ছুঁড়ে ফেলা হল বাঘের খাঁচায়, মুক্তিযোদ্ধা সালাহউদ্দিনকে নৃশংস হত্যা পাক-বাহিনীর

১০ নভেম্বর, ১৯৭১। দিনের আলো ফুরিয়ে অন্ধকার নেমেছে চারিদিকে। আর পাঁচটা দিনের মতোই পীরগঞ্জের জবরহাট ক্যাম্পে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। পরদিন সূর্যের আলো ফুটলেই বেরিয়ে পড়তে হবে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে। দু’চোখে নতুন দিগন্তের স্বপ্ন। স্বাধীন ভোর আনার। তবে তাঁর জন্য যে ছলনার ফাঁদ পেতে রাখা আছে, কে-ই বা জানত তখন। খবর এল তাঁর বাবাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে পুলিশ। বন্দি রেখেছে আর্মি ক্যাম্পে। এই সংবাদ আসার পরেও কী ধৈর্য ধরে রাখা যায়? না, একটি বার যে বাড়িতে ফিরতে হবেই তাঁকে। দেখা করতে হবে মায়ের সঙ্গে। কঠিন সময়ে যে একমাত্র তিনিই সান্ত্বনা দিতে পারেন তাঁর মাকে। একটা দিনের ব্যাপার মাত্র। রাতের অন্ধকারেই বেরিয়ে পড়লেন তিনি। পাড়ি দিলেন বাড়ির দিকে।

কথা হচ্ছে বীর শহিদ সালাহউদ্দিনকে নিয়ে। বাংলাদেশের অন্যতম মুক্তিযোদ্ধা তিনি। তখন সবে একাদশ শ্রেণী। কলেজের পঠনপাঠন সরিয়ে রেখে স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়েই যুদ্ধের ময়দানে নেমেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের দিনাজপুর জেলার পীরগঞ্জের এই তরুণ। মাতৃভূমির শৃঙ্খলমুক্তির জন্য উৎসর্গ করেছিলেন প্রাণ। 

১৯৭১-এর এপ্রিল মাস। বাংলাদেশ-জুড়ে তখন আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে। আন্দোলনের আগুন আর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বর্বর হিংস্রতার আগুন। তার মধ্যেই ইতিহাসের এক অন্ধকারতম দিন হয়ে উঠল ১০ এপ্রিল। দিনাজপুরজুড়ে নির্বিচারে হত্যালীলা চালাল পাকিস্তানি বাহিনী। তার আট দিনের মাথায় ১৮ তারিখে আবার একটি গণহত্যা পীরগঞ্জে। লুঠতরাজ, অত্যাচার, মহিলাদের নির্যাতন তো বটেই— নৃশংস এই জেনোসাইডের পরে গ্রামের অধিকাংশ বাড়িতেই অগ্নিসংযোগ করল পাকিস্তানি হানাদাররা। 

ঝলসে যাওয়া দেশ, মাটিতে শুকিয়ে ওঠা রক্তের দাগ আর পড়শিদের মৃতদেহ— এর মাঝে কি চুপ থাকা যায়? নিজের পথ বেছে নিলেন সালাহউদ্দিন। তাঁকেও সামিল হতে হবে এই যুদ্ধে। গড়ে তুলতে হবে প্রতিরোধ। কিন্তু লড়াই করব বললেই তো আর ময়দানে নেমে পড়া যায় না। তার জন্য আগে শেখা দরকার যুদ্ধের কৌশল, রণনীতি, বন্দুক চালনা। আর সেই প্রশিক্ষণ নিয়েই সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে গোপন ক্যাম্পে সে হাজির হলেন দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজের সেই ছাত্র।

আরও পড়ুন
'আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন, আপনারা সর্বস্ব দিয়ে প্রতিরোধ চালিয়ে যান' : বঙ্গবন্ধু

প্রশিক্ষণ শেষ করেই হাজির হওয়া মুক্তিযুদ্ধে। কখনো বীরগঞ্জ, কখনো বা ঠাকরিবাড়ি, মেহেরপুর, বালিয়াডাঙা। এর পর এক অঞ্চলে বন্দুক হাতে অভিযান। নির্যাতক পাক-সেনাদের ছুঁড়ে দেওয়া কঠিন চ্যালেঞ্জ। প্রতিরোধ গড়ে তোলা অবিচারের বিরুদ্ধে। 

এসবের মধ্যেই এসেছিল খবরটা। বাবার গ্রেপ্তারের খবর। একটিবার বাড়িতে যেতেই হবে তাঁকে। কাজেই একদিনের জন্য বন্দুক তুলে রাখা। সহযোদ্ধাদের জানিয়েই রাতের অন্ধকারে বেরিয়ে পড়লেন সালাহউদ্দিন। ১২ মাইল পথ গা-ঢাকা দিয়ে পীরগঞ্জে পৌঁছলেন তিনি। কন কনে শীতের ভোরে তখন সবেমাত্র আলো ফুটছে বাংলাদেশে। দরজায় কড়া নাড়তেই বেরিয়ে এলেন মা। সন্তানকে দেখে দু’চোখে অশ্রুধারা। 

আরও পড়ুন
দুর্গার পাশেই বঙ্গবন্ধুর ছবি, ১৯৭১-এর পুজো ও এক মুসলমান ‘দেবতা’র গল্প

আরও খানিক সময় গড়াতে বোঝা গেল গোটা ঘটনাটাই সাজানো। নিয়তির ডাকেই যেন তিনি এসে হাজির হয়েছেন পৈতৃক ভিটেতে। আসলে বিপক্ষ শক্তি তাঁর জন্যই জাল বিছিয়ে রেখেছিল ষড়যন্ত্রের। সে জালে শিকারকে জড়ানোর জন্যই গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাঁর বাবাকে। ঘড়িতে আনুমানিক সময় সকাল দশটা। ততক্ষণে সারা বাড়ি ঘিরে ফেলেছে পাক সেনারা। কীভাবে পালাবেন তিনি এই জাল কেটে। সঙ্গে কোনো সহযোদ্ধা নেই। নেই হাতিয়ারও। চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন সালাহউদ্দিন। শেষ পর্যন্ত সেনার কাছে আত্মসমর্পণ। শুধু এটুকুই প্রতিশ্রুতি প্রার্থনা করলেন যাতে পরিবারের ক্ষতি না করে তারা। পরিবারের আতর্নাদ আর কান্নার স্বরেও চিড়ে ভিজল না। মায়ের কোল থেকে টেনে হিচড়ে সন্তানকে সদর ক্যাম্পে নিয়ে চলল পাক-সেনা।

পরবর্তী দীর্ঘ ২৪ ঘণ্টা ধরে চলল অকথ্য নির্যাতন। লাথি, ঘুঁষি, চাবুক— বাদ রইল না কিছুই। এমনকি কেটে নেওয়া হল ডান হাতের আঙুল। চোখে ঢুকিয়ে দেওয়া হল মাছ ধরার বঁড়শি। পায়ের গোড়ালিতে পেরেক। সেনা অধ্যক্ষ জানালেন, এই যন্ত্রণা থেকে মুহূর্তেই মুক্তি পেতে পারেন তিনি। শর্ত একটাই। শুধু সহযোদ্ধাদের সন্ধান দিতে হবে তাঁকে। দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে গেছে তখন। সারা শরীর রক্তাক্ত। প্রবল যন্ত্রণার মধ্যেও একটি বাক্যও বেরোল না সালাহউদ্দিনের মুখ থেকে। তাঁর মুক্তি মিললে যে দেশের মুক্তি পাওয়া হবে না আর।

আরও পড়ুন
ঢাকায় নিহত বঙ্গবন্ধু; পিতৃহারা শেখ হাসিনাকে দিল্লিতে আশ্রয় দিলেন প্রণব-দম্পতি

তবে নির্মমতার শেষ নয় এখানেই। এবার চরমতম সিদ্ধান্তটি নিয়েই ফেললেন পাক-সেনারা। হয় তথ্যপ্রকাশ, নয় মৃত্যু। মাইকে সারা গ্রামে ঘোষণা করা হল, বাঘের সঙ্গে লড়াই হবে মানুষের। আর এই সার্কাস দেখতেই তাঁদের হাজির হতে হবে সেনা ক্যাম্পে। ১২ নভেম্বর সকাল। হাত পিছমোড়া করে বেঁধে বাঘের খাঁচার সামনে হাজির করা হল সালাহউদ্দিনকে। রক্তক্ষরণ আর অত্যাচারে ধুঁকছে তখন শরীর। তবুও অকুতোভয় যোদ্ধা হার মানলেন না। তথ্য দিতে অস্বীকার করলেন সহযোদ্ধাদের সম্পর্কে।

খাঁচার দরজা খুলে ঠেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হল তাঁকে। ভেতরে দু’দুটি হিংস্র পশু। বাইরে সেনার পোশাকে আরও বহু বহু। মুহূর্তে তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল দুটি বাঘ। থাবার আঁচড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল দেহ। থেমে গেল প্রাণের স্পন্দন। সেনা ক্যাম্প জুড়ে একদিকে তখন ‘শিকারি’দের উল্লাস। প্রাণভয়ে ক্যাম্পে হাজির হওয়া গ্রামবাসীদের হাঁটু কাঁপছে এই নৃশংস দৃশ্য দেখে। 

বাংলাদেশই হোক, অখণ্ড ভারতবর্ষ হোক, কিংবা পৃথিবীর অন্য কোনো স্বাধীনতা যুদ্ধ— এত নৃশংস ঘটনা দ্বিতীয় রয়েছে কিনা বলা মুশকিল। না, সুদিনের আলো দেখে যেতে পারেননি তিনি। দেখে যেতে পারেননি স্বপ্নের সেই ভোর। তবে তাঁর রক্তক্ষরণই যেন হাজার হাজার তরুণকে এনে হাজির করেছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। তাঁরাও অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন এই নৃশংসতার প্রতিবাদে। বিফলে যায়নি তাঁর প্রাণত্যাগ। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে এসেও সেই রক্তের দাগ এখনও যেন তরতাজা। ওপার বাংলার জাতীয় পতাকার মাঝে সেই লালের মধ্যেই যেন মিশে আছে সালাহউদ্দিনের রক্তের দাগ…

তথ্যঋণ-
১. জীবন্ত সালাহউদ্দিনকে ছিঁড়ে খায় বাঘ, মজিবর রহমান খান, প্রথম আলো
২. উইকিপিডিয়া
৩. বাঘের খাঁচায় মুক্তিযোদ্ধার প্রাণোৎসর্গ

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More