চুণীর প্রয়াণে শোকস্তব্ধ ফুটবল জগৎ; স্মৃতিচারণায় প্রশান্ত, মেহতাব থেকে শিল্টন

‘ভারতীয় ফুটবল বললেই দুজনের নাম অবধারিত ভাবে উঠে আসে, চুণী আর পিকে। খেলোয়াড় বলো, কি মানুষ হিসেবেও, দুজনেই এক কথায় লেজেন্ড। স্বাধীনতার পর থেকে ভারতে ফুটবল যতদিন ছিল, ফুটবল যতদিন আছে, সেই ফুটবল মানেই চুণী-পিকে। সেই চুণীদাকে আজ হারাতে হল। অদ্ভুত ব্যাপার, এক মাসের ব্যবধানে দুজনেই চলে গেলেন। এ অবিশ্বাস্য, ভাবাই যাচ্ছে না, দুজনেই চলে গেলেন প্রায় একসঙ্গে। কিছু বলার মতোও ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।’

ফোনের ওপার থেকে এই কথাগুলোই বলছিলেন প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। সত্তর ও আশির দশকে তিনটি বড়ো ক্লাবের হয়েই ময়দান কাঁপিয়েছেন এই মিডফিল্ডার। পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোচিংয়ে খেলেছেন দীর্ঘদিন, সুবিমল ওরফে চুণী গোস্বামীও ছিলেন তাঁর খুব কাছের মানুষ। একমাসের ব্যবধানে দুই চিরউজ্জ্বল নক্ষত্রের এভাবে চলে যাওয়াটা তাই প্রশান্ত মানতে পারছেন না কিছুতেই।

চুণী-পিকে বললেই ভারতীয় ফুটবলপ্রেমীকুলের মনে পড়বে, ১৯৬২। জাকার্তা এশিয়াড। সৈয়দ আব্দুল রহিমের কোচিংয়ে সোনা জিতেছিল ভারতীয় দল। শেষ পর্যায়ের ক্যানসারের সঙ্গে তখন অসম যুদ্ধ করছেন রহিম। দলের ছেলেরা ডাকত ‘রহিমসাব’ বলে। ফাইনালের আগের দিন জাকার্তার অন্ধকার রাস্তায় বলেছিলেন, পরদিন ফাইনাল জিতে জীবনের শেষ উপহারটা দিতে। কথা রেখেছিলেন ক্যাপ্টেন চুণী ও তাঁর ব্রিগেড। ফাইনালে গোল করেছিলেন পিকে। শৈলেন মান্নার পর দেশের হয়ে সোনাজয়ী ক্যাপ্টেনের তালিকায় নামটা ঢুকে গিয়েছিল চুণী গোস্বামীর। দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানের মতো দলকে হারিয়ে দেওয়া সেই স্বপ্নের দলের ফরোয়ার্ড লাইনের তিনজন, চুণী-পিকে-বলরামের মধ্যে স্মৃতিভারে আচ্ছন্ন হয়ে কেবল থেকে গেলেন ভারতীয় ফুটবলে বিদ্রোহী সত্তা হিসেবে পরিচিত তুলসীদাস বলরাম।

যে বছর সোনা জেতালেন, সেই মরশুমেই বাংলার হয়ে রঞ্জিতে অভিষেক ঘটল তাঁর। সেমিফাইনালে খেলেছিল তাঁর দল। ফুটবল ছাড়ার পর পুরোপুরিই ক্রিকেটার। সেখানেও বাংলাকে রঞ্জি ফাইনালে তোলার মতো ঈর্ষণীয় পরিসংখ্যান। সাউথ ক্লাবে টেনিস খেলাই হোক বা হকি দলের প্রতিনিধিত্ব, ভারতীয় ক্রীড়াজগতে এমন বর্ণময় চরিত্র আর আসেননি। সেই নিয়ে প্রশান্তর মত – ‘ফুটবল খেলেছেন, ক্রিকেট খেলেছেন, টেনিস খেলেছেন, অর্থাৎ স্পোর্টসম্যান বলতে যা বোঝায়, একদমই তাই ছিলেন চুণীদা। কোচিং পাশ করেছিলেন, কিন্তু কোচিংয়ে সেভাবে কখনও আসেননি। সেটা একদিক দিয়ে ভালই করেছেন। কোচিং করানোটা ওনার মন থেকে কখনও পছন্দের ছিল না।’

তবে কোচিংয়ে যেমন আসেননি, কিন্তু অনুজ প্রজন্মকে নিজেদের সময়কার ফুটবল নিয়ে বলতেন অনেক কথাই। তাঁর মতোই মোহনবাগানের আরেক ঘরের ছেলে শিল্টন পাল বলছিলেন – ‘যখনই ক্লাবে আসতেন, ওনাদের সময়ের ফুটবল কেমন ছিল, ওনারা কীভাবে খেলতেন, সেসব নিয়ে আমাদের গল্প বলতেন। ওনাদের সময় থেকে আমাদের সময়ে ফুটবল অনেক বদল হয়ে গেছে। কিন্তু সেসব বদল নিয়ে খুব একটা কথা ওনাকে বলতে দেখিনি।’

চুণী গোস্বামীকে নিয়ে কথা বলতে গেলে আরও একটি বিচিত্র স্মৃতি এখানে অবশ্য উল্লেখ্য। ১৯৫৩ সালে ইংলিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের বিশ্বের দশ সেরা অধিনায়কের তালিকায় জ্বলজ্বল করা শৈলেন মান্না কিংবা ২০০৪ সালে ফিফার তরফ থেকে প্রদীপকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অর্ডার অফ মেরিট’-লাভের ঠিক পাশেই অনায়াসে চলে আসবে ১৯৬২ সালে চুণী গোস্বামীর কাছে আসা নামজাদা ইংলিশ ক্লাব টটেনহ্যামে খেলার আমন্ত্রণ। ১৯৬০-৬১ মরশুমে দ্বিমুকুট (ইংলিশ ফুটবল লিগ ও এফএ কাপ) জিতেছিল টটেনহ্যাম। ১৯৬২-তেও এফএ কাপ জেতে তারা। পরের বছরই ইউরোপিয়ান কাপ উইনার্স কাপ জিতে প্রথম ব্রিটিশ ক্লাব হিসেবে ইউরোপের কোনো টুর্নামেন্ট জিতেছিল তারা। কিন্তু সবুজ-মেরুন জার্সির প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালবাসার টানে এমন সফল ক্লাবের আমন্ত্রণও ফিরিয়ে দেন। কে জানে, সেদিন গেলে হয়ত অন্যভাবে লেখা হত ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাস।

গল্প হলেও সত্যি। আজকের চূড়ান্ত পেশাদারি দুনিয়ায় যেন রূপকথার মতোই শোনায় এসব ময়দানি গল্পগুলো। এই নিয়ে একটি দারুণ অথচ স্পষ্ট কথা বললেন শিল্টন – ‘তখনকার খেলোয়াড়দের মধ্যে পেশাদারিত্বের চেয়েও বড় ছিল আবেগ। পেশাদার তো অবশ্যই ছিলেন তাঁরা, নইলে কি আর বিদেশের ক্লাবেও ডাক পান! কিন্তু কোথাও গিয়ে যেন সেই কলকাতার ফুটবলের প্রতি ওনাদের ভালবাসা, আবেগ ছিল ভীষণভাবে। আজকের ফুটবলেও আবেগ রয়েছে। ‘নেই’ একথা বলব না, কিন্তু তা অনেক কমে এসেছে। আর এখন কলকাতার ফুটবলে তেমন বাঙালির সংখ্যাও কমে এসেছে, ফলে আবেগ তো সততই কম।’

মাঠে যেমন বলকে কথা বলাতেন, মাঠের বাইরের মানুষটা আবার স্বভাবগত ভাবে ছিলেন শান্ত, চুপচাপ প্রকৃতির। তাঁর ঠিক পরের প্রজন্মের খেলোয়াড় ছিলেন সমরেশ চৌধুরী। একজন মোহনবাগানের মধ্যমণি, অন্যজন ইস্টবেঙ্গলের। ১৯৭০ সাল থেকে টানা ছ’বছর খেলার পর মোহনবাগানে এসেছিলেন সমরেশ। চুণী তাঁকে বলেছিলেন – ‘ছ’বছর তো ইস্টবেঙ্গলকে দিলি। এবার আমাদের ক্লাবকে কিছু দে।’ দিয়েছিলেনও বটে সমরেশ চৌধুরী। কলকাতা লিগ, আইএফএ শিল্ড, রোভার্স কাপ, বরদোলৈ কাপ, দার্জিলিং গোল্ড কাপে ভরে গিয়েছিল ক্লাবের ট্রফি ক্যাবিনেট। সকলকেই খুব সম্মান দিয়ে কথা বলা ছিল চুণী গোস্বামীর স্বভাবজাত।

মানুষ চুণীকে নিয়ে ঠিক সেরকমই মত পোষণ করেন সদ্য অবসর নেওয়া মেহতাব হোসেনও – ‘ওনার খেলা তো আমি দেখিনি, আমাদের জন্মের আগে উনি খেলেছেন, আর ব্যক্তিগত ভাবেও আমার সঙ্গে অত যোগাযোগ ছিল না। বিশ্বকাপের সময়ে নিউজ চ্যানেল থেকে যখন আমাদের ডাকা হত, তখন মাঝে মাঝে দেখা হয়েছে। খুব ভালো কথা বলতে জানতেন, আর মানুষকে খুব সম্মান করতেন। আপনি যত বড় ফুটবলারই হন, যত টাকাই করুন, মানুষের সঙ্গে না মিশলে, মানুষকে না ভালবাসলে কেউ মনেও রাখবে না। চুণী স্যার, পিকে স্যার, এইসব ভালবাসার মানুষগুলো এক-এক করে সব চলে যাচ্ছেন। রনিদাও চলে গেলেন। ১৫ তারিখেই ফোনে আমার সঙ্গে কথা হল, আর কদিন বাদেই শুনি উনি আর নেই। খুব খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি আমরা।’

তবে অন্যায় দেখলে তার প্রতিবাদ করতেও পিছপা হতেন না শান্ত মানুষটি। ২০০৭ এবং ২০০৯-এ নেহরু কাপ জেতার পর যখন হাউটন-রোম্যান্টিসিজমে ভেসে যাচ্ছে ভারতীয় ফুটবল এবং মিডিয়া, সেই সময়ে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে এই চুণী গোস্বামীই কড়া সমালোচনা করেছিলেন ভারতের কোচ বব হাউটনের। তরুণ ফুটবলারদের উপর নজর না দিয়ে হাউটন যে এশিয়া কাপে নিয়ে যাচ্ছেন দলকে, এবং দলের বর্তমান পারফরম্যান্স অনুযায়ী সেখানে প্রথম রাউন্ডেই বিদায় নেওয়া প্রায় নিশ্চিত, তা নিয়ে ২০১১ সালে হাউটনের নিন্দা করেন তিনি। তাঁর সাফ কথা ছিল, হাউটন যদি বড় কোচ হতেন, তবে বছর বছর ভারতীয় দলের র্যা ঙ্কিং এভাবে নামত না। ময়দান জুড়ে এমন স্পষ্টবক্তাদের প্রজন্মও যেন কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে। জীবন-সায়াহ্নে তাঁরা উপনীত হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে ফুটবলকে আগলে রাখা এইসব মানুষদের চলে যাওয়া খেলার জগতের ক্ষেত্রে অপূরণীয় ক্ষতি তো বটেই।

বিশ্বজুড়ে এক আণবীক্ষণিকের তাণ্ডবে কার্যত স্তব্ধ হয়ে গেছে সভ্যতা। তার মাঝেই আসছে একের পর এক নক্ষত্র পতনের খবর। আর এমনই সেই নির্মম পরিহাস যে, কাছে গিয়ে শেষ শ্রদ্ধাটুকু অবধি জানাতে পারছেন না তাঁদের অগণিত অনুরাগীরা। সেই নিয়ে আক্ষেপ ঝরে পড়ে প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় – ‘করোনার জন্যে এমনিই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে রয়েছি, সারা পৃথিবীতে লকডাউন চলছে, মানুষ মৃত্যুমুখে ভেসে যাচ্ছে, কত মানুষ আরও আতঙ্কে রয়েছে, তার মধ্যে একটার পর একটা খারাপ খবর এসে চলেছে। এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে আমরা দাঁড়িয়ে রয়েছি, যে শেষ দেখাটুকুও আর দেখতে পাচ্ছি না। প্রদীপদার বেলাতেও দেখতে পেলাম না, চুণীদার বেলাতেও তাই।’
মেহতাব-শিল্টনের গলাতেও একই সুর। ক্লাবপ্রাঙ্গণে মরদেহ নিয়ে আসা, ভক্তদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের চিরাচরিত প্রথাটি থেকে দূরে থেকেই সমাধা হচ্ছে তাঁর শেষকৃত্য। চুণী অবশ্য সেসব অনুভূতি থেকেও অনেক দূরে, কে জানে, হয়ত আবারও একটা ডিফেন্স-চেরা অ্যাসিস্ট বাড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন এক মাস দশ দিন আগে চলে যাওয়া প্রিয় বন্ধুটির উদ্দেশ্যে।

More From Author See More