ভ্যাকসিন-বিরোধী প্রচার নিয়ে বিতর্ক পশ্চিমি দুনিয়ায়; গোটা পৃথিবীতেই পিছিয়ে পড়ছে বিজ্ঞান?

ডিসেম্বরের শেষ রাত। বর্ষবরণের আনন্দে অধীর গোটা বিশ্ব। একটু একটু করে ২০২০ পা রাখছে পৃথিবীর বুকে। এমন ছবির ভেতরেই তৈরি হচ্ছিল আরও একটি ছবি। চিনের উহান প্রদেশ থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা— সবার কাছে নতুন বছরের গোড়া থেকেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল একটি নাম। করোনা, বা কোভিড-১৯। প্রায় আট মাস হতে চলল, এখনও গোটা বিশ্ব এই ভাইরাসের থাবায় আক্রান্ত। কখনও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে, কখনও ভেসে আসছে নতুন করে আক্রান্ত হবার খবর।

সব মিলিয়ে শুধু ভারত নয়, গোটা বিশ্ব অপেক্ষা করে আছে একটা শেষের জন্য। এমন কিছু আসুক, যাতে এই আতঙ্ক থেকে মুক্ত হই আমরা। বিজ্ঞানী, গবেষক, চিকিৎসক— সবাই নিজের নিজের কাজে সবটুকু ঢেলে দিচ্ছেন। বিভিন্ন দেশে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে চলছে প্রতিষেধক তৈরির কাজ। সবার মনে একটাই প্রশ্ন, কবে আসবে করোনার ভ্যাকসিন? ইতিউতি ভেসে আসছে সাফল্যের খবরও। কখনও সেটা অক্সফোর্ড, কখনও ভারত, কখনও আবার রাশিয়া। যতক্ষণ না বাজারে আসছে, ততক্ষণ নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না কেউই। কতদিন আর এমন পরিস্থিতি নিয়ে বাস করা যায়…

আর এসবের মধ্যেই বারবার উঠে আসছে বিতর্ক। আজকের সোশ্যাল মিডিয়া ও প্রচারসর্বস্ব যুগে আর কিছু বাড়ুক না বাড়ুক, ভুয়ো খবরের ঢেউ বেড়েছে। করোনা নিয়েও থেমে থাকছে না সেই ঢেউ। এক এক মুহূর্তের ঝাঁ-চকচকে খবরের ঠেলায় পড়ে সত্যি মিথ্যা গুলিয়ে যাচ্ছে অনেকের। তারই নতুন সংযোজন দেখা গেল ইউরোপ ও আমেরিকায়। হঠাৎ করেই এক শ্রেণীর মানুষ ভাইরাস নিয়ে তেড়ে ফুঁড়ে উঠেছেন। তাঁদের বক্তব্য, এটা প্রকৃতির নিয়মবিরুদ্ধ! ভ্যাকসিন নাকি সরকার আর কর্পোরেটদের একটা ষড়যন্ত্রমূলক প্রচার; আর তাতে আটকে পড়ছি আমরা। সুতরাং, ভ্যাকসিন কিছুতেই ব্যবহার করা যাবে না!

শুনে কি একটু অদ্ভুত লাগছে? লাগলেও, ঠিক এমনই পরিস্থিতি পাশ্চাত্যে। করোনা পরিস্থিতি এমনিই সেখানে ভয়াবহ; তার মধ্যে এমন প্রচারে আখেরে বিপদে পড়ছেন সাধারণ মানুষরাই। ঠিক কারা করছে এই অদ্ভুত আন্দোলন? সূত্রের খবর, পাশ্চাত্য সভ্যতার ভেতরে বহুকাল ধরেই এই ভ্যাকসিন বিরোধী সংগঠনগুলি রয়েছে। আজ নয়, বহু বছর ধরে। যখনই কোনো রোগ এসেছে, আর তা নিয়ে ভ্যাকসিন তৈরি হয়েছে বা প্রয়োগ করা হয়েছে, এঁরা গর্জে উঠেছেন। তাঁদের বক্তব্য, ভগবানের সৃষ্টির ওপর আমরা হস্তক্ষেপ করছি। হ্যাঁ, এই আন্দোলনের সঙ্গে জুড়ে গেছে ধর্মীয় প্রভাবও। আসলে এসবই মানুষকে বশে আনার চক্রান্ত, এমনই বহু তত্ত্ব প্রচার করছেন তাঁরা। কখনও বলছেন, বিল গেটসের ‘ষড়যন্ত্রের’ ফল হল কোভিড-১৯, তিনি নাকি ন্যানোচিপ ঢুকিয়ে দিয়েছেন ভ্যাকসিনের মধ্যে; আবার কখনও বক্তব্য আমাদের ডিএনএ নিয়ে ভয়ংকর কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো হতে পারে। যে দেশগুলো বিজ্ঞান গবেষণা ও পরিকাঠামোর দিক থেকে অনেক এগিয়ে, যাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকি আমরা, সেখানেই এমন অন্ধবিশ্বাসের বাসা।

আরও পড়ুন
রাশিয়া, বিশ্বের প্রথম করোনা ভ্যাকসিন ও কিছু সংশয়

ঐতিহাসিকদের মনে পড়বে, এডওয়ার্ড জেনার যখন বসন্তের টিকা আবিষ্কার করেন, তখনও এঁরা তার বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়েছিলেন। আমেরিকায় এঁদের শতবর্ষের অধিক পুরনো সংগঠনও রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতেই প্রচারের মাধ্যম হিসেবে উঠে এসেছে সোশ্যাল মিডিয়া। এঁদের সাংগঠনিক দক্ষতার জেরে এমন বক্তব্যগুলো মানুষের কাছে পৌঁছেও যাচ্ছে দ্রুত। মনে হতে পারে, আধুনিক যুগে এমন প্রচার কোনো কাজে আসবে না। কিন্তু বাস্তব বলছে অন্য কথা। এঁদের প্রচারের ফলে অনেক মানুষ ভ্যাকসিন নিতে একপ্রকার বেঁকেই বসেছে। রীতিমতো সমীক্ষা চালিয়ে এই তথ্য সামনে এসেছে আমাদের। ইউরোপ, আমেরিকা— দুই জায়গাতেই আগের থেকে বেশ কিছু মানুষ পিছিয়ে এসেছেন। আর সেটাই চিন্তায় ফেলেছে বিজ্ঞানীদের। ভ্যাকসিন-বিরোধী সংগঠনের এমন প্রচার আখেরে চিকিৎসাব্যবস্থা ও বিজ্ঞানশিক্ষারই ক্ষতি করছে; কিন্তু সংগঠনগুলি নাছোড়বান্দা।

তবে করোনার ভ্যাকসিন সংক্রান্ত গবেষণা নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন এমনিও উঠতে শুরু করেছে। ভ্যাকসিন নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বাজারে আসতে বেশ কয়েক বছর সময় লাগে। সেখানে এত তাড়াতাড়ি কী করে সবাই দাবি করছেন সেসব নিয়ে? ইবোলার মতো মারণ রোগের প্রতিষেধক আজও বের হয়নি। উপরন্তু রাশিয়া করোনা ভ্যাকসিনের সাফল্য নিয়ে যে দাবি করেছিল, সেটাও সন্দেহের বাইরে নেই। কারণ এখনও তৃতীয় ও চূড়ান্ত পর্যায়ের ট্রায়াল বাকি। এত কিছু ঘটনা, আর ভ্যাকসিন-বিরোধীদের ‘ঝাঁ-চকচকে’ প্রচার মানুষের সন্দেহকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

আরও পড়ুন
আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহেই বাজারে আসতে পারে করোনার ভ্যাকসিন, দাবি রাশিয়ার

এই প্রসঙ্গেই পিয়ারলেস হাসপাতালের চিকিৎসক ডাঃ শুভ্রজ্যোতি ভৌমিক প্রহরকে জানান, “প্রথমত ভ্যাকসিনের বিরুদ্ধে যা প্রচার চলছে, সেগুলো সম্পূর্ণ ভুল। শুধু করোনা ভাইরাস বলে না, অনেক রোগের ক্ষেত্রেই ভ্যাকসিন প্রয়োজন। ভারত তো বটেই, অনেক জায়গায় টিকাকরণের কর্মসূচিও খুব জোরদার। কাজেই এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে এমন প্রচার ভুয়ো। তবে ভ্যাকসিন সংক্রান্ত গবেষণার ক্ষেত্রে যে প্রশ্নগুলি তোলা হচ্ছে তার কিছু কিছু বিষয় নিয়ে অবশ্যই কথা বলা দরকার। যেমন রাশিয়া যে কাজটা করল সেটা অত্যন্ত প্রিম্যাচিওর সিদ্ধান্ত। ভ্যাকসিনের ক্লিনিকাল ট্রায়ালের ক্ষেত্রে তৃতীয় পর্যায়টি সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। এই পর্যায়তেই ভ্যাকসিনের কার্যক্ষমতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার বিষয়গুলি দেখা হয়। আর অতিমারির পরিস্থিতিতে সমস্ত দেশের সরকার চাইছে ভ্যাকসিন তাড়াতাড়ি আসুক। ফলে গবেষণার কাজও অনেকটা তাড়াতাড়ি হচ্ছে। ইবোলার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু অন্য। এই রোগটা কিন্তু মূলত আফ্রিকার দেশগুলিতে হয়েছিল। ইউরোপ বা আমেরিকায় সেভাবে হয়নি। কাজেই ভ্যাকসিন নিয়েও ততটা উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। শুনতে খারাপ লাগলেও, ভারত আর চিন বাদ দিয়ে এই প্রতিষেধক সংক্রান্ত গবেষণার মূল জায়গাটা আজও পশ্চিমি দেশগুলোয়। করোনার ক্ষেত্রেও এটা দেখা গেছে। যদি ওইসব জায়গায় ইবোলা অতিমারির আকার ধারণ করত, তাহলে হয়ত ভ্যাকসিনও এসে যেত।”

একুশ শতকে দাঁড়িয়ে প্রথম বিশ্বের দেশগুলোতেই শিরোনামে উঠে এসেছে এরকম বিজ্ঞান-বিরোধী প্রচার। ভারত বা বাংলায় কি এমন কিছু দেখা যাচ্ছে? এই ব্যাপারে আশ্বস্ত করলেন ডাঃ ভৌমিক। “বাংলা তো বটেই, ভারতে এরকম কিছু দেখা যাচ্ছে না। বরং ভ্যাকসিন কবে আসবে, এই প্রশ্নটা সবার মুখে মুখে ঘুরছে।” দিনের শেষে ভ্যাকসিন আসুক বাজারে, মানুষ তাড়াতাড়ি রোগমুক্ত হোক সেটাই কাম্য। এইসব অন্ধবিশ্বাস, ভুয়ো প্রচার আগেও ছিল, আজও থাকবে। কিন্তু মানুষ যাতে সেসব ভুলে বিজ্ঞানকে গ্রহণ করে সেটাই সবার আগে দেখা দরকার। সেই প্রচারও যাতে জোরদার হয়, তারও চেষ্টা করতে হবে।      

আরও পড়ুন
৩০০০ বছর আগে ভারতেই প্রচলিত ছিল ভ্যাকসিন, কীভাবে পরিবর্তিত হল আধুনিক চেহারায়?

Powered by Froala Editor

More From Author See More