খুনের অভিযোগ, ছদ্মবেশে পলায়ন ও গ্রেপ্তার; সুশীল কুমারের ঘটনা যেন বলিউডি চিত্রনাট্য

ঘাড়ের ওপরে নিঃশ্বাস ফেলছে খুনের মামলা। পুলিশ মাথার দাম ধার্য করেছে ১ লক্ষ টাকা। ফলে সামান্য অসাবধানতাই যে তাঁকে ধরিয়ে দিতে পারে, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। আর তাঁর মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন তারকাকে চিনতে কার-ই বা অসুবিধা হবে? এক সহকারীকে নিয়ে ভোরের আলো ফোটার আগেই তাই বেরিয়ে পড়লেন তিনি। গা ঢাকা দিয়ে পালানো শুরু হল এক শহর থেকে আরেক শহরের দিকে।

না, কোনো সিনেমা অথবা থ্রিলার গল্পের প্রেক্ষাপট নয়। সম্প্রতি ভারতের বুকেই ঘটে গেল এমন একটা ঘটনা। আর সেই বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব? নাম শুনলে চমকে উঠবেন আপনারাও। তিনি শুধু অলিম্পিকের মঞ্চে ভারতের প্রতিনিধিত্বই করেননি, দু’বার পদকও এনে দিয়েছেন রিও এবং লন্ডন অলিম্পিক্সে। প্রখ্যাত কুস্তিগির সুশীল কুমার। গতকালই খুনের দায়ে দিল্লি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন তিনি। তবে সত্যিই কি খুন করেছিলেন তিনি? হ্যাঁ, ইচ্ছাকৃত হোক বা না হোক হলেও খুনের সঙ্গে তাঁর জড়িয়ে থাকার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ।

সপ্তাহ দুয়েক আগের কথা। বিগত ৪ মে-র রাতে দিল্লির ছত্রশাল স্টেডিয়াম ঘটে যায় সেই নৃশংস ঘটনা। তার কিছুদিন আগেই তাঁর সঙ্গে তর্কাতর্কি হয়েছিল তরুণ কুস্তিগির সাগর রানার। দীর্ঘদিন ধরেই দিল্লির এই স্টেডিয়ামে অনুশীলন করেন সুশীল কুমার। অধিকাংশ সময়ে সেখানেই পাওয়া যায় তাঁকে। অন্যদিকে বছর তেইশের রানা সদ্য অনুশীলন শুরু করেছেন এই স্টেডিয়ামে। সুশীল খবর পেয়েছিলেন, তাঁর নামে অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন রানা। আর সেই কারণেই উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য সেদিন রাতে তাঁকে ডেকে আনা হয় ছত্রশাল স্টেডিয়ামে। 

তবে একা ছিলেন না দু’পক্ষই। ফলে প্রাথমিক কটাকাটি থেকে পরিস্থিতি হাতাহাতির পর্যায়ে যেতে সময় লেগেছিল মাত্র কয়েক মিনিট। কিন্তু বিশ্বসেরার সঙ্গে লড়াইয়ে জুত করে উঠতে পারবে, এমন কে-ই বা আছে এই ভারতে? পারেননি রানাও। ভয়ঙ্করভাবে আহত হন তিনি ও তাঁর দুই বন্ধু। রক্তাক্ত হয়ে ওঠে ছত্রশাল স্টেডিয়ামের পার্কিং স্লট। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে সেই তৎক্ষণাতই পলাতক হন সুশীল কুমার ও তাঁর দুই সহযোগী।

আরও পড়ুন
স্বৈরাচারের প্রতিবাদ করায় কবিকে নির্মম হত্যা মায়ানমারে

৪ তারিখ রাতেই আশঙ্কাজনক অবস্থায় দিল্লির একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল রানাকে। তবে বছর তেইশের কুস্তিগির আর লড়াই চালিয়ে যেতে পারেননি। থেমে যায় হৃদস্পন্দন। তবে চিকিৎসায় সাড়া দেন তাঁর বন্ধুস্থানীয়রা। তাঁদের বক্তব্যের ভিত্তিতেই তদন্ত শুরু করে পুলিশ। কিন্তু ততক্ষণে ফেরার হয়েছেন সুশীল কুমার। দিল্লির পরিধি ছাড়িয়ে পাড়ি দিয়েছেন অন্য রাজ্যে। 

আরও পড়ুন
ছুঁড়ে ফেলা হল বাঘের খাঁচায়, মুক্তিযোদ্ধা সালাহউদ্দিনকে নৃশংস হত্যা পাক-বাহিনীর

তবে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে অন্য জায়গায়। সত্যিই কি এই খুন অনিচ্ছাকৃত ছিল? নাকি হত্যার পরিকল্পনা করেই এদিন প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিলেন অলিম্পিকজয়ী তারকা। পুলিশের তদন্ত বলছে তেমন কথাই। পার্কিং স্লটে পাওয়া একটি গাড়ির ডিগি থেকে পুলিশ উদ্ধার করেছে বেশ কিছু আগ্নেয়াস্ত্র এবং কার্তুজ। যা আরও রহস্যময় করে তুলছে গোটা পরিস্থিতিকে। যদিও ধরা পড়ার আগেই সুশীল জামিনের আবেদন করেছিল পুলিশের কাছে। জানিয়েছিল এই ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগ নেই তাঁর। তবে সেই আবেদন খারিজ করে দিয়েছিল দিল্লির পুলিশ সুপার।

আরও পড়ুন
পেশায় সরকারি কর্মচারী, মাত্র ২৮ দিনে ৭ হাজার মানুষ হত্যা করেছিলেন ভাসিলি ব্লোখিন

সেদিন রাতের পর থেকে উত্তরাখণ্ড, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাবের মতো একাধিক রাজ্যে পালিয়ে বেড়িয়েছেন সুশীল কুমার। সঙ্গে ছিলেন তাঁর সহকারী অজয় কুমার। তিনিই গাড়ি চালিয়ে সুশীলকে পৌঁছে দিয়েছেন একের পর জায়গায়। বন্দোবস্ত করেছিলেন আশ্রয়ের। এর মধ্যে একাধিকবার তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় পুলিশের তরফে। তবে স্যুইচ অফ ছিল তাঁর ফোন। মাঝে মধ্যে ফোন অন করলে কয়েক মুহূর্তের জন্য তাঁর টাওয়ার লোকেশন শুধু নজরে আসত পুলিশের। পরক্ষণেই হারিয়ে যেত তার অবস্থান। কারণ, দক্ষ অপরাধীর মতোই সিমকার্ড ব্যবহার না করেই হোয়াটসঅ্যাপ কলে সহকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন সুশীল। 

সুশীলের হদিশ পেতে ১ লক্ষ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করেছিল দিল্লি পুলিশ। এমনকি তাঁর সহযোগী অজয় কুমারের মাথার দাম ধার্য হয়েছিল ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু তারপরেও দীর্ঘ দু’ সপ্তাহের বেশি সময় কীভাবে লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে থাকলেন এমন এক খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব? পথে ঘাটে কারোরই কি নজরে আসেনি বিষয়টি? তবে কি ছদ্মবেশ?

হ্যাঁ, ছদ্মবেশ তো বটেই। করোনাকালে মুখে মাস্ক তো রয়েইছে, সেইসঙ্গে কালো চশমায় নিজের চেহারা পাল্টে ফেলেছিলেন সুশীল। পাঞ্জাব ও উত্তরপ্রদেশ সংযোগকারী একটি হাইওয়ের একটি টোলপ্লাজার সিসিটিভিতে ধরা পড়েছিল তাঁর এমন ছবি। তবে এসবের বাইরেও রয়েছে আরও একটি কারণ। দিল্লিতে অন্ধকার জগতের সঙ্গে বেশ ভালোরকমই যোগ রয়েছে সুশীল কুমারের। দীর্ঘদিন ধরেই অঞ্চলের কুখ্যাত গুণ্ডাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তাঁর। এমনকি সুশীলকে তাঁরা পুজো করে ঈশ্বরজ্ঞানেই। খুনের মামলায় জড়িয়ে পড়ার পর তাঁরাই যে ক্রমাগত সহযোগিতা করে গেছে সুশীলকে, তেমনটাই অনুমান দিল্লি পুলিশের।

সাগর রানা হত্যাকাণ্ডে সব মিলিয়ে ছটি ধারায় মামলা করা হয়েছে সুশীলের বিরুদ্ধে। যার মধ্যে খুন, অপহরণ, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র ছাড়াও রয়েছে মহামারীর ছড়ানোর মতো গুরুতর অভিযোগ। গতকাল সন্ধেতে জলন্ধরের কাছে পুলিশ গ্রেপ্তার করে তাঁকে। আপতত পুলিশি হেফাজতেই রয়েছেন তিনি। কিন্তু প্রমাণ, সাক্ষ্য পাওয়ার পরেও যেন বিশ্বাস করে ওঠা যাচ্ছে না আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের নাম উজ্জ্বল করা এই তারকার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে এমন এক নৃশংস অপরাধ। গোটা দেশের কুস্তিমহলকেই যে কালিমালিপ্ত করলেন তিনি, সন্দেহ নেই তাতে…

Powered by Froala Editor