শুধুই মূর্তি নয়, প্রাণ আছে কালীর - প্রতিমার পা চিরে নাকি রক্ত বের করেছিলেন কমলাকান্ত

সপ্তদশ শতক। বৈষ্ণব আন্দোলনের জোয়ারে, বাংলায় তখন শাক্ত-মন্দির থেকে কালী পুজো-অর্চনার গতিও ছিল খুব শ্লথ। অনেক প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, বাংলায় দুর্গাপূজা শুরু হওয়ার আগে শুরু হয়েছিল কালীপুজো। সেসময় বৈষ্ণব ধর্মের প্রচারক শ্রী চৈতন্যদেবের অন্যতম এক সহপাঠী ছিলেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। বাংলায় বর্তমানে যে কালীপূজা হয়, তার শুরু কৃষ্ণানন্দের হাত ধরেই। জানা যায়, প্রাচীন বঙ্গদেশের শতকরা চুরাশি ভাগ কালীমন্দির স্থাপন হয় ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দের পর। কালী সাধনার অঙ্গ হিসাবে শ্যামাসংগীত ও গীত রচনার সূত্রপাতও সেই সময় থেকেই।

তবে বঙ্গদেশে শ্যামাসঙ্গীত রচনায় জোয়ার এনেছিলেন দুই কালীসাধক—রামপ্রসাদ সেন (১৭২৩-১৭৭৫), আর কমলাকান্ত ভট্টাচার্য (১৭৭০-১৮১৮)। আজও আগমনী ও বিজয়ার পদকর্তা হিসাবে কমলাকান্তই সর্বশ্রেষ্ঠ। তাঁর ভণিতায় এখনো অব্দি শ’তিনেক পদ পাওয়া যায়। আউল-বাউল, মীরাবাঈ, নানক, কবীর, তুকারাম সকলেই গানের অর্ঘ্য সাজিয়েছেন তাঁদের উপাস্যের উদ্দেশ্যে। সেই ধারা প্রবাহিত হয়েছে রামপ্রসাদ আর কমলাকান্তের গানে, এবং অনেক পরিশীলিত রূপে রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্যায়ের গানে।

বর্ধমান জেলার গঙ্গা তীরস্থ অম্বিকা কালনায় জন্মগ্রহণ করেন কমলাকান্ত। কৈশোর থেকেই কালী-সাধনায় নিমগ্ন ছিলেন তিনি। যৌবনে তৎকালীন বর্ধমানের মহারাজ তেজচন্দ্র তাঁর দরবারে ডেকে পাঠান কমলাকান্তকে। রাজার ডাকে সভাগৃহে এক সাংগীতিক জলসায় আসার অনুমতি পেয়ে কমলাকান্ত শোনান ‘আদর করে হৃদে রাখো আদরিণী শ্যামা মাকে’, যা পরবর্তী পাঠান্তরে হয়েছে ‘যতনে হৃদয়ে রেখো আদরিণী শ্যামা মাকে’। তারপরেই রাজা তেজচন্দ্র তাঁর সন্তানের শিক্ষার দায়ভার তুলে দেন সাধক কমলাকান্তের হাতে।

পরবর্তীতে রাজা মহতাব কমলাকান্তকে পাকাপাকি ভাবে বর্ধমানে থাকার জন্য বোরহাটের রাজবাড়ির কাছেই স্থাপন করে দেন তার নামের এক বিশাল মন্দির ও সাধনার জন্য পঞ্চমুণ্ডির আসন। তারপর সেখান থেকেই সাধনা শুরু করেন তিনি। এবং সেখানেও নানা অলৌকিক তত্ত্ব আজও ভেসে বেড়ায়। শোনা যায়, মহারাজাকে ঘোর অমবস্যায় পূর্ণিমার চাঁদ দেখান সাধক কমলাকান্ত, এবং তিনিই প্রথম মা কালীর পা চিরে রক্ত বের করে রাজাকে দেখিয়েছিলেন মায়েরও প্রাণ আছে। আর তারপরই নাকি মহারাজ কমলাকান্তের অলৌকিক ক্ষমতার প্রেমে আকুল হয়ে ওঠেন। তারপর সারজীবনটাই কমলাকান্ত বোরহাটের ওই মন্দিরেই সাধনা করে গেছেন ও লিখে রেখে গেছেন শাক্তপদাবলী-বৈষ্ণব পদাবলির সব অমূল্য সম্পদ। মাত্র ৫০ বছর বয়সেই মৃত্যু হয় তাঁর। শোনা যায় মৃত্যু-সময়কালে গঙ্গায় স্নানে যাওয়ার শখ হয়েছিল তার কিন্তু মা'কে ছেড়ে যেতেও চাইছিলেন না। আর তার জন্য নাকি স্বয়ং গঙ্গা মাটি ফুঁড়ে আবির্ভাব হয়েছিল বর্ধমানের বোরহাটের ওই মন্দিরে, পরবর্তী কালে ওই জায়গাটি একটি পাত-কুয়ো হিসাবে আজও রয়েছে যার জল কখনো শুকায়নি।

সাধক কমলাকান্ত অল্পবয়সেই হারান বাবাকে। মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে অনুভব করতেন তিনি। অলীক মায়ার মুক্তির পথ বলতে তিনি ভাবতেন মৃত্যুকেই। তাঁর বিবাহজীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি—অল্প কিছু সময়ের মধ্যে পর পর তাঁর মাতৃবিয়োগ ও পত্নীবিয়োগ ঘটে। শোনা যায়, চিতাগ্নির মধ্যে জগদম্বার আবির্ভাব দেখে তিনি চিতার চারপাশে নৃত্য করতে করতে গেয়েছিলেন তাঁর সদ্যরচিত গান—

কালী! সব ঘুচালি লেঠা,
তোমার যারে কৃপা হয়, তার সৃষ্টিছাড়া রূপের ছটা
তার কটিতে কৌপিন জোটে না, গায়ে ছাই আর মাথায় জটা
শ্মশান পেলে সুখে ভাসে, তুচ্ছ ভাবে মণিকোঠা।

সাধক কমলাকান্তকে একজন তান্ত্রিক হিসাবে ইতিহাস যত বেশি প্রাধান্য দেয়, তারও বেশি প্রাধান্য তাঁকে দেওয়া যায় একজন গীতিকার হিসাবে। বর্ধমানরাজ মহতাবচাঁদের (রাজত্বকাল ১৮৩২–১৮৭৯) উদ্যোগে কমলাকান্ত-রচিত গীতিসমূহের সংকলন গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে। প্রথম প্রকাশনায় শিব, কৃষ্ণ, চৈতন্য সম্পর্কিত ২৪টি, উমা সম্পর্কিত ৩২টি এবং শ্যামাসংগীত ২১৩টি—সর্বসাকুল্যে ২৬৯টি কাব্যগীতি মুদ্রিত হয়েছিল। কমলাকান্তের আগমনী সংগীতেই সর্বপ্রথম উমা-শ্যামার দার্শনিক, আত্মিক এবং আধ্যাত্মিক সমন্বয়ের প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। তাঁর কাছে কন্যাই মাতা, উমাই শ্যামা।

কমলাকান্ত’কে অস্বীকার করা মানে বাংলার শক্তি-চর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এড়িয়ে যাওয়া। অষ্টাদশ শতকের যে-সময় তাঁর জন্ম, তখনও জীবিত রামপ্রসাদ সেন। কিন্তু রামপ্রাসাদ সেনের সঙ্গে অনেকের পরিচিত থাকলেও কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের নাম ততটা প্রকাশিত নয়। অথচ শাক্ত পদকর্তা হিসাবে রামপ্রসাদ সেনের পরই উঠে আসে তাঁর নাম। পান্নালাল ভট্টাচার্যও কমলাকান্তের একাধিক গান গেয়েছেন। বাঙালি আত্মবিস্মৃত জাতি না হলে, কমলাকান্তও হয়তো আজ পরিচিতি পেতেন রামপ্রসাদের মতোই।

More From Author See More