কালীপুজোর দিনই আরাধনা করা হয় লক্ষ্মীর ‘দিদি’ অলক্ষ্মীকে; কিন্তু কেন?

পরিবার নিয়ে উমা বাপের বাড়ি ফিরে গেছেন বেশ কিছুদিন হল। লক্ষ্মীও ফিরে গেছেন। কোজাগরী পূর্ণিমার পনেরো দিন পর আবারও ফাঁকা মণ্ডপ ভরে উঠবে প্রদীপের শিখায়। আলোর মালায় সেজে উঠবে আমাদের বাড়ি, রাস্তাঘাট। কালীপুজো বলে কথা! প্রতিবার অশুভ নাশ করে শুভ শক্তির আরাধনায় মেতে ওঠে সবাই। তবে দেবী কালী কি একাই আসেন অমাবস্যায়? তাঁর পূজার দিন অনেক জায়গায় আরও একজন আরাধ্য হয়ে ওঠেন। কালীপুজোর পাশাপাশি সিংহাসনে বসেন দেবী অলক্ষ্মীও।

শুধু বাংলা নয়, অনেক জায়গাতেই কালীপুজোর সময় এই বিশেষ দেবীর পূজা অর্চনা করা হয়। ‘অলক্ষ্মী’ শব্দটিও আমরা খুব একটা ভালো অর্থে ব্যবহার করি না। তাহলে এমন পূজা করা হয় কেন? এর পেছনেই লুকিয়ে আছে পৌরাণিক অধ্যায় ও সমাজের এক প্রাচীন রীতি। 

পুরাণ মতে, অলক্ষ্মী হল দেবী লক্ষ্মীর দিদি। এঁদের জন্মবৃত্তান্ত নিয়েও নানা মুনির নানা মত। কেউ বলেন, প্রজাপতি ব্রহ্মার মুখের আলো থেকে জন্ম নেন লক্ষ্মী; আর পিঠ থেকে অলক্ষ্মী। তবে সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনিটি হল সমুদ্রমন্থনের। মন্থনের ফলে সমুদ্রের ভেতর থেকে উঠে আসে অনেক কিছু। তার মধ্যে থেকেই অমৃতের পাত্র নিয়ে জন্ম হয় দেবী লক্ষ্মীর। আর তার ঠিক আগেই জন্ম নেন অলক্ষ্মী। সব দিক থেকেই যেন বোন লক্ষ্মীর বিপরীত তিনি। তাঁর মতো শান্ত স্বভাবের নন, সৌভাগ্যের প্রতীকও নন। বরং পুরাণ ও শাস্ত্রে দেবী অলক্ষ্মীকে বর্ণনা করা হয়েছে কুরূপা, ঈর্ষা ও দুর্ভাগ্যের প্রতীক হিসেবে। গাধার পিঠে চেপে তিনি হাজির হন ঘরে ঘরে… 

তাহলে তাঁর আরাধনা কেন করা হয়? তাও কালীপুজোর দিনেই? অমঙ্গল ও অশুভের প্রতীক হলেও, অলক্ষ্মীকে ভগবতীর এক রূপ বলে মনে করা হয়। আমাদের সবার মধ্যেই সাদা এবং কালো— দুটি দিকই আছে। কখনও কখনও হিংসা, ঘৃণা, বিদ্বেষে ভরে উঠি আমরা। আমাদের ভেতরের ‘লক্ষ্মী’র সঙ্গে ঢুকে যায় অলক্ষ্মীও। কিন্তু তাঁকেও তো দরকার। কালো না থাকলে কি সাদাকে চেনা যায়? সেইজন্যই কালীপুজোর দিন লক্ষ্মী-অলক্ষ্মী দুজনেরই পুজো করা হয়। ঠিক যেমন দুর্গাপূজায় দেবী দুর্গার সঙ্গে আসেন মহিষাসুরও। মনে করা হয়, কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর সময় দেবী লক্ষ্মীর সঙ্গে হাজির হন অলক্ষ্মীও। তাই তাঁকে পুজো করেই বিদায় করা হয়। আর এমন কাজ করার জন্য কালীপুজোই হল আসল দিন। যখন অশুভের নাশ করতে শুভ শক্তির উদয় হয়… 

লক্ষ্মীপুজোর মতোই আলপনা দেওয়া হয় এইদিন। কালীপুজো বলে চারিদিকে থাকে আলোর রোশনাই। তার মধ্যেই শুরু হয় অলক্ষ্মী পুজো। গোবর দিয়ে তৈরি করা হয় অলক্ষ্মীর মূর্তি; আর পিটুলি দিয়ে লক্ষ্মী-নারায়ণ এবং কুবেরের মূর্তি। পুজো হয়ে গেলে মেয়েরা অলক্ষ্মীর সেই মূর্তিটিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়। সঙ্গে শোনা যায় সমবেত ধ্বনি, ‘লক্ষ্মী আয়, অলক্ষ্মী যা’। এইভাবেই ঘরের সব অশুভকে অলক্ষ্মীর বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গেই বাইরে রেখে আসেন তাঁরা। ভেতরে থেকে যান কেবল লক্ষ্মী। সাদা আর কালো নিয়ে বসবাস করলেও, কালো যেন আমাদের গ্রাস না করে, সেই প্রার্থনাই চলতে থাকে এই পুজো জুড়ে। 

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
বুকের ওপর মূর্তি রেখে সাধনা; কমলাকান্তের আরাধ্য কালীই বজবজের ‘খুকি’!