পিলুর ধারণা, রাত দেখবে বলেই জন্মেছিল সে

শীত আর বর্ষার রাত বরাবরই ভালো লাগে পিলু হাঁসদার, কেন ভালো লাগে সেটা সে জানে না, তবে তার মনে হয় এই রাত দেখার জন্যই সে জন্মেছিল, এক রাত দু রাত করতে করতে আজ পাক্কা চল্লিশে পা দিল সে, তবুও বিরক্তি এল না, আশ্চর্য ব্যাপার!

জোৎসাদি কয়রাপুরের যেদিকটা দিয়ে দামোদর বয়ে গেছে, সেদিকটা কেমন একটা কাস্তের মত হয়ে পাড় গড়ে উঠেছে, পাড় ধরে মাইলটাক হাঁটলে তারপর জোৎসাদি গ্রামের শুরু, এমনিতে খুবই সম্ভ্রান্ত গ্রাম, বেশ কয়েকঘর লোকের বসবাস, তবে কালের চোরাস্রোতে তার জৌলুস কমতে কমতে আজ তলানিতে, বড়লোকের বাড়ির ছেলেপুলেরা পড়াশোনা করে শহরে সেটেল, কেউই আর গ্রামে থাকে না, ফলে কয়েকঘর লোক নিয়ে ঠায় জেগে আছে জোৎসাদি গ্রাম, পিলুরও কাজ জেগে থাকা...

কাস্তে পাড়ের উল্টোদিকে পলেমপুর, লোকে জোৎসাদি থেকে পলেমপুর যায় কাজে, ডাক্তার দেখাতে, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ইস্কুল যায় পড়তে, আর যায় বাইকওয়ালা বাবুরা, এখনো পাকা ব্রিজ হয়নি জোৎসাদি আর পলেমপুরের মাঝের এক ছটাক দামোদরের বুকে, ফলে দুই গাঁয়ের লোকজন গায়ে গতরে খেটে গোটা বর্ষাকাল ও শীতকালের জন্য অস্থায়ী বাঁশের মাচার তৈরি সাঁকো বানায়, গরমে দামোদর প্রায় মরা বলে সাঁকো আর দরকার হয় না, তখন নদীর বালির উপর দিয়েই লোকজন বাইক, সাইকেল ইত্যাদি নিয়ে পার হয়, কিন্তু যেই বর্ষার জল খায় নদী, নদী পুষ্ট হয়ে দানব হয়ে যায়, তখন এই বাঁশের তৈরি গায়েগতরের ব্রিজ ছাড়া উপায় নাই কারো, ঠিক এই ব্রিজের দুই প্রান্তে দুটি ছোট্ট বাঁশের বেড়ার ঘর, নদীর ধারে প্রায় ঝুলছে, একটাতে পলেমপুরের বিকাশ থাকে, আর একটাতে জোৎসাদির দিকে থাকে পিলু, যারা ব্রিজ পার হয়ে আসে ব্রিজের ভাড়া হেতু দুটাকা করে কালেকশন করে পিলুরা, তারপর সেই টাকা গ্রামের ক্লাব ও বারোয়ারিকে দিতে হয়, পিলু সেখান থেকে অল্প যা পায়, তাতেই ওর চলে যায়, বিয়ে থা করেনি বলেই ওই পয়সায় চলে যায় কোনোমতে

পিলু এই কাজ পয়সার জন্য যে শুধু করে তা নয়, কেউ পয়সা না দিলেও ও নির্ঘাত আসত ওই ছোট্ট ঘরটির টানে, ছোট্ট ঘরটায় একজনের শোয়ার জায়গা আছে, মাথায় কাছে একটা ছোট জানালা, সেটার পাটা সরালেই পুরো নদীটাকে দেখা যায় জোৎসাদির দিকটায়, অনেক রাতে দূরে মিটিমিটি করে আলো জ্বলে গ্রামের গেরস্থের বাড়ি, কেউ তুলসীতলায় পিদিম জ্বালে, সেই আলোগুলোর দিকে তাকিয়ে পিলুর মনে হয়, আকাশ থেকে তারাগুলো কেউ খুলে জোৎসাদির অন্ধকারে বসিয়ে দিয়েছে, একটু রাত হলে যাত্রী ক্রমশ কমে আসে, সাতটার দিকে পিলু উনুন ধরায়, খোলা আকাশের নিচেই রান্না বসায়, এ-ব্যাপারে পিলুর আলাদা হুজ্জুত আছে, দিনের বেলা অনেকেই জমি থেকে সবজি তুলে পলেমপুরের বাজারে যাবে বলে সাঁকো পার করে, সাইকেলের পিছনের ক্যারিয়ারে থাকে সবজিভর্তি বস্তা, পিলুর কড়া নজর থাকে বস্তার দিকে, কেউ এলেই এটা সেটা জিজ্ঞেস করে, তারপর কথার পিঠে কথা দিয়ে দুটো কলা, মুলো, সবজি, শাকপালা ইত্যাদি আদায় করে, ব্যবসায়ীরাও বুঝতে পারে একলা লোক কত আর নেবে? পয়সা নেয় না ওইটুকু সবজির,

রাতে সেই আদায়কৃত সবজি দিয়ে রান্না চাপায় পিলু, মাটির হাঁড়িতে চাট্টি ভাতও করে নেয়, রান্না করতে করতে লুঙ্গির কোঁচর থেকে বিটনুনের পুরিয়া বের করে, আর একটা বাংলা মদের বোতল, রান্না শেষ করতে করতে তিনশোর বোতল শেষ করে দেয়, তারপর খেতে বসে, খেতে খেতে আকাশের দিকে তাকায়, তারা দেখে, কিন্তু বর্ষাকালে খুব কষ্ট হয়, ছোট ঘরটা ছেড়ে বেরোনোর উপায় থাকে না, ঘরের ভিতরেই কোনোমতে গুরিশুড়ি মেরে রান্না করতে হয়,তবুও পিলুর বর্ষার রাত ভালো লাগে, হাল্কা নেশার মধ্যে বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে সে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকে, দূর থেকে দু একটা কুকুর ভিজে গিয়ে কেঁদে ওঠে, পিলুর মনে হয় ঠিক এরকমই রাতের জন্য সে জন্মেছিল, এরকম আরাম আর কোত্থাও নাই

মাঝরাতে কখনো কখনো বাইকের হেডলাইটের ঝলক এসে পড়ে, পিলু বোঝে বিপদ আপদের কেস, উঠে একটা ছাতা নিয়ে বেরিয়ে আসে বাইরে, তাকে জিজ্ঞেস করে ঘটনা বৃত্তান্ত, বাইক চলে যায় তারপর ফের অন্ধকারে ডুবে যায় দামোদর, পিলু ঝমঝমে সেই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির ছাঁট গায়ে নিয়ে অনেক দূরে তাকিয়ে দেখে, আজ একটাও তারা ফোটেনি জোৎসাদির গায়ে...