পঞ্চানন মিলেমিশে যান বুদ্ধের সঙ্গে, তারকেশ্বরে সম্প্রীতির গল্প শোনায় বৌদ্ধ মন্দির

পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে আসে কত অজানা ইতিহাস। ১৪৯৫ সালে বিপ্রদাসের মনসামঙ্গল কাব্যে প্রথম ‘হুগলি’ নামের সন্ধান পাওয়া যায়। ইতিহাস ঘাঁটলে বোঝা যাবে যে পর্তুগিজরা এই বাংলায় প্রবেশ করার প্রায় ২০ বছর আগে রচিত হয়েছিল বিপ্রদাসের মনসামঙ্গল। ১৫৯৮ সালে আবুল ফজল রচিত ‘আইন-ই-আকবরি’তেও হুগলি জেলার নামের সন্ধান পাওয়া যায়।

আর এই হুগলি জেলার প্রসঙ্গ এলেই যে তীর্থক্ষেত্রের কথা মাথায় আসে, তা হল তারকেশ্বর। হিন্দুধর্মের অন্যতম দেবতা মহাদেবের ঐতিহাসিক শিবলিঙ্গ ও মন্দির রয়েছে এখানে। হুগলির উত্তরাংশ অর্থাৎ ত্রিবেণীতে জাফর খাঁ'র মসজিদ ও মাদ্রাসা দেখে অনুমান করা যায়, এই জেলার উত্তরাংশ মুসলমান শাসকের অধীনে ছিল। আবার অপরদিকে তারকেশ্বর হল হিন্দু তির্থক্ষেত্র এবং হিন্দুদের অন্যতম পবিত্র ও জনপ্রিয় স্থান।

এই তারকেশ্বর থেকে কয়েক মিনিটের পথ পেরিয়েই কাঁড়ারিয়ায় অবস্থিত হুগলি জেলার অন্যতম পর্যটন স্থল দেউলপাড়া। ভারী মায়াবী জায়গা। এই দেউলপাড়াতে আবার অবস্থিত হিন্দু দেবতা মহেশ্বরের আরও এক মন্দির, সেই মন্দিরের দেবতা ‘পঞ্চানন’ নামে এবং মন্দির চত্ত্বরটি ‘পঞ্চাননতলা’ নামে পরিচিত(যদিও সেই মন্দির বর্তমানে অস্তিত্বের সংকটে)। ঐতিহাসিকরা বলেন, হিন্দুদেবতা মহাদেব অর্থাৎ পঞ্চাননের সঙ্গে বুদ্ধের এক অসীম মিল। এই পঞ্চাননতলা থেকে ১ কিমি দূরেই হিন্দুধর্মাবলম্বী মানুষের এলাকায় ৯ বিঘা জমির উপর রয়েছে বুদ্ধের এক বিশাল স্ফটিকের মতো বৌদ্ধ মন্দির।

কিন্তু কেন? ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায় যে হুগলি জেলার উত্তরাংশে মুসলমানধর্মের কিছু প্রভাব থাকলেও গোটা হুগলি-তারকেশ্বর-দেউলপাড়া মূলত হিন্দুধর্মের মানুষের বাস ছিল এবং এখনো আছে। বৌদ্ধধর্মের বা বৌদ্ধধর্মালম্বী মানুষের বিশেষ সন্ধান পাওয়া যায় না।

আর প্রশ্নটা দানা বাঁধে এখানেই। এমন হিন্দুধর্মালম্বী মানুষের এলাকায় হঠাৎ এমন বৌদ্ধ মন্দির কীভাবে স্থাপিত হল?

অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায়, এই মন্দিরের জন্ম ১৯৮৫ সালে। কালের নিয়মে খুব বেশি প্রাচীনও নয়। এবং এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা তারকচন্দ্র বাইরি। প্রতিষ্ঠাতার নামও হিন্দুধর্মকেই ইঙ্গিত দেয়। তাহলে হঠাৎ বৌদ্ধ মন্দির স্থাপন করতে গেলেন কেন তিনি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই অনুসন্ধানে উঠে আসে এক আশ্চর্য তথ্য। তারকচন্দ্র বাইরি ছিলেন তখনকার দিনের এক প্রভাবশালী মানুষ। একদা তাঁর শখ হয় উত্তর ভারত ভ্রমণে যাওয়ার। এবং সেই উত্তর ভারত বেড়াতে গিয়েই তিনি এক সুবিশাল বৌদ্ধ মন্দির ও বৌদ্ধধর্মের ধর্মীয় সংস্কৃতিকে দেখে আকৃষ্ট হয়ে পরেন। এবং তারই ফলস্বরূপ তিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে তিনি নিজ বাসভবনে ফিরে এসে গড়ে তোলেন দেউলপাড়ার ৯ বিঘা জমির উপর সুবিশাল বৌদ্ধ মন্দির। রকমারি ফুল-ফল গাছ দিয়ে ঘেরা এই বিশাল বৌদ্ধ মন্দির যেন শান্তির বাণী নিয়ে আজও অবিচল। দেওয়ালের প্রতিটি ইঁটে অপূর্ব সব নকশাকাটা। মন্দিরের ভিতরে সুবিশাল এক উপাসনাকক্ষ, চারটি বৃহৎ পুস্পস্তবক, বেদীর উপর অসম্ভব সুন্দর এক বুদ্ধমূর্তি, দেওয়ালে বুদ্ধের জীবনচরিত নিয়ে কারুকার্য করা তৈলচিত্র। মন্দির স্থাপনের পর, ১৯৮৫ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি দলাই লামা উদ্বোধন করেন এই ‘ত্রিরত্ন সংঘ শান্তিবন বুদ্ধবিহার’। পাথরের ফলকে সে-লেখা আজও উজ্জ্বল।

প্রসঙ্গত, এই বৌদ্ধ মন্দির পালটে দিয়েছে হুগলির মানচিত্রকে। বর্তমানে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ক্ষয়িষ্ণুতা দেখা গেলেও, বাহ্যিক সৌন্দর্য এখনও আগের মতোই রয়েছে। আজও মানুষের ভিড়ে মুখরিত হয় এ-মন্দির। বুদ্ধপূর্ণিমায় দেশ বিদেশ থেকে আসে লোক।

যখন ধর্মের আস্ফালনে প্রতিদিন লাঞ্ছিত হচ্ছে দেশ, ধর্মের নামে রাজনীতিবিদদের কষাঘাতে খুন হয়ে যাচ্ছে মানুষ, বিভ্রান্ত লাগতে পারে আপনারও। তখনই ঘরের কাছে হুগলি জেলার দেউলপাড়ার এই বৌদ্ধ মন্দির আমাদের আরেকবার বুঝিয়ে দেয়, ভারতবর্ষের আবহমান ধারা বিভেদ নয়, ঐক্যকেই প্রাধান্য দিয়েছে সবসময়।

More From Author See More