প্রকাশ্য সভায় মনোবিদকে খুন, সমকামী সিলভারস্টাইনের ‘প্রতিবাদে’ হতবাক শ্রোতারা

১৯৭২ সালের অক্টোবর মাস। আমেরিকার সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের তরফ থেকে আয়োজন করা হয়েছিল একটি আলোচনাসভার। আলোচনার বিষয়বস্তু, কীভাবে সমকামীদের সমাজের মূল স্রোতে ফেরানো যায়। নানারকম পদ্ধতির কথা বলছিলেন উপস্থিত মনোবিদরা। সবচেয়ে বেশি করে উঠে আসছিল ইলেক্ট্রিক শক থেরাপির কথা। সেই আলোচনাসভায় উপস্থিত ছিলেন তরুণ চার্লস সিলভারস্টাইন। না, সমকামীদের মূল স্রোতে ফেরানোর পদ্ধতি জানতে যাননি তিনি। বরং তাঁর উদেশ্য ছিল সভা বানচাল করা।

হঠাৎ করেই মঞ্চের সামনে গিয়ে হাজির হলেন সিলভারস্টাইন । জোর গলায় ঘোষণা করলেন, তিনি নিজে একজন সমকামী পুরুষ। এইধরণের বিদ্বেষমূলক আলোচনা তিনি আর এগিয়ে নিয়ে যেতে দেবেন না। পোডিয়ামের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা বক্তাকে ঠিক ৫ মিনিট সময় দিলেন তাঁর বক্তব্য শেষ করার জন্য। এরপর তাঁর নিজের কিছু বলার আছে। হঠাৎ এমন একজন আততায়ীর অনুপ্রবেশের কোনো ধারণাই ছিল না প্রতিরক্ষাকর্মীদের। তাছাড়া সেই সময় আমেরিকায় দাঁড়িয়ে কেউ প্রকাশ্যে নিজেকে সমকামী বলে পরিচয় দেবেন, এটাও একরকম অস্বাভাবিক। তার চেয়েও অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। বক্তব্যরত সেই মনোবিদের বরাদ্দ ৫ মিনিট সময় শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে প্রকাশ্যে খুন করে বসলেন সিলভারস্টাইন

পৃথিবীতে আজ অবধি এমন কোনো আন্দোলন ঘটেনি, যার মত ও পথ নিয়ে বিতর্ক ওঠেনি। সমকামী ও ব্যতিক্রমী যৌনতার মানুষদের আন্দোলনও এমন নানা বিতর্কের মধ্যে দিয়েই এগিয়েছে। তার একটা বড়ো অংশজুড়ে যেমন রয়েছে সামাজিক সচেতনতামূলক প্রচার, আবার অন্য অংশ মাঝে মাঝেই হিংসাত্মক রূপ নিয়েছে। বিপ্লবী আন্দোলনের ধারাকে মাথায় রেখেই হাতে তুলে নিয়েছে অস্ত্র। এমনকি আন্দোলনকারীদের হাতে খুন হয়েছেন সমকাম বিরোধী বহু মানুষ। বহু ক্ষেত্রে এইধরণের কর্মকাণ্ড সচেতনতা গড়ে তুলতে সাহায্যও করেছিল।

ঠিক যেমন সিলভারস্টাইনের ঘটনার ক্ষেত্রেই উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্যে যথেষ্ট প্রভাব পড়েছিল। একজন ব্যক্তি তো নিজের উদ্যোগেই সমকামীদের নিজেদের বক্তব্য রাখার জন্য একটি আলোচনাসভার আয়োজন করেন। অনেক পরে একসময় জেলখানায় বন্দি সিলভারস্টাইন  বলেছিলেন, “আমরা আমাদের জীবনের অধিকারের জন্য লড়াই করছিলাম। আমরা প্রাণ নিতেও প্রস্তুত ছিলাম। প্রাণ দিতেও প্রস্তুত ছিলাম।”

আরও পড়ুন
খুনের অভিযোগ, ছদ্মবেশে পলায়ন ও গ্রেপ্তার; সুশীল কুমারের ঘটনা যেন বলিউডি চিত্রনাট্য

আমেরিকা ও পাশ্চাত্য দেশগুলিতে বহুকাল ধরে সমকামকে একধরণের মানসিক বিকৃতি হিসাবে দেখা হত। এমনকি ১৯৬১ সালের আগে আমেরিকার সমস্ত প্রদেশে সমকাম ছিল আইনত শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ক্রমশ আইনি বিধিনিষেধ শিথিল হলেও কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষাক্ষেত্রে সর্বত্র বৈষম্যের মুখে পড়তে হত তাঁদের। এমনকি কর্মক্ষেত্রে নিজেদের প্রকৃত পরিচয় গোপন করে রাখা ছিল একেবারেই স্বাভাবিক বিষয়। এই সামাজিক অচলাবস্থা ভাঙতেই ১৯৫০-৬০-এর দশকে শুরু হয়ে ‘অ্যানোয়াল রিমাইন্ডার’। বছরে একটা দিন অন্তত প্রত্যেকে যেন নিজেদের পরিচয় প্রকাশ্যে আনতে পারেন। যদিও সেখানেও খুব বেশি মানুষের অংশগ্রহণ চোখে পড়ত না। বছরের বাকি দিনগুলো তো নিরাপদে কাটাতে হবে। পরিস্থিতি বদলে গেল ১৯৬৯ সালে ‘অ্যানোয়াল রিমাইন্ডার’ অনুষ্ঠান থেকে। পুলিশের অতর্কিত আক্রমণে শুরু হয়ে গেল দাঙ্গা। আর এই পরিস্থিতিতে প্রাণের ভয়টুকুও হারিয়ে ফেললেন অসংখ্য সমকামী মানুষ। তাঁদের সঙ্গে এসে যোগ দিলেন বহু বিষমকামী নারী-পুরুষও।

আরও পড়ুন
একের পর এক খুন, জেল ভাঙার ‘কৃতিত্ব’; কেন আত্মসমর্পণ করলেন ‘বিকিনি কিলার’?

কখনও হামলাকারীরা সরাসরি ঢুকে পড়েছেন সংবাদসংস্থা সিবিএস-এর দপ্তরে। কখনও আবার এক বেসরকারি সংস্থার কর্ণধারের বৈষম্যমূলক আচরণের জবাবে প্রত্যেক সমকামী কর্মচারী অফিসে যেতে শুরু করলেন ডাক-শ্যুট বা হাঁসের মতো পোশাক পরে। বলা বাহুল্য, আন্দোলনের এইসমস্ত পথ সমর্থন করেননি অনেকেই। মানুষের রুচিশীলতা আঘাত পেয়েছে বারবার। কিন্তু এই আঘাতের মধ্যে দিয়েই উঠে এসেছে সমকামীদের সম্বন্ধে কুরুচিকর মানসিকতার ছবিটাও। আন্দোলনের ভিতর দিয়েই সেই ছবিটা বদলেছে ক্রমশ। এখন প্রতি বছর কোনো না কোনো দেশ সমকামকে আইনি স্বীকৃতি দিচ্ছে। ভিন্ন যৌনতার মানুষদের সুরক্ষার জন্য নানা আইনি ব্যবস্থাও আনা হচ্ছে। কিন্তু সার্বিক সাম্যের লড়াইটা এখনও অনেকটাই বাকি। প্রতি বছর জুন মাস সেই লড়াইয়েরই প্রস্তুতির সময়। ‘প্রাইড মান্থ’ মনে করিয়ে দেয় এইসব রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের কথা।

আরও পড়ুন
১১ বছরের খুদে মানবাধিকার কর্মীকে খুনের হুমকি কলম্বিয়ায়

Powered by Froala Editor