দৈর্ঘ্যে প্রায় এক হাত, যে শঙ্খ ছাড়া অসম্পূর্ণ বর্ধমানের কালী-আরাধনা

পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম ঐতিহাসিক দর্শনস্থলগুলির মধ্যে বর্ধমান শহরের নাম এক বাক্যে যে আজও বলা যায়, এ নিয়ে কোন দ্বিমত থাকতে পারে না। অগণিত ইতিহাসের গল্প কাঁধে নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে এই বর্ধমান শহর। হয়তো সময়ের সঙ্গে কিছুটা মলিন হয়েছে তার স্থাপত্য, তবুও কার্জন গেট থেকে রাজবাড়ি হয়ে গোলাপবাগ আজও কত অজানা ইতিহাসের সাক্ষী। হয়তো নীরবে কান পাতলে আজও শোনা যায় ঠুংরির আওয়াজ, জলসার রেওয়াজ। এই ঐতিহাসিক শহরেরই আর পাঁচটা দর্শনস্থলের মতো একটি দর্শনস্থল হল সোনার কালীবাড়ি।

কথিত আছে, ১৮৯৯ সাল নাগাদ বর্ধমানের রাজা মহতাব চাঁদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই মন্দির। রাজার স্ত্রী অর্থাৎ রানি নারায়ণী দেবী ছিলেন ধার্মিক মহিলা। তিনি তন্ত্রসাধনায় বিশ্বাসী ছিলেন। আর পত্নী-অন্তপ্রাণ মহতাব স্ত্রী’র মন জোগাতেই বোধহয় রাজবাড়ির মিঠাপুকুর এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘ভুবনেশ্বরী মন্দির’। পরবর্তীতে এই মন্দিরের নামকরণ হয় সোনার কালীবাড়ি হিসাবে। কারণ প্রথম কালীর মূর্তিটি সোনার তৈরি ছিল। সত্তরের দশকে সেই সোনার মূর্তি চুরি হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে অবশ্য অনুরাগীরা আবার প্রতিস্থাপন করেন দেবী কালীর মূর্তি। তবে সোনার কালীবাড়ির দেবীর বিশেষত্ব হল, অন্যান্য কালীমূর্তির মতো দেবীর জিহ্বা বাইরে বের হয়ে থাকে না এবং দেবীর পায়ের নীচে মহাদেব নেই। বর্তমানে ব্যস্ত এই শহরের নানান কোলাহলে দিনের পর দিন ওই স্থাপত্য একলা দাঁড়িয়ে থাকলেও, কালীপূজার সময় এই মন্দিরের আকর্ষণ নজর কাড়ে।

মন্দিরে প্রবেশ পথেই দেখা মেলে বহু প্রাচীন এক নহবতখানার। প্রাচীন এই ভাস্কর্যের প্রতিটি দেওয়াল নকশায় পরিপূর্ণ। জানা নেই, রাজা কোথা থেকে এনেছিলেন সেই শিল্পীকে, যিনি আদরের মহিমায় খোদাই করে গেছেন সেসব কারুকার্য। রাজা মহতাব খুব আড়ম্বরপ্রিয় মানুষ ছিলেন। ফলে নহবৎখানায় একদা জলসাও বসত। থাকত ভিন্ন ভিন্ন বাজনা। প্রাচীন তুরহী’ ও ‘করনা’র আওয়াজেও ভরে উঠত এই নহবৎখানা। এই বাজনাদুটির সঙ্গে পাল্লা দিত ‘নরসিংঘা’(শিঙা)। এভাবেই উৎসব পালন করতেন বর্ধমানের মহারাজা।

মন্দিরের প্রবেশপথের উঠোনেই দুটো বৃহৎ আকৃতির পাতকুয়োর সন্ধান মেলে। ব্রাহ্মণরা বলেন, শত খরা-জলাভাবেও এই কূপের জল কখনো শুকোয়নি। আজও মন্দিরের সমস্ত ক্রিয়াকর্ম এই কূপের জল থেকেই হয়। কুয়ো থেকে খানিক এগোলেই দেবীর সুবিশাল মন্দির। শ্বেতপাথরের মন্দিরখানি যেন স্ফটিকের মতো। তার দেওয়ালে কত বাহারের কারুকার্য, খোদাই করা নকশা।

এ-মন্দিরের আরও এক বিশেষত্ব হল, দেবীর পায়ের কাছে নত হয়ে থাকা এক শঙ্খ। যে শঙ্খের নিনাদে মুখরিত হয় সোনার কালীবাড়ির সন্ধ্যারতি। তবে এটি কোনো সাধারণ শঙ্খ নয়। এর আয়তন দেখলে অবাক হতে হয়। প্রায় প্রায় একহাত লম্বা এই শঙ্খের আওয়াজ বড় মায়াবী। আওয়াজের তীব্রতা থাকলেও তাতে কর্কশতা নেই। কথিত আছে, মহারানি নারায়ণী দেবী একদা সমুদ্রতটে গিয়ে সংগ্রহ করেছিলেন এই সুবিশাল শঙ্খ। আবার অনেকে বলেন, মহারাজ মহতাব শখ করে ইতালি থেকে অর্ডার দিয়ে আনিয়েছিলেন এটি। সে যাই হোক, অমন সুবিশাল শঙ্খ যে ভূ-ভারতে খুব বেশি মিলবে না, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

More From Author See More