‘পুকুরে ভেসে উঠল মরা শাল মাছ, কপালে তার সিঁদুর’

বিবেকানন্দ ব্যায়ামাগারের বিপরীতে এখন যেখানে কর্পোরেশনের বড়ো জলাধারটি, সেখানে একসময়ে পুকুর ছিল। হরেমামার সঙ্গে যেদিনই আড্ডা দিতে বসি, সেদিনই অন্তত একবার কোনও প্রসঙ্গে পুকুরের কথা উঠবেই। জলাধারের বয়স সঠিক মনে নেই কারও। হরেমামা বলে, পঁচিশ বছর, বাবুদার মতে, সতেরো-আঠারো বছরের বেশি নয়।

ব্যায়ামাগারটি জলাধারের বাঁদিকে। রাস্তা থেকে রোজই দেখি, অফিসবাড়ির কয়েকটা ঘরে আলো জ্বলে, কিন্তু সেখানে কোনও মানুষ আদৌ থাকে বলে মনে হয় না। একদিন শুধু একজন গার্ডের পোশাক পরা যুবককে দেখেছিলাম, চপ-মুড়ির জন্য বেরোতে। বাবুদা মাঝেমধ্যে বলে – “চারটে লোক থাকে কিনা সন্দেহ, পঞ্চাশটা লোকের জায়গা বানিয়ে রেখে দিয়েছে।” এমন এক নিরবচ্ছিন্ন প্রেতপুরীতে প্রাণের স্পন্দন বলতে একটি লাল-সাদা পোস্টার। কম্পাউন্ড ওয়ালের রাস্তার দিকের অংশটিতে সাঁটা। কর্পোরেশনের নিরাপত্তারক্ষী ও সাফাইকর্মীদের সংগঠন ডাক দিয়েছে – “সর্বত্র আন্দোলন গড়ে তুলুন।” 

রোদ-ঝড়-জলে সে পোস্টারও ক্রমে ঝাপসা হয়ে গেল। রঙে, স্মৃতিতে।

একদিন সবে চপ-মুড়ির ঠোঙাটা নিয়ে ক্লাবের চত্বরে গিয়ে বসেছি, মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হল। সঙ্গে সশব্দ ঝড়ো হাওয়া। তাণ্ডব চলল প্রায় আধঘণ্টা। রাস্তার আলোয় পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, বাতাসের দাপটে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো যেন দিশেহারা, যেদিকে পারছে পালাচ্ছে। ক্লাব প্রাঙ্গণের অনেকটা ভেতরে থেকেও গায়ে অনুভব করছি জলের ছাঁট। 

আরও পড়ুন
‘গ্র্যান্ড হোটেলের সামনে ‘City of Joy’-এর লোক এসে বলল, অভিনয় করবে?’

তারপর, যেমন হঠাৎ এসেছিল, তেমন হঠাৎই দুর্যোগের বেগ এল কমে। ঝড়ো হাওয়ার যে সোঁ-সোঁ শব্দটা এতক্ষণ চলছিল, এক সেকেন্ডের মধ্যে সেই শব্দটাও উধাও। 

আরও পড়ুন
তিনটে জোয়ান ছেলেকে এক আঙুলের টোকায় ফেলে দিয়েছিল মেয়েটা

হরেমামা ভিজে গিয়েছিল বৃষ্টিতে। প্রকৃতি শান্ত হলে সে তার পোশাক বদলাতে ক্লাবের ঘরে ঢুকল। তারপর হাতে এক কাপ গরম চা নিয়ে আমার পাশের চেয়ারটিতে বসে আমার দিকে তাকিয়ে সে বলল – “ছোটোবেলায় এমন বৃষ্টির মধ্যে দু’ঘণ্টা ফুটবল খেলেছি!”

আরও পড়ুন
‘ঊষার স্কুলের বারান্দায় ডাব খাচ্ছি, রাত তখন দেড়টা’

আমি চোখ কপালে তুলে বলি – “দু’ঘণ্টা! বলো কী গো!”

-হ্যাঁ, দু’ঘণ্টা ফুটবল। তারপরে একঘণ্টা সিনান। 

এই বলে সে জলাধারের দিকে আঙুল নির্দেশ করে বলে – “এখানে তো পুকুর ছিল, তোমায় বলেইছি। বৃষ্টির মধ্যে এই পুকুরে একঘণ্টা সাঁতার কাটতাম।”

আমি স্বগতোক্তি করলাম – “বাবা! বৃষ্টির মধ্যে পুকুরে সাঁতার। রিস্কি তো।”

মামা দেঁতো হাসি হেসে বলল – “আমাদের ভয়ডর ছিল নাকি? কত কিছু করেছি। তবে, কী জানো, পুকুরে কখনও কোনও অঘটন ঘটেনি। শুধু একবার একটা বাচ্চা মেয়ে ডুবে মারা গিয়েছিল।”

-ইশ! এটা সত্যিই প্যাথেটিক ব্যাপার। কীভাবে ডুবল?

-কীভাবে ডুবেছিল, সেটা তো কেউ দেখেনি। হয়তো পা স্লিপ করে গেছিল। ওই যে বীণা বালিকা বিদ্যালয় আছে, ওই ইস্কুলের একজন সিকিউরিটি গার্ড ছিল, নাম ভজা। ওই ভজারই মেয়ে। তাছাড়া আর কখনও কিছু ঘটেনি। পাড়ার সবার পুকুর ছিল ওটা।”

পুকুরটির নাম ছিল পদ্মপুকুর। বড়ো বড়ো পদ্মফুল ফুটে থাকত সর্বদা, তাই এমন নাম। 

মামাকে জিজ্ঞাসা করলাম – “পুকুরটা কি তোমরা আসার আগে থেকেই ছিল?”

মামা বলে – “ওরকম পুকুর অনেক ছিল এখানে, লাইন দিয়ে। এগুলো সব গঙ্গা ছিল বলেই শুনেছি। পিছনে যে জলের ট্যাঙ্কটা করেছে, সেটাও একটা পুকুর ছিল। এখান থেকে সোজা হাঁটতে থাকবে, আরেকটা পুকুর পাবে, সেটা পার্ট করে দিয়েছে। তারপর আবার আরেকটা পুকুর দেখবে, সেটাকেও পার্ট করে দিয়েছে। কামডহরির দিকে আবার আরেকটা পুকুর আছে, ওটাকে বলে বাসন্তী কালীবাড়ির পুকুর। এখানে রাস্তা তৈরির সময় গঙ্গা ভরাট হয়ে গেছে, এই করে করে পুকুরগুলো হয়েছিল। এখনও যদি কামালগাজীর দিকটায় যাও, দেখবে খালটা বেশ চওড়া, পরিষ্কার জল। ওটা চলে গেছে সেই বারুইপুর অবধি।”

হরেমামার বাসন্তী কালীবাড়ি আসলে বাসনা কালীবাড়ি। আটচালা মন্দির। কিছুটা অংশে ভাঙন ধরেছে। মন্দিরের ভেতরের মেঝেতে সাদা-কালো মার্বেল বাঁধানো ছিল, এক কোণে শিবলিঙ্গ। ওখানেই বিবেক ভারতী শিশু শিক্ষা সদন। ওই স্কুলও পাঁচের দশকে, ১৯৫৮। দুই বাড়িকে ঘিরেই শৈশব-স্মৃতির ফুটনোট।

বিবেক ভারতীর প্রাঙ্গণে তখন হরিণ রাখা থাকত, সঙ্গে খরগোশ, গিনিপিগ, সুদৃশ্য মোরগ। আমাদের শীতে আলিপুর ছিল, বিবেক ভারতী সারাবছর। 

কালীবাড়ির স্মৃতি অবশ্য খুব মধুর নয়, ভয়ের। ছোটোবেলায় আমরা কিছু বাধ্যতামূলক ভয় তৈরি করে নিই, এটাও তেমনই। তখন রাস্তায় তেমন আলো ছিল না, অন্ধকার নামার পর লোক চলাচল আসত কমে, শেয়ালও দেখা যেত শুনেছি। মাঝেমাঝে সন্ধের পরে ওখান দিয়ে হেঁটে ফিরেছি বাবা বা মায়ের সঙ্গে, শুনতে পেতাম পুকুরের পানাদল থেকে ভেসে আসছে ব্যাঙের অবিরাম ডাক, একটা পুরনো বাড়ির শিবমন্দিরের কোটর থেকে ডেকে উঠছে সেই লক্ষ্মীপেঁচা-যুগল। তার উপর শুনতাম, ও পুকুরের সঙ্গে গঙ্গার যোগ আছে। ওটার পাশ দিয়ে ফেরার সময়েই সেটা মনে পড়ত বারবার। 

ব্যাঙ-পেঁচার সমবেত ডাক, তার উপর গঙ্গাযোগের রহস্য, পুরো রাস্তাটা ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকতাম।

আরেকটু বড়ো হয়ে শুনেছি চাঁদ সদাগরের সপ্তডিঙা ভিড়বার কিংবদন্তি। গৌরাঙ্গর নাম থেকে গড়িয়া, এটাও তার আশেপাশের সময়ে শোনা। তারপর জেনেছি, অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিসার কর্নেল উইলিয়াম টালি পরিকল্পনা করলেন আদিগঙ্গা থেকে আরও দক্ষিণে একটি নতুন খাল কাটার। সে খাল কলকাতা বন্দরকে জুড়ে দেবে পুবের বিদ্যাধরী আর মাতলার সঙ্গে। সুবিধা হবে জাহাজ পরিবহনে। ইংরেজদেরও যাতায়াত ছিল এ অঞ্চলে। কামডহরি পূর্বপাড়ায় যেটাকে তালতলা মোড় বলি আমরা, সেখানেই কোনও এক সাহেবের কুঠিবাড়ি ছিল। তাই অনেকে সাহেবকুঠির মোড় বলেও ডাকে।

মনে আছে, ছোটোবেলায় যখন ওই এলাকায় থাকি, একদিন খবর এল, নৌকা পাওয়া গেছে। ড্রেনেজ পাম্পিং স্টেশন তৈরি হচ্ছিল, খোঁড়াখুঁড়ির সময়ে উঠে এসেছে। বাবা দেখতে গিয়েছিল সেই নৌকাকে। গিয়ে দেখেছিল, শুধু নৌকাই নয়, নৌকার যাত্রীও উপস্থিত সেখানে। কত শত বছর পার হয়ে গেছে, তবু সেই যাত্রীদের বিকৃত হাড়গোড় ছেড়ে যায়নি তাদের শেষ আশ্রয় নৌকাটিকে। 

বিবেক ভারতীতে খরগোশ-গিনিপিগ এখনও আছে, পাশের খাঁচায় কয়েকটা রাজহাঁস। বাসনা কালীবাড়ির পুকুর এখন সুসজ্জিত, শান বাঁধানো। রাস্তায় আলো ঝলমল করে, বাইক, রিক্সা, চারচাকা ছুটছে অনবরত। কলকাতা পৌরসংস্থা লাগিয়েছে নীল আলোর বোর্ড। বোরো – ১১, ওয়ার্ড – ১১১, সঙ্গে জ্বলজ্বল করছে পুকুরের পোশাকি নাম – ‘আদি কালী গঙ্গা’। 

কিন্তু আদিগঙ্গা ক্রমশ হারিয়েছে তার আদি জৌলুস। 

টালিগঞ্জ থেকে সম্প্রসারিত মেট্রোর কাজ শুরু হওয়ার পর সেই হারানোর পর্ব আরও দ্রুত শুরু হয়েছিল। ঝুপড়িগুলো ভাঙা হল, ক্যাসেটের ফিতে দিয়ে ছিপ বানিয়ে খালের জলে মাছ খোঁজা বাচ্চাগুলো হারিয়ে গেল কোথায়। 

কালো কুচ্ছিত জলের উপর দিয়ে এখন শব্দ হাঁকিয়ে ছুটে যায় আধুনিক কলকাতা। 

তবে টালি সাহেবের কীর্তির মৃত্যু পরোয়ানার শিকড় খুঁজতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে আরও কয়েক দশক। দেশভাগ হয়ে গেছে, কাতারে-কাতারে লোকে এসে ঘর বাঁধছে এদিকে। বাদাবন ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে, রাস্তা তৈরি হচ্ছে, গড়ে উঠছে কলোনি। সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজের শোষণকামী কলোনির যুগ যখন খাতায়-কলমে শেষ হচ্ছে, তার ঠিক পরেই শুরু হয়েছে এই নতুন কলোনির যুগ। তফাতের মধ্যে, এ কলোনি শোষিতের। বিধানপল্লী বা নবপল্লীর পাশে লক্ষ্মীনারায়ণ কলোনি, ওদিকে গাঙ্গুলীবাগান-বাঘাযতীন এলাকায় বিদ্যাসাগর কলোনি, রানীকুঠির দিকে শ্রী কলোনি, তার ঠিক পাশে রায়পুর সংহতি কলোনি, যাদবপুরের পাশে রামকৃষ্ণ কলোনি, গায়ে-গায়ে এমন অনেকগুলো ‘কলোনি’ নামধারী এলাকা। যাদের নাম নেই, তারাও। প্রত্যেকটির নিজস্ব কলোনি কমিটি ছিল। তারাই মানুষের ভালোমন্দের হর্তা-কর্তা-বিধাতা। 

হরেমামার জন্ম ছয়ের দশকে। সে যখন কিশোর, তখন মরণপণ লড়াইয়ের প্রাথমিক পর্ব কাটিয়ে উঠে অনেকটাই স্বাভাবিক ছন্দে ফিরেছে কলোনির জীবনযাপন। তার ছোটোবেলা কাটত বৃষ্টিতে ফুটবল খেলে, গাছে উঠে ফল পেড়ে। 

বরিশালে বাড়ি ছিল তাদের। 

“বরিশালে কোথায় বাড়ি ছিল তোমাদের? কখনও গেছিলে সেখানে?” 

“না, আমি বরিশাল দেখিনি। বাবা কখনও সে বাড়ির কথা বলত না। আমিও জিজ্ঞাসা করিনি। তবে টাউনে বাড়ি ছিল না আমাদের, সেটুক জানি। গ্রামেই কোথাও ছিল।”

কলকাতায় এসে একটা চাকরি জুটিয়ে নিয়েছিলেন হরেমামার বাবা অনিলকুমার দাস। ভবানী ভবনের ক্যাশ ডিপার্টমেন্টে। ভবানী ভবনকে হরেমামারা এখনও অ্যান্ডারসন হাউস বলেই ডাকে।

বরিশাল থেকে আসা অনিলকুমার নানারকমের কাজ জানতেন। ঘর ছাওয়া থেকে শুরু করে ইলেকট্রিক, প্লাম্বিং, এমন নানা প্রয়োজনীয় কাজ। একমাত্র রাজমিস্ত্রির কাজ ছাড়া প্রায় সব ধরনের কাজই শিখে নিয়েছিলেন। আর শখ ছিল মাছ ধরার। পুকুরে জাল ফেলে এক টানে চার-পাঁচ কেজির মাছ তুলে ফেলতেন। একদিনে ষাট-সত্তর কেজির মাছ ধরার রেকর্ডও ছিল তাঁর। তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র হরিশঙ্কর দাস পিতার এহেন বিবিধ কীর্তির গর্বে মশগুল।

সে বলছিল – “পদ্মপুকুরে প্রত্যেক বছর পয়লা বৈশাখের দিন ভোরবেলা থেকে মাছ ধরা শুরু হয়ে যেত। প্রথমে জেলেরা তিনবার জাল দিয়ে টেনে নিত, তাতে যত মাছ উঠত, সেগুলো কলোনি কমিটি বিক্রি করত। তারপরে আমরা সবাই ধরতাম। সেগুলো সব আমাদের পার্সোনাল। আমার বাবা, দাদা আর আমার এক জামাইবাবু, তিনজনে অন্ধকার থাকতে থাকতে জাল নিয়ে চলে আসত। সেদিন সব ঘরে মাছ ধরা হত। সবাই মাছ পেত। খুব মজা হত, জানো তো!” 

একথা শুনে আমি জিজ্ঞাসা করলাম – “তুমি ধরতে না?”

সে বলল – “আমি তো তখন ছোটো। বাবা-দাদারা তুলত, আর আমার তিন বোন আর আমি সেসব মাছ ব্যাগের মধ্যে ভরে বাড়িতে রেখে আসতাম। আমাদের বাড়ি তো দেখেছ, একদম জলের ট্যাঙ্কের কাছেই। তখন অল্প বয়স, এক ছুটে বাড়িতে চলে যেতাম, আবার চলে আসতাম, কয়েক সেকেন্ড লাগত। কড়াইতে সোডা দেওয়া থাকত, যাতে মাছ ভালো করে সেদ্ধ হয়। আমার মা-দিদিমা সব মাছ পাহারা দিত। একটা বিশাল ঘর জুড়ে মাছ রাখা থাকত আমাদের।” 

তারপরেই কিছু একটা মনে পড়াতে সে বলে উঠল – “ও হ্যাঁ, আমি পুঁটিমাছ ধরতাম। সকলের মাছ ধরা যখন প্রায় শেষ, তখন জলটা পুরো ঘোলা হয়ে যেত। বড়ো সাইজের পুঁটিমাছগুলো ওপরে উঠে আসত, আমি জলে নেমে একটা ঝুড়িতে করে সেগুলোকে তুলে নিতাম।”

মাছ ধরার পুরো বিষয়টি পরিচালনা করত কলোনি কমিটি। বর্ষার আগে মাছের চারা ছাড়া হত পুকুরে, সেই ছোটো মাছগুলো পরের বছর পয়লা বৈশাখের সময়ে আকারে বেড়ে যেত। মাছ ধরার আগের দিন কমিটির কোনও প্রতিনিধি পাড়ায় পাড়ায় ঘোষণা করে দিত মাছ ধরার নির্ঘণ্ট। 

হরেমামা বলল – “আমি তো ছোটো থেকেই বদমাশ। ধরো, পরশু রোববার, তার পরের রোববার মাছ ধরা। এদিকে আমি, প্রথম যে রোববারটা, তার আগের দিন সন্ধ্যাবেলা চোঙা নিয়ে বলে আসতাম – “আগামীকাল বিধানপল্লী পদ্মপুকুরে ভোর পাঁচটা থেকে মাছ ধরা হইবে-এ-এ।” কলোনি কমিটির ঘরে একটা চোঙা রাখা থাকত, সেটাই নিয়ে গিয়ে বলে আসতাম। অনেকেই এতে বোকা বনে যেত। তারা জাল-বঁড়শি সবকিছু নিয়ে চলে এসেছে, এসে দেখত কোথাও কোনও মাছ ধরার গল্প নেই। তখন ওরা সব বলাবলি করত, এ সিওর হরের কাজ। কিন্তু আমাকে সেজন্য কিছু যে বলবে, তেমন সাহস আর কার!”

এই বলে সে একচোট হেসে নিল।

আমি টিপ্পনী কাটলাম – “হ্যাঁ, তুমি তো গ্রেট হরিশঙ্কর দাস। তোমায় আবার কে কী বলবে!”

সেকথায় হরেমামার হাসি আরও চওড়া হয়। আরও দর্প নিয়ে সে বলল – “কমিটি একসময়ে পুকুরে মাছ ছাড়া বন্ধ করে দিল। শুধু একজনকে তারা কিছু বলত না। সেই একজনটা কে জানো? এই হরে। আমি তখন একা লাইলনটিকা মাছ ছেড়েছি। ও মাছ তো বছরে চারবার বাচ্চা দেয়। দু’কেজি ছেড়েছিলাম, সে বোধহয় একবছরে দু’হাজার কেজি হয়ে গিয়েছিল।”

-ও মাছ তুমি কোথা থেকে এনেছিলে?

-আমার বন্ধুর পুকুর ছিল। সেখানে লাইলনটিকা হত। আমি বলেছিলাম, আমাকে কয়েকটা দে, আমি ছাড়ব। লাইলনটিকা ছাড়লে খুব লাভ। তুমি যদি একটা পুকুর পাঁচশো গ্রাম মতো ছাড়ো, কয়েক মাস পরে দেখবে পুকুরে ভর্তি হয়ে গেছে। বা তোমার বাড়িতে যদি একটা চৌবাচ্চা থাকে, সেখানে খুব বেশি না, চার-পাঁচটা যদি ছাড়ো, কয়েক মাসে দেখবে চৌবাচ্চা ভরে গেছে।

-তা তোমার মাছ নিশ্চয় অন্য কেউ ধরত না?

-কেউ ধরত না। আমি বলে দিয়েছিলাম, কেউ ধরবি না।

বর্ষার সময়ে পদ্মপুকুরের জল উঠে আসত রাস্তার ওপরে। হরেমামার ফ্ল্যাটের ওদিকেই একটা পাকা, দোতলা বাড়ি। সম্প্রতি ও বাড়ির বিধবা মালকিন মারা গেছেন, ছেলেমেয়েদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়েছে সম্পত্তির ভাগাভাগি নিয়ে। তখন ওই বাড়ির সামনের রাস্তা ছিল নিচু, বৃষ্টি হলে ওখানে এক হাঁটু জল। মামা বলল – “আমার বাবাকে দেখেছি সেই এক হাঁটু জলেও দেড়-দু’কেজি মাছ তুলে ফেলছে। তখন শুধু পুকুর আর পুকুর, পুকুর আর পুকুর।”

আর ছিল তাদের সর্বক্ষণের ঊষার মাঠ। বর্ষা হলেই জলে ভরে থইথই করত। “একটা লোককে দেখতাম, প্রায় একশো-দুশো পাটকাঠিতে সুতো বেঁধে, বঁড়শি লাগিয়ে, কেঁচো গেঁথে দিত। বঁড়শি তৈরির কাজটা বাড়িতেই করত, তারপর সন্ধ্যার সময়ে এসে জমা জলে কাঠিগুলো ফেলে দিয়ে যেত। মোটামুটি একশোটা কাঠিও যদি ফেলত, তার অন্তত সত্তর-আশিটায় মাছ আটকে থাকত। এটুক জল, মাছ আর কোথায় পালাবে? ও তারপর গিয়ে সেগুলোকে তুলে আনত। আমরা যদি আগে টের পেয়ে যেতাম, আমরা গিয়ে কয়েকটা তুলে আনতাম।”

একথা যেই না বলেছে, অমনি চেপে ধরলাম মামাকে – “বাহ! তোমার লাইলনটিকা মাছ কাউকে ছুঁতে দেবে না, এদিকে অন্য লোকের মাছ নিয়ে চলে আসছ।”

একথায় মামা লজ্জা পেল। সলজ্জ হাসি হেসে সে বলল – “তখন বয়স কম। গায়ের জোরে সকলকে দাবিয়ে রাখব, এরকম ভাবতাম। তখন কি আর ভেবেছি এটা অন্যায় হচ্ছে!”

হরেমামার বাবা বরাবর জাল দিয়েই মাছ ধরতেন। জালের নিচে লোহার কাঠি থাকত, মাছ একবার জালে আটকা পড়ে গেলে সেই কাঠির ব্যূহ ভেদ করে আর বেরোবার উপায় থাকত না। পাড়ে দাঁড়িয়ে অদ্ভূত কায়দায় ঝাঁকি জালটিকে ছুঁড়ে দেওয়া এক দেখবার মতো দৃশ্য বটে। সেরকম এক ঝাঁকি জাল দিয়ে অনিল দাস একবারে ছয় থেকে সাতখানা মাছ ধরে ফেলতেন।

হরেমামা বলল – “আবার জিয়াল মাছের জন্য অন্য পদ্ধতি। তখন জালের সাইডে চাপ দিতে হত। মাছটা যেই জালে আটকা পড়ল, বাবা জলে নেমে হাত দিয়ে জালটাকে মাটিতে চেপে দিত যাতে মাছটা বেরিয়ে না যায়। কই, মাগুর, শিঙি, এসব মাছ ধরা পড়লে তখন এভাবে চাপা দিতে হয়।”

এটা বলতে গিয়েই তার মনে পড়ে গেল একটা ঘটনা। 

“একবার বুঝলে, একটা বিশাল সাইজের শাল মাছ ধরেছে বাবা। ওটা ওই জিয়াল মাছ। বাবা ধরেছে, আমি যথারীতি বাড়িতে গিয়ে কড়াইতে রেখে এসেছি। বড়ো মাছ, কয়েকদিন ধরে খাওয়া যাবে। কিন্তু পরদিনই লোকজনের মুখে শুনলাম, ওরকম আরও একটা মাছ মরে ভেসে উঠেছে পুকুরে। লোকে দেখেছে, তার কপালে সিঁদুর ছিল। সেইদিনই ওই ধরা মাছটাকে আবার পুকুরে ছেড়ে দিয়ে এলাম।”

-মাছের কপালে সিঁদুর? সে আবার কী?

হরেমামা বলল – “ঠিক জানি না। কিন্তু পুকুরের ধারে শেওড়া গাছ ছিল তো। অনেকেই বলত, ওটাতে ভূত থাকে। রাতের বেলায় ওদিক দিয়ে কেউ যেতেই চাইত না, শুনশান হয়ে যেত।”

মামার কথা শুনে হাসি পাচ্ছিল আমার। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজের অজান্তেই আরও একবার তাকালাম পাম্পিং স্টেশনের অফিসবাড়িটির দিকে। সুবিশাল ভবন। পাঁচিলের গা ঘেঁষে গাছেদের অন্ধকার। কাঁঠাল, আম, কদম, সাগু, পান্থপাদপ। বাড়তে বাড়তে অফিসবাড়ির ছাদ ছুঁয়ে ফেলে আর কী!

শুধু সেই শেওড়া গাছটি আর নেই।

Powered by Froala Editor