‘আপনার গান শুনলে আর চোখের প্রয়োজন পড়বে না’, অন্ধ শ্রোতা জড়িয়ে ধরলেন মহম্মদ রফি-কে

ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেট ম্যাচ চলছে। বাইশ গজে দাঁড়িয়ে একে অপরকে মেপে নেওয়ার খেলা। বোলিং এন্ডে দাঁড়িয়ে আছেন বি এস চন্দ্রশেখর, আর স্ট্রাইকিং ব্যাটসম্যান স্বয়ং সুনীল গাভাসকার। বল করার পর, হঠাৎ চন্দ্রশেখর এগিয়ে গেলেন গাভাসকারের দিকে। ক্রিকেটের মাঠে স্লেজিং খুব সাধারণ বিষয়, সবাই জানে। ভেবেছিল, তাইই হয়তো করতে যাচ্ছেন চন্দ্রশেখর। কিন্তু সেসব কিছুই করলেন না তিনি। গাভাসকারের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললেন - শুনতে পেলে? সুনীলেরও কান খাড়া। দূর থেকে ভেসে আসছে মহম্মদ রফির গান ‘জিস দেশ মে গঙ্গা বেহতি হ্যায়’। পড়ে রইল খেলা, মুছে গেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। দুজনে মিলে গলা মেলালেন রফিসাবের সুরে…

এমন একজন গায়ক, যার গলা থামিয়ে দিল ক্রিকেট ম্যাচ। আচ্ছা, মহম্মদ রফি কি জাদু জানতেন? তাঁর গান যেন আমাদের প্রত্যেকের মনের ভাব টেনে আনে। দুঃখ হোক বা আনন্দ— সব ব্যামোরই ‘ওষুধ’ আছে রফিসাবের কাছে। সেই যে ছোটোবেলায় ফকিরদের গান শুনে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিলেন, তারপর থেকে সাত সুরই তাঁর জীবনের পাথেয়। মহম্মদ রফি যে এক নিবিষ্ট সাধকের নাম! 

১৯৪৮ সাল। মাত্র এক বছর আগেই স্বাধীন হয়েছে ভারত। দেশভাগে দীর্ণ মানচিত্র, দাঙ্গা, সাম্প্রদায়িক হত্যায় রক্তাক্ত ইতিহাস। সেই ছবিটা আরও একটু লাল হয়ে গেল, যখন নাথুরাম গডসের হাতে প্রাণ গেল ‘বাপুজি’ মহাত্মা গান্ধীর। এই আঘাত গোটা ভারতকে স্তম্ভিত করে দেয়। ওই বছরই গান্ধীজির হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া হিসেবে একটি রেকর্ড বের হয়। আর সেখানেই নিজের ঐশ্বরিক গলা দেন মহম্মদ রফি। সেই রেকর্ডেই মহম্মদ রফির গাওয়া গান (‘সুনো সুনো অ্যায় দুনিয়াওয়ালো’) শুনে অভিভূত হয়ে পড়েন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। এমনই প্রভাব পড়ে যে, গানটি গাওয়ার জন্য রফিসাবকে নিজের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান তিনি। সেই বছরই দেশের স্বাধীনতা দিবসে পান রৌপ্য পদক… 

মনে পড়ে ‘কাশ্মীর কি কলি’র সেই বিখ্যাত গান ‘ইয়ে চাঁদ সা রোশন চেহরা’? শাম্মি কাপুরের অভিনয়, ওই স্টাইল তো আজও অমলিন। আর মহম্মদ রফি? গানটিতে যেন অন্যভাবে সামনে এসেছেন তিনি। তাঁর গলাতেই ফুটে উঠছে নিখাদ অভিনয়, অভিব্যক্তি। বিশেষ করে মনে থাকবে গানটির একটি লাইন ‘তারিফ কারু ক্যায়া উসকি’। যতবার লাইনটি এসেছে, মহম্মদ রফির গলা বদলে গেছে। এই ব্যাপারটি প্রথমে পছন্দ করেননি সুরকার ওপি নায়ার। কিন্তু শাম্মি-রফির জুটি মানেই নতুন নতুন চমক। দুজনে মিলে ঠিক করলেন, এই একটি লাইনকেই যদি বিভিন্ন মুডে গাওয়া যায়। কোনক্রমে রাজি হলেন ওপি নায়ার। গানটি যখন পর্দায় উঠে এল, তখন চমকে গেলেন তিনি। এমন ম্যাজিকের কল্পনাও তো তিনি করেননি! 

আজও ভারতের রেডিও স্টেশনে, টিভিতে, অনুষ্ঠানে মহম্মদ রফির সদৃঢ় উপস্থিতি। যে সময় তিনি বলিউডে গান করছেন, তখন তো আরও কিংবদন্তির সমাগম সেখানে। কিশোর কুমার, মান্না দে’র মতো গায়ক, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলের মতো গায়িকা; আর শচীন দেববর্মণ, রাহুল দেববর্মণ, ওপি নায়ার, লক্ষ্মীকান্ত-প্যায়ারেলালের মতো সুরকাররা তো ছিলেনই। সেই বিশাল জগতেও উজ্জ্বল ধ্রুবতারা হয়ে থেকে গেছেন রফিসাব। ১৯৬৩ সাল। লন্ডনের স্কালা থিয়েটারে গান গাইছেন মহম্মদ রফি। সে এক অন্যরকম পরিবেশ। অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেল নির্ধারিত সময়। হঠাৎ মহম্মদ রফির কাছে হাজির হলেন এক শ্রোতা। তিনি অন্ধ; জগতের কোনো রংই ধরা পড়েনি তাঁর কাছে। ছুটে এসে রফিসাবের হাত ধরে বললেন- আমার এই কান যতদিন আপনার গান শুনতে পারবে, ততদিন চোখের প্রয়োজন হবে না! মহম্মদ রফিই যেন তাঁর দিব্যচক্ষু হয়ে রইলেন…     

জীবনে পেয়েছেন প্রচুর সম্মান, পুরস্কার। কিন্তু এক অন্ধের ‘চোখ’ হয়ে ওঠার মতো উচ্চতায় কি আর কেউ পৌঁছতে পেরেছেন? মান্না দে’র সাক্ষাৎকারে বারবার উঠে এসেছে তাঁদের বন্ধুত্বের কথা। উঠে এসেছে ঘুড়ি-প্রীতির কথা। মুম্বইয়ে একই পাড়ায় দুজনের বাড়ি। আর দুজনেই সময় পেলে মেতে উঠতেন ঘুড়ি খেলায়। সেই বন্ধুই যখন চলে গেলেন চিরকালের জন্য, থমকে গেলেন মান্না। সঙ্গীতের সাত সুরের যে এক সুর চলে গেল! আমরা যে অনাথ হয়ে গেলাম! মহম্মদ রফিকে কি এত সহজে ধরা যায়… 

আরও পড়ুন
পাতাঝরা হেমন্ত দিনে বিদায় নিলেন 'যৌবন বাউল' অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত

তথ্যসূত্র –
১) ‘পটৌডী ব্যাট হাতে নামলেই বেজে উঠত শর্মিলা ঠাকুরের ছবির গান’, সুমিত ঘোষ, আনন্দবাজার পত্রিকা
২) ‘তানসেন’, কৃশানু ভট্টাচার্য, আনন্দবাজার পত্রিকা
৩) ‘মহম্মদ রফি’, সব বাংলায় 

Powered by Froala Editor

More From Author See More