীগরেও পুলিশের জালে উঠলেন। না, নকল ছবি বিক্রির অপরাধে নয়, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি দেশের শিল্পসম্ভার বিদেশে পাচার করছেন। যা ছিল চূড়ান্ত মিথ্যে। পুলিশি জেরার মুখে মীগরে ততদিনে স্বীকার করেছেন তার প্রবঞ্চনার ইতিহাস। তথাকথিত শিল্প বোদ্ধাদের নাকে ঝামা ঘষে কিভাবে তিনি তাঁর অপমানের প্রতিশোধ নিয়েছেন সেই ইতিহাস। 

আরও পড়ুন
মানুষের আঁকা ‘প্রাচীনতম’ পশুর ছবি আবিষ্কৃত ইন্দোনেশিয়ার গুহায়

এতদূর পর্যন্ত পড়ে মনে হতেই পারে, শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ প্রবঞ্চক ছিলেন মীগরে। কিন্তু মুদ্রার উল্টো পিঠটি তাহলে না দেখায় থেকে যায়। মীগরে কি তার প্রবঞ্চনার মধ্য দিয়েই সমস্ত অপমানিত, লাঞ্ছিত শিল্পীদের প্রতিভূ হয়ে ওঠেননি? প্রশ্ন কিন্তু উঠতেই থাকবে। 

তথ্যসূত্র –
১। 'প্রবঞ্চক' - নারায়ণ সান্যাল
২। আনন্দবাজার পত্রিকা

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
ছবি বিক্রি করে ৫০ হাজার টাকা, দুঃস্থদের পাশে দাঁড়াতে চায় মাদুরাই-এর খুদে

More From Author See More