ইংরেজদের সমালোচনা করে নিবন্ধ লিখলেন প্রফুল্লচন্দ্র, চিঠি পেলেন ব্রিটিশ সাংসদের

এডিনবারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৮৮৫ সালের শিক্ষাবর্ষ শেষ হতে চলেছে। আর কয়েকদিন পরেই শুরু হবে স্নাতকস্তরের ফাইনাল পরীক্ষা। তারই প্রস্তুতি নিয়ে ভয়ানক ব্যস্ত রসায়নের বাঙালি ছাত্রটি। এমন সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর স্যার স্ট্যাফোর্ড নর্থকোট, যিনি তখন লর্ড ইডস্লি হয়েছেন, তিনি একটি নিবন্ধ প্রতিযোগিতার ঘোষণা করলেন।

বিষয়-‘সিপাহী বিদ্রোহের পূর্বে ও পরে ভারতের অবস্থা’ (India before and after the Mutiny)। সেরা লেখকের জন্য থাকবে পুরস্কার, এ কথাও ঘোষণায় ছিল। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, লর্ড ইডস্লি ১৮৬৭ থেকে ’৬৮ সাল অবধি ভারতসচিব হিসাবে উত্তর-পশ্চিম প্রদেশে কর্মরত ছিলেন। ফলে মহাবিদ্রোহ-পরবর্তী অস্থির ভারতীয় সমাজকে অত্যন্ত কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল তাঁর, তবে তা ছিল নেহাতই শাসকের চোখে দেখা শাসিতের যাপনযন্ত্রণা।

এহেন ঘোষণা শুনে বেশ উৎসাহী হয়ে উঠলেন সাহিত্য ও ইতিহাসের অনুরাগী ছাত্রটি। কিছুদিনের জন্য রসায়নের বই সরিয়ে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার থেকে সংগ্রহ করে আনলেন ভারতের ইতিহাস ও অর্থনীতি বিষয়ক নানা বই ও প্রবন্ধ। এক নিশ্বাসে পড়ে ফেললেন ফরাসি পর্যটক, লেখক ও কিংবদন্তি চিত্রগ্রাহক লুই-থিওফাইল রুজলের (ডার্করুমের ভাবনা এই রুজলে সাহেবেরই মস্তিষ্কপ্রসূত) ‘L’Inde Rajas’ (The Rajas of India), আরেক ফরাসি লেখক ফার্দিন্যান্দ ল্যানয়ের ‘L’Inde Contemporaine’ (The Contemporary India), ‘Revue des deux Mondes’ (Review of Two Worlds), সদ্যপ্রয়াত ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদ হেনরি ফসেটের ‘Manual of Political Economy’, ‘Essays on Indian Finance’, ব্রিটেনের ‘দ্য ফোর্টনাইটলি রিভিউ’, ‘দ্য কন্টেম্পোরারি রিভিউ’, ‘দ্য নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরি’ পত্রিকা ও সমকালীন ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে ব্রিটিশ সংসদীয় আলোচনার মুদ্রিত প্রতিলিপি ‘হ্যান্সার্ড’।

তখনও লেখার হাত তত পাকা হয়নি তাঁর। তাই লেখাটা শেষপর্যন্ত কেমন দাঁড়াবে, সেই নিয়ে বেশ সংশয়েই ছিলেন। কিন্তু রচনার বিষয় যেহেতু ভারত, না লিখে থাকেন কী করে! বিস্তৃত পড়াশোনা তাঁর লেখার কাজ অনেকটাই সহজ করে দিয়েছিল। শুরুতেই প্রথম পাতায় একটি নীতিবাক্যের অবতারণা করেছিলেন তিনি। মূল রচনায় দুটি বিভাগ রেখেছিলেন। প্রথম ভাগটিকে আরও চারটি উপবিভাগে ভাগ করলেন, আর দ্বিতীয় ভাগে রাখলেন তিনটি উপবিভাগ। শিক্ষাক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের অবদানের প্রশংসার পাশাপাশি বলিষ্ঠ ভাষায় আক্রমণ করলেন শাসনতন্ত্রের স্বার্থপর দিকটিকেও - “The part played by England in the furtherance of the intellectual progress of the Indians forms one of the brightest chapters in Anglo-Indian history. …England unfortunately now refuses to recognize the hard and irresistible logic of facts, and does her best to strangle and smother the nascent aspirations of a rising nationality. The selfish, and therefore, harsh and cruel exigencies of an alien rule have imposed various disqualifications and disabilities upon the children of the soil.”

প্রতিযোগিতার বিচারক ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিন্সিপ্যাল স্যার উইলিয়াম মুয়র (স্কটিশ প্রাচ্যবিদ, আরবি ভাষায় সুপণ্ডিত ও যুক্তপ্রদেশের প্রাক্তন লেফটেন্যান্ট গভর্নর) ও অধ্যাপক ডেভিড ম্যাসন। না, সেবার পুরস্কার পাননি বাঙালি ছাত্রটি, কিন্তু তাঁর ও অন্য আরেকজন প্রতিযোগীর লেখা প্রবন্ধ দুটির উচ্চ প্রশংসা করেছিলেন দুই বিচারক। বিশেষত, একজন ভারতীয়ের চোখ দিয়ে দেখা ব্রিটিশ-শাসিত ভারতের অবস্থার বর্ণনায় যে স্বাভাবিক ইংরেজ-বিদ্বেষ ফুটে উঠেছিল, সেই অনুভূতিকে বিচারকরা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখেছিলেন। নতুন শিক্ষাবর্ষের শুরুতে প্রিন্সিপ্যাল মুয়র তাঁর বক্তৃতায় তিনটি সেরা প্রবন্ধের দরাজ প্রশংসা করলেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণের জন্য প্রবন্ধটি বই আকারে ছাপানো হয়েছিল, যেখানে ব্রিটিশ শাসনের কদর্ষ রূপটিকে তুলে ধরে ব্রিটেন ও আয়ার্ল্যান্ডের তরুণ প্রজন্মের প্রতি একটি নিবেদনপত্র রেখেছিলেন তরুণ ছাত্রটি। তবে শুধু বই আকারে প্রকাশ করাই নয়, প্রবন্ধের একটি কপি তিনি পাঠিয়ে দিলেন জন ব্রাইটের কাছে। লর্ড ডাফরিনের বর্মা প্রদেশের অন্যায় সংযুক্তিকরণের তীব্র সমালোচনা করে একটি চিঠিও পাঠালেন কপির সঙ্গে। জন ব্রাইট তখন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউজ অফ কমন্সের সদস্য। তার আগে বোর্ড অফ ট্রেডের সভাপতির দায়িত্ব সামলেছেন। সুবক্তা হিসেবে খ্যাত মানুষটি সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য জীবনভর লড়াই করে এসেছেন।

ভারতীয় ছাত্রটির প্রবন্ধটি পড়ে তাকে একটি চিঠি দিলেন ব্রাইট - “I regret with you and condemn the course of Lord Dufferin in Burma. It is a renewal of the old system of crime and guilt, which we had hoped, had been for ever abandoned. There is an ignorance on the part of the public in this country and great selfishness here and in India as to our true interests in India. The departures from morality and true statesmanship will bring about calamity and perhaps ruin, which our children may witness and deplore.”

চিঠির সঙ্গে ব্রাইট ছাত্রটিকে এ কথাও লিখে পাঠিয়েছিলেন, চিঠিটি তিনি চাইলে প্রকাশ করতে পারেন। এমন সুযোগ হাতছাড়া করেননি সেই তরুণ। ‘লন্ডন টাইমস’-সহ বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় দৈনিকে পাঠিয়ে দিলেন চিঠির কপি। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারেননি তিনি। খবরের কাগজের পাতায় জ্বলজ্বল করছে শিরোনাম-‘Mr. Bright’s letter to an Indian Student.’ পরে চিঠির কিছু অংশ ভারতে টেলিগ্রাফ করে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন রয়টার্সের প্রতিষ্ঠাতা পল জুলিয়ার রয়টার। প্রবন্ধটির দরাজ প্রশংসা করেছিল উত্তর ব্রিটেনের সর্বাধিক প্রচারিত সংবাদপত্র ‘দ্য স্কটসম্যান’ও। তবে পরীক্ষার দিন এগিয়ে আসায় আর এই প্রশংসার সাগরে গা ভাসানোর সুযোগ ছিল না ভারতীয় ছাত্রটির কাছে। আবার তাঁকে ডুবে যেতে হয়েছিল ইনঅর্গ্যানিক কেমিস্ট্রির অসীম সমুদ্রে।

সেদিনের সেই সুলেখক ‘Indian student’-কে পরবর্তীকালে আমরা চিনেছি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় নামে।

Powered by Froala Editor