তিনটে পা ও ১৬টি আঙুল নিয়েই আমেরিকা মাতিয়েছেন ফ্র্যাঙ্ক, শিখেছেন ফুটবলও

মানুষের দৈহিক বৈশিষ্ট্য কী? দুটো চোখ, দুটো হাত, দুটো পা। ঘাড়ের ওপর মাথাটি দুলিয়ে দুলিয়ে বেশ দিন কাটাচ্ছি সবাই। এসব আর নতুন কী! কিন্তু আপনার কোনো একটি অঙ্গ যদি অতিরিক্ত হয়ে যায়! তৃতীয় চক্ষুর কথা বলা হলেও, কেউ এখনও সেটা খোলেনি। ঋত্বিক রোশনেরও একটি হাতে ছয়টি আঙুল, তাও ঠিক আছে। এবার এমন একজন মানুষ আপনার সামনে এল, যার তিনটে পা? তৃতীয় পা-টি স্রেফ দেখানোর জন্য নয়, সেটা দিয়ে রীতিমতো কাজকর্মও করা যেত। কল্পবিজ্ঞান বা রূপকথার গল্প মনে হতেই পারে; কিন্তু তাঁকে অস্বীকার করবেন ফ্র্যাঙ্ক লেন্টিনি। এতক্ষণ যার কথা বলা হচ্ছিল, লেন্টিনিই সেই তিন-পা ওয়ালা মানুষ!

মানুষের ইতিহাস বড়ো অদ্ভুত। অদ্ভুত এই পৃথিবীও। একের পর এক চমকপ্রদ ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে চারপাশে। ১৮৮৯ সালে ইতালির সিসিলির নাটালে ফালকো’র পরিবারও এই কথাগুলোই বিশ্বাস করতে শুরু করল। ততদিনে তাঁদের ঘরে জন্ম নিয়েছে সেই বিস্ময়। নাম, ফ্রাঞ্চেস্কো, বা ফ্র্যাঙ্ক। দুটো পায়ের পাশাপাশি আরও একটি পা কোমরের নিচ থেকে নেমে এসেছে। আর একটি পায়ের হাঁটুর ঠিক নিচ থেকেই বেরিয়ে আছে খানিকটা মাংসখণ্ড। দেখে সেটাকে পায়ের পাতাই মনে হয়। সব মিলিয়ে সদ্যোজাতের তিনটে পা, চারটে পায়ের পাতা আর ১৬টি আঙুল! সন্তানের এমন ‘অদ্ভুত’ দশা দেখে কী মনে হয়েছিল ফালকো দম্পতির, জানা যায় না। তবে তাঁদের মানসিক অবস্থা যে খুব সুখের ছিল না, তা বোঝা যায় পরের ঘটনাতেই। শিশু বয়সেই ফ্র্যাঙ্কের অভিভাবকরা তাঁকে ত্যাগ করেন। অসহায় শিশুটির দায়িত্ব নেন কাকিমা। তাঁর কাছে মানুষ হন ফ্র্যাঙ্ক।

কিন্তু কেন এমন অবস্থা? ডাক্তারি পরিভাষায়, ফ্র্যাঙ্ক লেন্টিনি আসলে ছিলেন ‘প্যারাসাইটিক টুইন’। সহজ ভাষায় বললে, ভ্রূণের জটিল গণ্ডগোল। সব ঠিকঠাক থাকলে ফালকো দম্পতি যমজ সন্তানের অধিকারী হতেন। কিন্তু যমজ ভ্রূণটি ঠিকঠাক বিকশিত হয়নি। যার ফলে এমন অস্বাভাবিকতা। পরবর্তীতে সেটাকেই নিজের বেড়ে ওঠার অন্যতম হাতিয়ার করে নিয়েছিলেন ফ্র্যাঙ্ক লেন্টিনি। তার প্রস্তুতিও শুরু হয় ছোটো বয়স থেকেই।

নিজের ‘স্বাভাবিক’ দুটি পায়ে হাঁটতে পারলেও, তৃতীয় পা হাঁটার কাজে আসত না। কারণ, একটা সময়ের পর এটা আর দৈর্ঘ্যে বাড়েনি। কিন্তু তাতে কী হয়েছে, সেই পা-কেই আরও মজবুত বানাতে লাগলেন ফ্র্যাঙ্ক। নিজের চেষ্টায় ফুটবলে শট নিতেও শিখলেন ওই তৃতীয় পা দিয়ে। গড়িয়ে যাওয়া নয়, বেশ জোরেই যেত বলটা। সেইসঙ্গে শুরু হল তাঁর সার্কাসের জীবন।

বেশ ছোটো বয়সেই আমেরিকার এক শো-ম্যান গুইসেপ্পে মাগনানোর নজরে পড়েন ফ্র্যাঙ্ক। ফ্র্যানচেসকো থেকে ‘দ্য ফ্র্যাঙ্ক’ হওয়ার যাত্রাটা শুরু তখন থেকেই। স্বাভাবিকভাবেই, তাঁর তৃতীয় পায়ের জন্যই পরিচিত ছিলেন। তবে ছোটো বয়স থেকেই বিভিন্ন রকম খেলা শিখতে লাগলেন তিনি। তিন নম্বর পা দিয়ে ফুটবলে লাঠি মারা তো বটেই; সেইসঙ্গে স্কেটিং, সাইক্লিং, দড়ির ওপর চলা— যাবতীয় কৌশল আয়ত্তে নিয়ে নেন তিনি। ফ্র্যাঙ্কের নাম গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি তখন রীতিমতো স্টার। ‘থ্রি-লেগড ফুটবলার’, ‘থ্রি-লেগড সিসিলিয়ান’, ‘দ্য গ্রেট লেন্টিনি’— দর্শকদের থেকেই উপাধি আসতেই থাকে। ফ্র্যাঙ্ক লেন্টিনি তখন ‘দ্য কিং’। আমেরিকার সার্কাস থেকে মঞ্চ সব জায়গা মাতিয়ে রাখছেন।

১৯০৭ সালে, মাত্র আঠেরো বছর বয়সেই ফ্র্যাঙ্ক বিয়ে করেন থেরেসা মারে’কে। তাঁদের চার সন্তানও জন্ম নেয়। ১৯৩৫ সালে থেরেসার সঙ্গে বিচ্ছেদের পর হেলেন শাপে’র সঙ্গে ফ্র্যাঙ্কের সম্পর্ক শুরু হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁদের বিয়ে হয়নি, কিন্তু জীবনের শেষ পর্যন্ত পরস্পরের সম্পর্ক ছিল অটুট। ১৯৬৬ সালে মারা যান ফ্র্যাঙ্ক লেন্টিনি। ততদিনে তিনি তৈরি করে গেছেন লোকগাথা। তিন পা-ওয়ালা মানুষের বিশ্বজয়ের গাথা…

More From Author See More