বাংলাদেশের এই পোশাক কারখানা চালাচ্ছেন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরাই

কেউ ভিক্ষা করতেন ট্রেনে-বাসে। আবার কেউ চাঁদা সংগ্রহ করতেন স্থানীয় এলাকায়। এভাবেই এক অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়েই জীবন চলত তাঁদের। হ্যাঁ, ওঁরা সকলেই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। আর সমাজ তাই এখনও জায়গা উপযুক্ত করে দিতে পারেনি ওঁদের। সরকারও কি পেরেছে যোগ্য সম্মান দিতে? তবে লড়াইটা ছাড়েননি কেউ-ই। আর হার না মানার যে জেদের ওপর ভর করেই তাঁরা নিজেরাই তৈরি করে নিয়েছেন উপার্জন পথ।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ছোট্ট এলাকা আজমপুর। সেখানেই রোজকিউ কমপ্লেক্সের কাছে মাঝারি মাপের একটা দোকান ঘর। ভেতরে সার দেওয়া টেবিলের ওপর পর পর ছুটে চলেছে বৈদ্যুতিক সেলাই মেশিন। ছবিটা শহরের আর পাঁচটা পোশাক কারখানার মতোই। তবে বিশেষত্ব হল সেখানকার কর্মীরা সকলেই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। একজোট হয়েই তাঁরা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন স্বয়ংসিদ্ধ হওয়ার জন্য। দু-চোখে সমাজের মূল স্রোতে ফেরার স্বপ্ন, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে দিনবদলের স্বপ্ন। টেইলারিং শপের নামেও প্রতিধ্বনিত হয়েছে সে-কথাই। ‘উত্তরণ ফ্যাশন এন্ড স্বপ্ন টেইলার্স’। স্বপ্নের কারখানাই বটে। 

শুরুটা হয়েছিল বছর কয়েক আগে। ঢাকার তৃতীয় লিঙ্গ সংগঠনের গুরু মা আপন আখতারের ব্যক্তিগত উদ্যোগেই শুরু করেছিলেন এই কারখানা। অল্প-স্বল্প সেলাইয়ের কাজ জানতেন তিনি। সেখান থেকেই সাহসী পদক্ষেপ। নিজের জমানো অর্থ দিয়েই তিনি কিনে ফেলেছিলেন ১০টি বৈদ্যুতিক সেলাই মেশিন। তিনিই ট্রেনিং দেন সম্প্রদায়ের বাকিদের। শুরু হয় পথচলা। কিন্তু প্রতিবন্ধকতা ছিলই। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা জামা-কাপড়ের মাপ নেবেন, এমনটাই চাইতেন না কেউ-ই। ফলত, রাখতে হয়েছিল আলাদা মাস্টারজি। 

তবে বিগত কয়েক বছরে বদলে গেছে সেই ছবি। বর্তমানে গোটা কারখানার সমস্ত কর্মীরাই প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌনতার মানুষ। বদলেছে স্থানীয়দের মানসিকতাও। বর্তমানে তাঁরা নিজেরাই কাজ নিয়ে হাজির হন ‘স্বপ্ন’-এর কারখানায়। পাশাপাশি এসেছে আর্থিক সাহায্যও। বর্তমানে সেলাই মেশিনের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫টিতে। বেড়েছে উৎপাদনও। ঈদ কিংবা পয়লা বৈশাখে বড়ো পরিমাণ কাজের অর্ডার তো আসেই। পাশাপাশি স্থানীয় স্কুলগুলির ইউনিফর্ম তৈরির কাজও বরাদ্দ হয় তাঁদের ওপরেই।

আরও পড়ুন
ভিক্ষুক-জীবন থেকে চিত্র-সাংবাদিকতা – রূপকথার উত্থান তৃতীয় লিঙ্গের যোয়ার

২০১৯ সালে সব মিলিয়ে ২৮ লক্ষ টাকার ব্যবসা করেছিল এই টেইলারিং শপ। কিন্তু মহামারীর আবহে জোর ধাক্কা খেয়েছেন তাঁরা। এক ধাক্কায় কমেছে অর্ডারের সংখ্যা। স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় স্থায়ী উপার্জনের পথটাও বন্ধ হয়েছে। বাধ্য হয়েই আবার পথে পথে চাঁদা সংগ্রহে নামতে হচ্ছে তাঁদের। তবে হতোদ্যম হচ্ছেন না আপন আখতার এবং তাঁর সহযোদ্ধারা। মহামারীর পরিস্থিতি খানিকটা স্বাভাবিক হলেই আবার শুরু হবে আত্মনির্ভর হওয়ার লড়াই। যুদ্ধবিরতিতে দাঁড়িয়ে সেই সময়েরই প্রতীক্ষায় রয়েছেন বাংলাদেশের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা…

আরও পড়ুন
ওড়িশা পুলিশে নিয়োগ তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের, কী ভাবছে বাংলা?

তথ্যসূত্রঃ

আরও পড়ুন
রূপান্তরকামীদের কাজ দিলে আয়করে ছাড়, ঐতিহাসিক পদক্ষেপ বাংলাদেশের

হিজড়া: যে পোশাক কারখানার মালিক থেকে সব কর্মী তৃতীয় লিঙ্গের, বিবিসি বাংলা

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More