বাড়ির নেমপ্লেটে লেখা ‘মানসিক হাসপাতাল’, কিশোরে শঙ্কিত রফি-মান্নাও

রেকর্ডিং-এর দিন স্টুডিওতে এসে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন মান্না দে আর মুহম্মদ রফি। সেকালে ট্রাক রেকর্ডিং হত না। সমস্তটাই লাইভে তোলা হত। ফলত সকলকেই জোর কদমে রিহার্সাল করে আসতে হত। যথাসময় বলিউড সঙ্গীতজগতের দুই কিংবদন্তি পৌঁছেছেন। ‘চলতি কা নাম জিন্দেগি’ সিনেমার গান। তিনজন মিলে গাইবেন। ঘটনাচক্রে তৃতীয় গায়ক, সিনেমার সঙ্গীত পরিচালক। তাঁর নাম আভাসকুমার মুখোপাধ্যায় ওরফে কিশোরকুমার। তিনি এখনও পৌঁছননি।

ঘণ্টা কাটছে। মিনিট কাটছে। কিশোরকুমার অনুপস্থিত। মান্না দে অস্থির হয়ে পায়চারি করছেন স্টুডিওতে। ‘রফি সাবে’র মুখে আষাঢ়ের ঘনঘটা। তাঁরা দু'জনেই শুনেছেন ‘কিশোর’ নাকি রিহার্সাল করেননি। একসময় হাল ছেড়ে দিলেন রফি। বিরক্ত হয়ে ‘মান্না’দাকে বলেন, ‘কিশোর গানটা ঝুলিয়ে দেবে। গট আপ ছাড়া এ গান হয় নাকি?’ মান্না দে চুপ করে যান। রেকর্ডিং আজ ডুববেই। আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়া গেল যাহোক!

অনেকক্ষণ বাদে কিশোর ঢুকলেন। ছোটোখাটো একটা হুল্লোড় যেন বয়ে গেল স্টুডিওতে। হাসি মশকরা খেউড়ের মধ্যেই গান রেকর্ড হল। কিমাশ্চর্যম! কিশোরের সুর, তালে কোনো গলদ নেই। প্রথম টেকেই উতরে গেল রেকর্ডিং।

এরপর থেকে মান্না ও রফি, কিশোরের এ'সব ‘খামখেয়ালিপনা’ খুব দেখেও দেখতেন না।

ইন্দোর ক্রিশ্চিয়ান কলেজ ক্যান্টিনে কিশোরের ধার ছিল, পাঁচ টাকা বারো-আনা। সেই পাঁচ টাকা বারো আনার কথাই ফিরে আসে ‘চলতি কি নাম গাড়ি’ সিনেমায়। খান্ডয়ার বাড়ির নেমপ্লেটে লিখে রাখেন, ‘মানসিক হাসপাতাল’। রেকর্ডিং শেষ না হওয়া পর্যন্ত ধরে রাখেন মান্না দের খাস তবলচিকে। সত্যজিৎ রায়ের ‘চারুলতা’ সিনেমায় প্লেব্যাকের পর পারিশ্রমিক নিতে অস্বীকার করেন। সাধারণ সামাজিকতার সংজ্ঞায়, তাঁকে যে ধরাছোঁয়া যায় না। শাস্ত্রীয় সংগীতের কোনো প্রথাগত তালিম না থাকা সত্বেও তাঁর সুর লয়ে ভুল হয়নি কোনোদিন। কখনো টাল খায়নি গলা। গান তুলে ভয়ে ভয়ে ফোন করতেন শচীন দেব বর্মণকে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলত সেই টেলিফোনিক মহড়া…

মান্না দে বলতেন, “এমন সুরেলা গায়ক আমি কখনও দেখিনি। আমরা নিজের অজান্তে একটু-আধটু বেসুরো ফেলেছি, কিশোর কখনও নয়।”

আরও পড়ুন
সরকারের প্রস্তাবে অরাজি; ’৭৫-এর জরুরি অবস্থায় নিষিদ্ধ কিশোর কুমার

১৯৮৭ সালে কলকাতার নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামের মঞ্চে কিশোর আর তরুণ বাপ্পি লাহিড়ী। সুরের জাদুতে দর্শককে এই হাসাচ্ছেন, কাঁদাচ্ছেন পরমুহূর্তেই। হাততালির গর্জনের মাঝে বলেছেন, ‘যদি বেঁচে থাকি, আবার আসব। আপনাদের গান শোনাব।’

‘কিশোর’দা তাঁর ‘প্রাণের শহরে’ আর ফিরে আসেননি...

তথ্যসূত্র : 

আরও পড়ুন
হারিয়ে যাওয়া রিল পুনরুদ্ধার, ৬৩ বছর পর ‘মুক্তি’ পাবে কিশোর কুমারের সিনেমা

১.‘কিশোর বললেন, ‘মাস্টারদা মিষ্টি করে গাইতে বললেন, তাই কোকিলের ছবি আঁকলাম’ : দেবপ্রসাদ চক্রবর্তী, আনন্দবাজার পত্রিকা

২.‘গাইতে গাইতেই গায়েন হয়েছিলেন কিশোর কুমার’ মাসুম আলী, প্রথম আলো।

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
সলিলের সঙ্গে এক সোফায় নয় কিছুতেই, মাটিতে বসে গান শিখলেন কিশোরকুমার